তাসকিন আহমেদ
তাসকিন আহমেদ

১৫০ কিলোমিটার ভুলে তাসকিনের চোখ অন‍্য কিছুতে

কখনো তিনি শন টেইটের ছাত্র, কখনো তাঁর ওপর ফিল সিমন্সের চোখ, কখনো নেটের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন, কখনোবা জেমস প্যামেন্টের ছুড়ে দেওয়া বল ক্যাচ বানাতে দৌড়াচ্ছেন প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের মাঝমাঠে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এত কিছু করে বিকেলে আবার তিনিই হোটেলের জিমে।

কলম্বোর প্রচণ্ড গরম শরীরের শেষ স্বেদবিন্দুটুকু নিংড়ে নিতে চায়। পানি আর এনার্জি ড্রিংকের সমান্তরালে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় ডাবের পানির সরবরাহও ডাগআউটে অফুরান। অনুশীলনে একটার পর একটা পর্ব শেষে আর সবার মতো তাসকিন আহমেদও সেসবে তৃষ্ণা মেটান। কিন্তু তাঁর তৃষ্ণাটা যে শুধু পানীয়রই নয়, আরেকটু বেশি কিছুর।

আরও অনেক ফাস্ট বোলারের মতো তাসকিনের ক্যারিয়ারেও চোট-আঘাতের দাগ কম নেই। সর্বশেষ সমস্যা বাঁ পায়ের গোড়ালির হাড় বেড়ে যাওয়া, যেটি তাঁকে ভোগাতে শুরু করে গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে। সমস্যা নিয়েই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে বিপিএল এবং বিপিএলের পরপরই খেলেন চ্যাম্পিয়সনস ট্রফিতে। এরপর আর পারেননি।

এখানে লাইন-লেংথ ঠিক রাখাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে পেস তো পেসই, বলে একটা পেস তো থাকতেই হবে। বেশি আস্তে করলে আবার মারবে (হাসি)।
শ্রীলঙ্কার মাটিতে ওয়ানডে সিরিজের আগে তাসকিন আহমেদ

পায়ের সমস্যা তাসকিনকে মাঠের বাইরে রেখেছে গত এপ্রিল থেকে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্ট সিরিজের পর খেলা হয়নি আমিরাত ও পাকিস্তানে পিঠাপিঠি টি-টোয়েন্ট সিরিজে। ঢাকার চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরে ইংল্যান্ডে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখিয়ে পেলেন ভিন্ন ‘প্রেসক্রিপশন’। অস্ত্রোপচার করলেও সমস্যা দূর হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তার চেয়ে ব্যথাটাকে সহনশীলতার মধ্যে রেখে খেলা চালিয়ে যাওয়াই ভালো।

জিম করার পাশাপাশি পায়ের শক্তি বাড়ানোর বিভিন্ন ব্যায়াম করতে হয় তাসকিনকে

সেটা করতে গিয়ে নিয়মিত পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে হচ্ছে তাসকিনকে। জিম, পায়ের শক্তি বাড়ানো, ব্যথার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। এর আগে কাঁধ আর হাঁটুর চোটেও টেন্ডনের সমস্যায় ভুগেছেন বলে তিনি জানেন, এ ধরনের ব্যথাকে কী করে বশে রাখতে হয়। এখন যোগ হয়েছে গোড়ালি। অর্থাৎ শারীরিক অনেক ক্ষেত্রেই ‘বিশেষ ব্যবস্থাপনা’ মেনে খেলতে হবে তাসকিনকে। মাঝেমধ্যে বিশ্রামও লাগবে। সে জন্যই চলতি শ্রীলঙ্কা সিরিজের দুই টেস্টেও তাঁর খেলা হয়নি।

জাতীয় দলের হয়ে তাসকিন হয়তো আবার মাঠে নামবেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কাল কলম্বোয় শুরু ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে। তবে শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলাটা লম্বা বিরতির পর মাঠে ফেরা কোনো বোলারের জন্যই ভালো কোনো উপলক্ষ হওয়ার কথা নয়। প্রচণ্ড গরম, ব্যাটিং–বান্ধব উইকেট আর শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানদের সাম্প্রতিক ফর্ম মিলিয়ে তাসকিনও যেন বেশ একটা চ্যালেঞ্জই অনুভব করছেন।

তবে সব রোগেরই ওষুধ আছে। তাসকিনও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বোলিং করার একটা মূলনীতি ঠিক করে ফেলেছেন। কাল প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে অনুশীলনের ফাঁকে সেটি শোনার সুযোগ হয়েছে বাংলাদেশ দলের এই ফাস্ট বোলারের কাছ থেকেই, ‘ওরা (শ্রীলঙ্কা) নিজেদের মাঠে অনেক ভালো দল। সাম্প্রতিক সময়ে ভালো ফর্মে আছে, গেম অ্যাওয়ারনেস ভালো। এখানে বেশির ভাগ উইকেটই ফ্ল্যাট, গরমের জন্য উইকেট শুকনা হয়। খুব জোরে বল করে লাভ নেই। ভালো লাইন-লেংথে টানা বল করে যেতে হবে।’

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ভালো লাইন–লেংথে বল করতে চান তাসকিন

শ্রীলঙ্কার উইকেটে ভালো লাইন-লেংথ কী, তাসকিন জানালেন সেটাও, ‘গত কয়েক বছরে যে অবস্থা দেখেছি, তাতে এখানে স্টাম্প টু স্টাম্প ডিসিপ্লিনড বোলিং করাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওরা সাইড শটও ভালো খেলে। একটু এদিক-ওদিক হলেই রান হয়ে যায়।’

গতির নেশায় থাকা তাসকিনের একসময় স্বপ্ন ছিল ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটারে বোলিং করা। ক্যারিয়ারে ১৪৯ পর্যন্ত গতি তুললেও দেড় শ ছোঁয়া হয়নি। এখন অবশ্য আর সেই স্বপ্ন নেই। তাই বলে জোরে বল করবেন না, তা–ও নয়, ‘এখানে লাইন-লেংথ ঠিক রাখাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে পেস তো পেসই, বলে একটা পেস তো থাকতেই হবে। বেশি আস্তে করলে আবার মারবে (হাসি)।’

চোট থেকে ফিরে ১৪০ কিলোমিটারের ওপর তুলতে পারছেন, তাসকিন আপাতত সেটাতেই খুশি। কলম্বোয় গত দুই দিনের অনুশীলনে ৮-১০ ওভার করে বোলিং করতে পারা, এর আগে চট্টগ্রামে ওয়ানডে ক্রিকেটারদের অনুশীলন আর প্রস্তুতি ম্যাচেও পুরো ছন্দে বোলিং—সব মিলিয়ে মাঠে ফেরার জন্য প্রস্তুত। ওজন একটু বেড়েছে বলে মনে হলেও ফিটনেস নিয়ে তাঁর অন্তত কোনো অস্বস্তি নেই। চার মাস না খেলাটাকেই একমাত্র ঘাটতি মনে করছেন। তবে তাসকিনের কথায় মনে হলো, সেটাও তাঁর আত্মবিশ্বাসে তেমন চিড় ধরাচ্ছে না।

বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ ও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক পেসার শন টেইট

বিপিএলে তাসকিন একসময় চিটাগং কিংসে শন টেইটের সঙ্গে খেলেছেন। সাবেক এই অস্ট্রেলিয়ান পেসারই এখন বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং কোচ। তবে অন্যদের তুলনায় পুরোনো সতীর্থের প্রতি তাঁর যত্নটা বেড়ে যাচ্ছে তাসকিন সবে চোট থেকে ফেরায়। সঙ্গে আধুনিক ক্রিকেটের রানের দাবি ব্যাটিং অনুশীলনে নেটে ব্যস্ত রাখছে প্রধান কোচ ফিল সিমন্স এবং সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাহউদ্দীনকেও।

ওয়ানডেতে ৩০০ রানও এখন অনিরাপদ। আগে ব্যাটিং হোক বা পরে; সব দলকে অন্তত ৩৫০-এ চোখ রেখেই ব্যাটিং করতে হয়। ব্যাট হাতে টেলএন্ডারদের কাছেও প্রত্যাশা থাকে দ্রুত কিছু রান তুলে দেওয়ার। ব্যাটিং অনুশীলনে তাসকিনের বাড়তি মনোযোগের কারণ হতে পারে সেটি। পরে তো বললেনও, ‘ক্লোজ ম্যাচে টেলএন্ডারদের ভূমিকা থাকবেই। ব্যাটিংয়ে কিছুটা যদি অবদান রাখা যায়, দলে সেটাও অনেক। বোলারদের দু-তিনটা বাউন্ডারিও অনেক সময় বড় ভূমিকা রাখে।’

বোঝা গেল, সুযোগ পেলে ফেরার উপলক্ষটাকে সবভাবেই রাঙাতে চান তাসকিন।