বাংলাদেশে কেউ চাইলেও বিরাট কোহলি হতে পারবে না

টেস্ট ক্রিকেটে ২৫ বছর হলো বাংলাদেশের। পথচলা শুরু হয়েছিল সেরাদের কাতারে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু এখন বাস্তবতা কী? রজতজয়ন্তীতে সাবেক অধিনায়কেরা ফিরে দেখছেন অতীত, বলছেন বর্তমানের কথা আর ভাবছেন ভবিষ্যৎ নিয়ে—

অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়, অল্পতেই হৃদয় ভাঙে

আকরাম খান, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

আকরাম খান, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

আমরা যখন প্রথম টেস্ট খেলেছিলাম, স্বপ্ন দেখেছিলাম টেস্টে সেরা চার দলের একটি হব। সেই আশা পূরণ হয়নি, এটা বলা বাহুল্য। অন্য টেস্টখেলুড়ে দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশ এগোতে পারেনি।

টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সময় নিজেদের কোনো মাঠই ছিল না। অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। এখন অনেক মাঠ, খেলোয়াড়েরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। আর্থিকভাবেও তাঁরা স্বাবলম্বী। কিন্তু আমরা ওই পর্যায়ে যেতে পারিনি।

আরও ১০-১৫ বছর আগে কম সুযোগ-সুবিধা নিয়েও সাকিবের মানের খেলোয়াড় বের হয়েছে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের আরেকটা সমস্যা হলো—ওরা অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়, আবার অল্পতেই তাঁদের হৃদয় ভেঙে যায়
আকরাম খান, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

ব্যক্তিগতভাবে অনেকের অনেক অর্জন—সাকিব, তামিম, মাশরাফি, আশরাফুল, মুশফিক, মুমিনুল। মুশফিক তো সব ঠিক থাকলে ১০০ টেস্টও খেলবে। কিন্তু দল হিসেবে আমরা সাফল্য পাইনি।

এই ব্যর্থতা আমাদের সবার। সব জায়গা থেকে যে সাহায্য আসা দরকার ছিল, তা আসেনি। ক্রিকেট বোর্ড উন্নয়ন করতে পারত, এটা ঠিক। কিন্তু জেলার খেলায় বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নেই। ভালো সুযোগ-সুবিধা, ভালো উইকেটে খেলা, নিয়মিত লিগ আয়োজন এসবের ঘাটতি ছিল। ঘরোয়া ক্রিকেটের মান এখনো অনেক কম।

ভালো পর্যায়ে যাওয়ার স্বপ্ন খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিল না। তাঁরা হয়তো বলবেন, সুযোগ-সুবিধা নেই বলে ভালো খেলোয়াড় হতে পারেনি। কিন্তু আরও ১০-১৫ বছর আগে কম সুযোগ-সুবিধা নিয়েও সাকিবের মানের খেলোয়াড় বের হয়েছে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের আরেকটা সমস্যা হলো—ওরা অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়, আবার অল্পতেই তাঁদের হৃদয় ভেঙে যায়।

পরিকল্পনা আর যোগ্য ব্যক্তিত্বের অভাব

খালেদ মাসুদ, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

খালেদ মাসুদ, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

২৫ বছর চলে গেল! এত বছরে টেস্ট ক্রিকেট কোথায় থাকা উচিত ছিল, তা নিয়ে প্রায়ই ভাবি। বাংলাদেশে ক্রিকেটের যে জনপ্রিয়তা, সেটা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।

আমাদের টেস্ট ইতিহাসে অন্তত চার প্রজন্ম পার হয়েছে। অভিষেক টেস্টেই বুলবুল ভাই (আমিনুল ইসলাম) সেঞ্চুরি করেছে। আশরাফুল এসেই দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছে। তখন অনেক সিনিয়রকে টপকে টেস্টে চলে এসেছিল সে। পরে এসেছে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক। কিন্তু তাদের পরের প্রজন্মের কেউ আগের কাউকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

কেউ যদি চীনে গিয়ে ব্রায়ান লারা হতে চায়, পারবে? পারবে না। কারণ, ওই সংস্কৃতি নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি এমন যে এখানে চাইলেও কেউ বিরাট কোহলি হতে পারবে না।
খালেদ মাসুদ, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক


ভারত, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইংল্যান্ড এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখান থেকে বেড়ে ওঠার সুযোগ কম। হয়তো কিছু ইম্প্রোভাইজ বা টেকটিক্যাল পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাংলাদেশের তো বেড়ে ওঠার অনেক জায়গা আছে। ভুল পরিকল্পনা, ভুল মানুষ আর ভুল সিস্টেমের কারণে আমরা পিছিয়ে গেছি। অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি, খেলাধুলাও সেভাবে নেই।

খেলোয়াড়দের দায়ও আছে। কিন্তু কেউ যদি চীনে গিয়ে ব্রায়ান লারা হতে চায়, পারবে? পারবে না। কারণ, ওই সংস্কৃতি নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি এমন যে এখানে চাইলেও কেউ বিরাট কোহলি হতে পারবে না।

আমাদের কাছে মিরপুরই সব। তিন বছর আগে ভারতের রায়পুরে খেলতে গিয়েছিলাম। ওখানে আইপিএলও হয় না। কিন্তু ওখানে যে সুযোগ-সুবিধা, আমাদের তা–ও নেই। পরিকল্পনা আর যোগ্য ব্যক্তিত্বের অভাবেই ক্রিকেটটা এগোয়নি।

ধারাবাহিকতা নেই, নেই বড় ইনিংসের অভ্যাস

হাবিবুল বাশার, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

হাবিবুল বাশার, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

এত বছর পর আমাদের আরও ভালো জায়গায় থাকা উচিত ছিল, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। টেস্ট দল হিসেবে আমরা এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি। ধারাবাহিকতাও নেই। ব্যাটসম্যানদের বড় রান করার অভ্যাস তৈরি হয়নি। অন্য টেস্টখেলুড়ে দেশের ব্যাটসম্যানরা বড় ইনিংস খেলতে চায়। আমাদের ব্যাটসম্যানরা যে চায় না, তা নয়। কিন্তু অভ্যাসটা তৈরি হয়নি।

কারণ, কেউ টেস্ট খেলা শুরু করলেই ঘরোয়া ক্রিকেটে আর তাঁকে দেখা যায় না। আমরা ফিটনেস বলতে শুধু বুঝি জিমে গিয়ে ফিট হওয়া। কিন্তু বড় ইনিংস খেলতে গেলে মানসিক ফিটনেস দরকার। এ জন্য ঘরোয়া ক্রিকেট খেলা জরুরি।

আধুনিক ক্রিকেটে সাদা বলে কষ্ট কম, টাকা বেশি। এ জন্য সবাই সাদা বলে ঝুঁকতে চায়। কিন্তু কোচদের দায়িত্ব খেলোয়াড়দের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া—সাদা বল খেলে উন্নতি হবে না, তোমাকে লাল বলেই খেলতে হবে
হাবিবুল বাশার, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

বড় ইনিংস খেলতে গেলে সহজ সময় আসে, কঠিন সময়ও আসে। কখনো ক্লান্ত লাগে। সেশনের পর সেশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। এ জন্য অনেক পরিশ্রম দরকার। বেশির ভাগই সেটা করতে চায় না। বড় ইনিংস খেলার স্বপ্ন আমাদের ব্যাটসম্যানরা দেখে কি না, জানি না। কিন্তু যখন রান করব, আমি যেন এক শ করে খুশি না হয়ে যাই, এই সীমাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

শেষে একটা চাওয়ার কথা বলি। আধুনিক ক্রিকেটে সাদা বলে কষ্ট কম, টাকা বেশি। এ জন্য সবাই সাদা বলে ঝুঁকতে চায়। কিন্তু কোচদের দায়িত্ব খেলোয়াড়দের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া—সাদা বল খেলে উন্নতি হবে না, তোমাকে লাল বলেই খেলতে হবে।