সাহিবজাদা মোহাম্মদ শহীদ খান আফ্রিদি; শুধু শহীদ আফ্রিদি নামেই পরিচয়। পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক, সংক্ষিপ্ত সংস্করণে সেরা অলরাউন্ডারদেরও একজন। কিন্তু এই পরিচয় ছাপিয়ে আফ্রিদি মানে সুদর্শন এক তরুণ, গ্যালারিতে যাঁর জন্য ‘ম্যারি মি…’ প্ল্যাকার্ড আর মাঠে তাঁর চার-ছক্কার বৃষ্টিও। বল পেটানোর মতাদর্শে খুব কড়া বিশ্বাস বলেই যেকোনো জায়গা থেকে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারতেন, হয়ে উঠেছিলেন ‘গেম চেঞ্জার’। ২০১৯ সালে প্রকাশিত আফ্রিদির আত্মজীবনীর নামও সেটাই—গেম চেঞ্জার। যেখানে একটা অধ্যায়ে আফ্রিদি লিখেছেন মাঠে তাঁর স্লেজিংও বল টেম্পারিং নিয়ে। বেছে নিয়েছেন তাঁর চোখে পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা একাদশও
জীবনে অনেক কিছু নিয়ে অনেক ঝামেলায় জড়িয়েছি। নানা কারণে জরিমানা গুনতে হয়েছে। কিন্তু স্লেজিংয়ের জন্য জরিমানা বা শাস্তি পেয়ে কখনো আফসোস হয়নি।
ক্রিকেটের সৌন্দর্যই তো আগ্রাসন। মুখে মুখে ঝগড়া, স্লেজিং, প্রতিপক্ষকে একটু খোঁচা দেওয়া—এগুলো ভদ্রলোকের আচরণ নয় ঠিকই, কিন্তু এসব না থাকলে খেলাটা যে কত পানসে হয়ে যেত! দর্শকেরাও পছন্দ করে এসব। তবে স্লেজিংটা মাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। মাঠের বাইরে স্লেজিং? একেবারেই না। এটা অস্বাস্থ্যকর।
আমি নিজেকে কখনো স্লেজিংয়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ভাবিনি। তবে যখন বয়স কম ছিল, এটা আরও বেশি উপভোগ করতাম। এখন অবশ্য একটু শান্ত হয়েছি, বিষয়টা অন্যভাবে দেখি। তবে পাকিস্তান দলে এখন যে নতুন খেলোয়াড়েরা এসেছে, তারা সবাই এর দারুণ ভক্ত। একজন সিনিয়র বা সাবেক সতীর্থ হিসেবে আমার দায়িত্ব—তাদের শেখানো, কীভাবে সীমার মধ্য থেকে স্লেজিং করতে হয়। যেন আম্পায়ার বা রেফারির নজরে না পড়ে, আবার প্রতিপক্ষের মাথাও গরম হয়ে যায়।
আমার সবচেয়ে পছন্দের স্লেজিং ভিকটিম ছিল গৌতম গম্ভীর। কারণ সে চমৎকারভাবে পাল্টা খোঁচা মারত। শেন ওয়ার্নও ছিল ওরকম—যতই উসকাতাম, ততই জ্বলে উঠত। তাই তাঁদের সঙ্গে মাঠে লড়াইও জমত। তবে স্লেজিং করতে গিয়ে আমার কিছু বিব্রতকর মুহূর্তও তৈরি হয়েছে।
মনে আছে, একবার অস্ট্রেলিয়ায় আমরা একটি সিরিজে খুব বাজে খেলছিলাম। অধিনায়ক হিসেবে সেটি ছিল আমার প্রথম সিরিজ। তাই মরিয়া হয়ে একটা জয় চাইছিলাম। তার ওপর ম্যাচটা ছিল পার্থে, যে উইকেট উপমহাদেশীয় দলের জন্য কখনোই খুব একটা সহায়ক নয়।
আমাদের জেতার জন্য বলের বাড়তি কিছু সাহায্য দরকার ছিল। তাই লাখ লাখ দর্শকের সামনে, ক্যামেরার সামনে আমি এমন একটা কাজ করে বসলাম, যা এর আগেও হয়েছে, তবে সরাসরি টিভিতে কেউ দেখেনি। আমি দাঁত দিয়ে বলে কামড় দিলাম! অনেক বড় আর রসিয়ে রসিয়ে কামড় দিয়েছিলাম, যেন বল নষ্ট হয়ে যায় এবং আমরা সুবিধা পাই।
আসলে সবাই বল টেম্পারিং করে। সবাই! আমি শুধু সারা বিশ্বকে দেখালাম, আমরা কীভাবে এটা করি এবং কোনো লুকোছাপা না করেই। এটাই আসল ব্যাপার। আমি জিততে চেয়েছিলাম। আমি জিততে পছন্দ করি। হ্যাঁ, এর জন্য আমি দুঃখিত। খুবই দুঃখিত। জয়ের জন্য এত আবেগপ্রবণ এবং মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম যে সেদিন বলটা প্রায় খেয়েই ফেলছিলাম!
হ্যাঁ, আবেগ গুরুত্বপূর্ণ। ম্যাচের উত্তেজনায় তা ভালোই কাজে দেয়। তবে ২০ বছর ক্রিকেট খেলার পর এটুকু বুঝেছি, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে অনেক ভালো।
কোনো নির্দিষ্ট প্রতিপক্ষকে দেখে আমি কি কখনো ভয় পেয়েছি? না, ভয় পাইনি। তবে একজন খেলোয়াড় ছিলেন, যিনি আমাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলতেন। কারণ, তিনি শুধু তাঁর চোখ দিয়েই অনেক কিছু করতে পারতেন। স্টিভ ওয়াহ।
একনজরেই বুঝে যেতেন ব্যাটসম্যান কী ভাবছে। দল খারাপ খেললেও একাই ম্যাচ জেতাতে পারতেন। তাই তাঁকে বলা হতো ‘আইস ম্যান’। সব সময় ঠান্ডা মাথা, নিখুঁত পরিকল্পনা। ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা চিনে বোলারদের দিয়ে টার্গেট করাতেন। তাঁর মাঠের উপস্থিতি ছিল ভীতিকর। চাইলে দারুণ সৈনিক হতে পারতেন। তার কৌশল ছিল জেতা। আর জয়ের জন্য সব ধরনের কৌশল ব্যবহার করতেন। সব সময়। যেকোনো পরিস্থিতিতে।
অনুপ্রেরণার কথা বললে, আমি বিশ্বাস করি—মানুষ নিজের সবচেয়ে বড় বন্ধু আবার সবচেয়ে বড় শত্রুও। কিন্তু অবশ্যই কিংবদন্তিরা অনুপ্রেরণা জোগান। লোকে বলে, ইমরান খানের পর আমিই পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় তারকা। যাঁরা বলেন, তাঁরা খুবই উদার। আমি যাঁর মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তাঁর সঙ্গে আমার তুলনা করা হয়, এটা দারুণ ব্যাপার।
ইমরান খানের ‘পাঠানপনা’, তাঁর পশতুনসুলভ আচরণ, মিয়ানওয়ালি থেকে উঠে আসা, তাঁর আগ্রাসী মনোভাব—যেটা তিনি রাজনীতিতেও নিয়ে এসেছেন—সবকিছু আমাকে বেড়ে ওঠার সময় ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর অ্যাথলেটিক রানআপ, তাঁর সময়ের উন্মাদনা, তাঁর তারকাখ্যাতি—সবকিছুই আমাকে একজন আগ্রাসী পাকিস্তানি ক্রিকেটার হতে অনুপ্রাণিত করেছে।
খেলাটির আরেক কিংবদন্তি ওয়াসিম আকরাম আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। মঈন খান, সাঈদ আনোয়ার আর ইনজামাম-উল-হকও একইভাবে দেখতেন। আমার মতো এক কিশোরের জন্য এমন তারকাদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। আর তাঁদের সঙ্গে খেলা, তাঁদের কাছ থেকে খেলা শেখা ছিল স্বপ্নেরও বাইরে। এই মানুষগুলোকে ভোলা যায় না।
ইমরান যদি আমার আদর্শ হন, ওয়াসিম ছিলেন আমার গুরু। মাঠে কঠোর লড়াই আর মাঠের বাইরে সহজ-সরল জীবনযাপন করা মানুষ তিনি। মাঠে তিনি সবটুকু চাইতেন, কিন্তু মাঠের বাইরে তাঁর কোনো চাওয়া ছিল না। ম্যাচে আমাকে খাটাতে খাটাতে পাগল করে দিতেন, আবার ম্যাচ শেষে শপিং করাতে নিয়ে যেতেন, জামাকাপড় বাছাই করে দিতেন, বন্ধু হয়ে আড্ডা দিতেন। তাঁর কাছ থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা, শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ক্রিকেট মানেই লড়াই আর লড়াই ছাড়া জীবনেরও কোনো মানে নেই।
সাঈদ আনোয়ার, আমার প্রিয়তম ব্যাটসম্যান। বলেছিলেন, নিজের মূল শক্তি কখনো ভুলে যেয়ো না। পাওয়ার হিটিং, স্ল্যাশিং—এটাই আমার অস্ত্র। ব্যাটিং নিয়ে কোনো দ্বিধায় পড়লে আমি সাঈদ ভাইয়ের উপদেশ মনে করতাম আর আবার ছন্দে ফিরতাম।
মোহাম্মদ ইউসুফ ও ইউনিস খানের কথাও বলতেই হবে। আমি ভাগ্যবান যে আমি পাঠান ইউনিস খানের সঙ্গে খেলতে পেরেছি। কী দারুণ একজন পরিশ্রমী মানুষ! খুব বেশি প্রতিভাবান বা সহজাত ক্রিকেটার ছিলেন না। কিন্তু তিনি বিশ্বকে দেখিয়েছেন যে সাধারণ ক্রিকেট দক্ষতা নিয়েও অনেক দূর যাওয়া যায়।
আমার আরেক করাচির বন্ধু, মঈন খানের কথাও বলতে হয়। মাঠের ভেতরে-বাইরে কীভাবে মনোবল বাড়াতে হয়, সেটা তিনিই আমাকে শিখিয়েছেন। তরুণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, কীভাবে বোলারদের অনুপ্রাণিত করতে হয়, কীভাবে দলকে একত্র করে পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক করতে হয়—আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। মঈন একজন নিখুঁত টিমমেট। দারুণ মানুষ। আমরা একসঙ্গে অনেক স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ করেছি।
আবার এমন একজন আছেন, যিনি পাকিস্তানের হয়ে খেলেননি, কিন্তু তাঁকে নিজের দলে পেলে দারুণ হতো। ব্রায়ান লারা। তাঁর প্রতিভা, আচরণ, মনোভাব, বন্ধুসুলভ স্বভাব আমাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করে। আমরা দু-একবার একসঙ্গে ঘুরেছি; তিনি জীবনটাকে পুরোপুরি উপভোগ করেন। তার তারকাখ্যাতি, স্টাইল, ব্যক্তিত্ব আর বাঁহাতি ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য—সব মিলিয়ে তিনি হতেন দুর্দান্ত সতীর্থ।
তবে লারাকে ছোট না করেই বলছি, আমি কখনোই বাঁহাতি হতে চাই না। যদি আবার শুরু করতে পারতাম, আমি সব সময় ডানহাতিই হতাম। তবে সঙ্গে যদি লারার সহজাত প্রতিভাটা পেতাম, দারুণ হতো। তার অবিশ্বাস্য সুন্দর স্ট্রোকপ্লের তুলনায় আমার শট নির্বাচন তো আনাড়ির মতো। তিনি যদি শিল্পী হন, আমি তো কসাই।
যখন পছন্দের কথা হচ্ছে, তখন আমার সেরা একাদশের তালিকাও দেওয়া যাক। আমার চোখে পাকিস্তানের সেরা একাদশ (সতর্কতা: এটি সম্পূর্ণ পেশাদার মতামত। দল গঠনের সময় কোনো রাজনীতি বা ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রভাব ছিল না)।
পাকিস্তানের সেরা একাদশ
১. সাঈদ আনোয়ার: পাকিস্তান তাঁর মতো ওপেনার কখনো দেখেনি, আর হয়তো দেখবেও না। আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ওপেনার। লড়াকু মনোভাব আর করাচির মানুষের মতো মানসিক দৃঢ়তা তাঁর মধ্যে ছিল।
২. আমির সোহেল: সাহসী খেলোয়াড়। মার্জিত। ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করতে গেলে সাহস থাকা জরুরি।
৩. ইনজামাম-উল-হক: দলের মেরুদণ্ড। যেকোনো মিডল অর্ডারের স্তম্ভ।
৪. মোহাম্মদ ইউসুফ: অসাধারণ। দুর্দান্ত টেকনিক। দলের জন্য তাঁর রক্ষণাত্মক খেলার দরকার।
৫. জাভেদ মিয়াঁদাদ: কৌশলী। পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার ক্ষমতা তাঁর ছিল। যেকোনো পরিস্থিতি সামলাতে পারতেন।
৬. ইমরান খান: সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ও অলরাউন্ডার। কোনো সন্দেহ নেই।
৭. শহীদ আফ্রিদি: পাঠান, গেম চেঞ্জার।
৮. রশিদ লতিফ: ঢাকা ও পেশোয়ারের মধ্যে জন্ম নেওয়া সবচেয়ে কঠিন উইকেটকিপার।
৯. ওয়াসিম আকরাম: নতুন বলে রাজা, পুরোনো বলে সম্রাট। সুইংয়ের সুলতান।
১০. ওয়াকার ইউনিস: এক প্রান্তে ওয়াসিম থাকলে অন্য প্রান্ত থেকে আসা বুলেট। দুই ‘ডব্লু’ ছাড়া দল কল্পনা করা যায় না।
১১. শোয়েব আখতার: হিংস্র। ক্ষিপ্র। মাঠের বাইরেও জটিল মানুষ। কিন্তু মাঠে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানকে প্রতি ওভারে দুবার মায়ের কথা মনে করাতেন।
এই দলের অধিনায়ক? অবশ্যই ইমরান খান!
১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর ২২ বছরের ক্যারিয়ারে শহীদ আফ্রিদি জিতেছেন টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপ। দলীয় এ সাফল্যের বাইরে গড়েছেন অসংখ্য রেকর্ড। ওয়ানডেতে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেঞ্চুরি ও সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড তাঁর। ২০০৭ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টুর্নামেন্ট–সেরাও হয়েছেন। কয়েক দফা অবসর ঘোষণা এবং বয়স নিয়ে বিতর্ক ছড়ালেও ব্যাটিংয়ে ভরপুর বিনোদন দিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ওয়ানডেতে প্রথম ব্যাটিংয়ে নেমেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর ৩৭ বলে সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড টিকে ছিল পরের ১৮ বছর।