উৎপল শুভ্রর লেখা

এশিয়া কাপ বাংলাদেশের কাছে ভিন্ন এক অনুভবের নাম

এশিয়া কাপের প্রথম আসরটা সংযুক্ত আরব আমিরাতে আয়োজনের সময় কেই-বা ভেবেছিল, ঘুরেফিরে বারবার এই মরুর দেশে ফিরে যাবে এই টুর্নামেন্ট। এবার পঞ্চমবারের মতো এশিয়া কাপ ক্রিকেটের আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাত। অনেক দিনই আন্তর্জাতিক ভেন্যু, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ‘নিরপেক্ষ ভেন্যু’ হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে আমিরাতের তিন মাঠ—শারজা, দুবাই ও আবুধাবি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে প্রথম এশিয়া কাপ আয়োজনের সময় তো ঘটনা তা নয়। শারজা-দুবাই বললে মনশ্চক্ষে তখন সবাই ধু ধু মরুভূমি দেখেন। সেই সময়ে শারজায় প্রথম এশিয়া কাপ আয়োজনের রহস্যটা তাহলে কী?

রহস্যটা বুঝতে আবদুল রহমান বুখাতিরের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। আমিরাতি এই ধনকুবের সত্তরের দশকে ইংল্যান্ডে গিয়ে ক্রিকেটের প্রেমে পড়ার পর চরম উচ্চাভিলাষী, বলতে পারেন পাগলাটে এক স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। ক্রিকেট ঐতিহ্যবিহীন মরুর দেশে তিনি নামিয়ে আনবেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ঝরনাধারা। স্বপ্ন দেখেই থেমে যাওয়ার লোক বুখাতির নন। টাকাপয়সার তো আর অভাব নেই, শারজায় সেই সময়ের বিবেচনায় আধুনিক এক স্টেডিয়াম বানিয়ে ফেলতে তাই কোনো সমস্যাই হলো না। এশিয়া কাপ ক্রিকেট দিয়েই সেই স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক অভিষেক। পরে তো ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে ঝলমলে আয়োজনের জন্য রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠল শারজা। সাক্ষী হয়ে থাকল ভারত-পাকিস্তান অনেক রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের।

আবদুল রহমান বুখাতিরের সঙ্গে পাকিস্তানের কিংবদন্তি জাভেদ মিঁয়াদাদ

সবকিছুরই সূচনা ১৯৮৪ সালে প্রথম এশিয়া কাপ দিয়ে। এর আগের বছরই গঠিত হয়েছে এশিয়ান ক্রিকেট কনফারেন্স, আইসিসিকে অনুসরণ করে পরে যেটির নাম হয়েছে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল। আমিরাতে উপমহাদেশের অভিবাসী জনগোষ্ঠীই ছিল বুখাতিরের ‘টার্গেট অডিয়েন্স’। সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক আসিফ ইকবাল এবং পেট্রোডলারকে মাধ্যম করে ভারত ও পাকিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডকে তত দিনে কাছে টেনে এনেছেন বুখাতির। এতটাই যে নবগঠিত এশিয়ান ক্রিকেট কনফারেন্সের সদর দপ্তর শারজায় করতেও সানন্দে রাজি সবাই। এশিয়া কাপের প্রথম আয়োজক কীভাবে শারজা, এর উত্তর মনে হয় এ থেকে কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে।

এশিয়া কাপ শুরুটা করে দিয়েছিল, এর পর থেকে বছরে দুবার নিয়মিত তারার মেলা বসেছে শারজায়। কোন দল খেলেনি সেখানে! মাঝখানে তিনটি আসরের পর ১৯৯৫ সালে আবার জন্মভূমি শারজায় ফিরে যায় এশিয়া কাপ। এরপর আবার ২০১৮ ও ২০২২ সালে। তত দিনে শারজাকে পেছনে ফেলে দুবাই ও আবুধাবিতে ঝাঁ–চকচকে অত্যাধুনিক স্টেডিয়াম দাঁড়িয়ে গেছে। মরুর দেশে এশিয়া কাপের ফিরে ফিরে যাওয়ার মূলে অবশ্য ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা। এই দুই দেশেই যে সবচেয়ে কম, মাত্র একবার করে এশিয়া কাপের আসর বসেছে, সেটিও এই কারণেই।

এশিয়া কাপ শুধুই আরেকটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নয়; কারণ, এক দিক থেকে তা একেবারেই অনন্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট বলতে এই একটাই।

ভারত-পাকিস্তান দুই দলকেই না পেলে টুর্নামেন্ট আয়োজনের আসল যে উদ্দেশ্য—এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের তহবিল সংগ্রহ—সেটিই মুখ থুবড়ে পড়ে। যে কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাও বাড়তি টুর্নামেন্ট পেয়েছে। মাঝখানে তো বলতে গেলে এশিয়া কাপের ‘স্থায়ী’ স্বাগতিকই হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১২ থেকে টানা তিনটি এশিয়া কাপ হয়েছে ঢাকায়। এর দুটিতেই বাংলাদেশ ফাইনাল খেলেছে বলে আপনার তা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কাও পাঁচবার এশিয়া কাপ আয়োজন করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবার সেই ‘রেকর্ডে’ ভাগ বসাতে যাচ্ছে।

শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের ফাইনাল আয়োজিত হয়েছে তিনবার

এশিয়া কাপ শুধুই আরেকটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নয়; কারণ, এক দিক থেকে তা একেবারেই অনন্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট বলতে এই একটাই। চাইলেও যে আর কোনো মহাদেশের পক্ষে এমন কিছু আয়োজন করা সম্ভব নয়। মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট করার মতো যথেষ্টসংখ্যক দল সেই মহাদেশে থাকতে হবে তো!

টেস্ট খেলুড়ে ১২টি দেশের ৫টিই এশিয়া মহাদেশের, বলতে পারেন প্রায় অর্ধেক। এশিয়া কাপ ক্রিকেটের চিন্তাটাও এ থেকেই উৎসারিত। যদিও ১৯৮৪ সালে এশিয়ায় টেস্ট খেলুড়ে দলের সংখ্যা ছিল তিন। পরে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান যোগ হয়ে এশিয়া আরও বেশি করে ‘ক্রিকেটের মহাদেশ’ হয়ে উঠেছে। এশিয়া কাপের গুরুত্বও তাই দিন দিন আরও বেড়েছে। বাড়ারই কথা, বলতে গেলে অর্ধেক ক্রিকেট–বিশ্বই তো এই টুর্নামেন্টে থাকে।

বাংলাদেশের কাছে এশিয়া কাপের আবার অন্য তাৎপর্য। স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত করার এক টুর্নামেন্ট। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার আগে এই এশিয়া কাপই ছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উঁকি দেওয়ার জানালা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেকও এই এশিয়া কাপের কল্যাণেই। ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সুযোগ পাওয়ার পেছনে অবশ্য অন্য একটা কাহিনি ছিল। সেবার এশিয়া কাপের আয়োজক শ্রীলঙ্কা। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে নৈমিত্তিক রাজনৈতিক সমস্যার কারণে ভারত শ্রীলঙ্কায় খেলতে যাবে না বলে দিয়েছে। তাহলে তো শ্রীলঙ্কা আর পাকিস্তান ছাড়া দলই থাকে না। দুই দল নিয়ে কি আর টুর্নামেন্ট হয় নাকি! এশিয়ার উদীয়মান ক্রিকেট–শক্তি হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়া বাংলাদেশ তাই ডাক পেল।

এশিয়া কাপে বাংলাদেশ তিনবার ফাইনাল খেললেও শিরোপা জিততে পারেনি

এর পর থেকেই এশিয়া কাপে বাংলাদেশের নিয়মিত উপস্থিতি। অংশ নিয়ে যেমন, তেমনি আয়োজন করেও। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা—চার দলকে নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ এশিয়া কাপও প্রথম হয়েছে এই ঢাকাতেই। সেটি ১৯৮৮ সালে। বাংলাদেশে ক্রিকেটের প্রথম বড় আসর এই দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার প্রথম বড় প্রমাণও।

ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার চেয়েও এশিয়া কাপ তাই বাংলাদেশের কাছে ভিন্ন এক অনুভবের নাম। একবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারলেই যা পূর্ণতা পায়।