কে বেশি ক্লান্ত—ক্রিকেট না দক্ষিণ আফ্রিকা। ক্রিকেটের ক্লান্তি দক্ষিণ আফ্রিকাকে কিছু দিতে না পারার আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্লান্তি ক্রিকেটের কাছ থেকে বৈশ্বিক কোনো শিরোপা নিতে না পারার! অবশেষে ক্লান্তির সেই কবিতার ক্লাস শেষ হলো। ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকাকে কিছু দিল অথবা দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট খেলাটিকে দায়মুক্ত করল তার কাছ থেকে একটি বিশ্বকাপ নিয়ে! ক্রিকেটকে দায়মুক্ত করা বা দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যর্থতার একঘেয়ে ক্লান্তি ঘোচানোর নায়ক কে? লর্ডসে ২০২৫ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচটি বিশ্লেষণ করলে প্রশ্নটিকে অতীব সহজ মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। উত্তরটাও সবার এখন জানা। একবাক্যে সবাই বলবেন, নায়কের নাম এইডেন মার্করাম।
টেস্ট, ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি—ক্রিকেটের যে সংস্করণের কথাই বলুন, দক্ষিণ আফ্রিকা খেলাটির অন্যতম পরাশক্তি। কিন্তু ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে হওয়া আইসিসি নকআউট ট্রফি (মিনি বিশ্বকাপ) ছাড়া আজকের আগপর্যন্ত কোনো বৈশ্বিক ট্রফি প্রোটিয়াদের ছিল না।
অবশেষে আজ দক্ষিণ আফ্রিকার মাথায় বিশ্বসেরার মুকুট উঠল, ক্রিকেট-তীর্থ নামে পরিচিত লর্ডসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক মেইস বা গদা তুলে ধরেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই দলটির অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। ২৭ বছর পর বড় কোনো টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকা বলতে গেলে একা হাতে শিরোপা জিতিয়েছেন মার্করাম। আরও স্পষ্ট করে বললে আসলে প্রোটিয়াদের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা এনে দিয়েছে মার্করামের ইতিবাচকতা, আত্মবিশ্বাস ও দায়িত্ব নিয়ে খেলার দৃঢ়তা।
ঠিক ১১ বছর আগে মার্করাম নিজেকে ঠিক এ রকম তিনটি শব্দেই বর্ণনা করেছিলেন। সালটা ২০১৪, সেবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ছিলেন মার্করাম। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আইসিসির এক অনুষ্ঠানে মার্করামকে প্রশ্ন করা হয়েছিল—নিজেকে তিনটি মাত্র শব্দে কীভাবে বোঝাবেন। উত্তর যেন মুখস্থ, এমনভাবেই ১৯ বছর বয়সী তরুণ মার্করামের উত্তর ছিল—ইতিবাচক, আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্ববান।
নিজের সম্পর্কে মার্করামের ধারণা যে কতটা স্পষ্ট ছিল, সেটা তিনি পরবর্তী সময়ে দেখিয়েছেন তাঁর নেতৃত্বগুণ আর ব্যাটিং দিয়ে। ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে অসাধারণ নেতৃত্ব আর দায়িত্ববান ব্যাটিংয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে জিতিয়েছিলেন শিরোপা। এরপর গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দারুণ পারফরম্যান্সে দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। যদিও ফাইনালে ভারতের সঙ্গে পেরে ওঠেনি ‘চিরকালের চোকার’ দক্ষিণ আফ্রিকা। ফাইনালে মার্করাম নিজেও ব্যাট হাতে ছিলেন ব্যর্থ।
২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দায় যেন মার্করাম শুধলেন লর্ডসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। প্রায় ৬ মাস পর বড় দৈর্ঘ্যের ম্যাচ খেলতে নেমেছেন এ ম্যাচ দিয়ে। প্রথম ইনিংসে ভালো কিছু করা দূরে থাক, ৪ বল খেলে শূন্য রানে ফিরেছেন। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ২১২ রানের জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকাও অলআউট মাত্র ১৩৮ রানে। ৭৪ রানে এগিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়া দ্বিতীয় ইনিংসে তোলে ২০৭ রান। দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৮২ রানের।
বড় মঞ্চে দক্ষিণ আফ্রিকার চাপে ভেঙে পড়ার অতীত ইতিহাস ঘেঁটে অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন—নাহ্, এবারও হলো না! আরও একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের শিরোপার খুব কাছে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে প্রোটিয়াদের। তাড়া করতে নেমে ৯ রানে প্রথম উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা, ৭০ রানে দ্বিতীয় উইকেট। সে সময়ও অনেকেই মনে করছিলেন—এই বুঝি ভেঙে পড়ছে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপ!
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার এ দলটিতে যে আছেন একজন ইতিবাচক, আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্ববান মানুষ। যিনি দলের সবচেয়ে প্রয়োজনে, ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজের চরিত্রের মূল তিনটি রূপের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম যে বলটির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটিও ছিল স্টার্কের। এবার অবশ্য কোনো ভুল করেননি দায়িত্ববান মার্করাম। স্টার্কের স্লোয়ার বলটি ঠেলে দিয়ে রানের খাতা খোলেন। পরে খেলেন আত্মবিশ্বাসী এক ইনিংস।
জশ হ্যাজলউডের বলে ট্রাভিস হেডের কাছে ক্যাচ দিয়ে আউট হওয়ার আগে ২০৭ বলে ১৪ চারে ৬৫.৭০ স্ট্রাইক রেটে খেলেছেন নিখুঁত এক ইনিংস। হয়তো টেস্ট মার্করাম তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা সেঞ্চুরিটি করলেন লর্ডসে। শুধু তাঁর ক্যারিয়ারে কী, এটা হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ইতিহাসেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেঞ্চুরি! এই সেঞ্চুরিতে কিছু কীর্তিও হয়েছে তাঁর। টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে এটি তাঁর তৃতীয় সেঞ্চুরি। টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে তাঁর সমান তিনটি করে সেঞ্চুরি আছে জিওফ বয়কট, গর্ডন গ্রিনিজ ও গ্রাহাম গুচের। এই তালিকায় তাঁদের ওপরে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ও ভারতের সুনীল গাভাস্কার (৪টি)।
ডন ব্র্যাডম্যান, রয় ফ্রেডেরিকস, গর্ডন গ্রিনিজ, অজিত আগারকার ও মাইকেল ক্লার্কের পর ষষ্ঠ সফরকারী ব্যাটসম্যান হিসেবে লর্ডসে চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি পেলেন মার্করাম। তবে এসব পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, মার্করামের মনে আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে এ সেঞ্চুরিটি খোদাই হয়ে থাকবে দলকে বৈশ্বিক শিরোপা জেতানো ইনিংস হিসেবেই!