কতভাবে আউট হন একজন ব্যাটসম্যান, যে আউটের ঘটনা আছে একবারই

আঙুল তুলে আউটের সংকেত দিচ্ছেন আম্পায়ার—ক্রিকেট মাঠের অন্যতম পরিচিত দৃশ্য। ফিল্ডিং দল কিংবা তাঁদের সমর্থকদের জন্য সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য এটি। আম্পায়ারের সংকেতের পর মন খারাপ নিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয় ব্যাটসম্যানকে। ১০ জন ফিরলেই যে শেষ হয় ইনিংস।

কখনো কি আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে, ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যান কতভাবে আউট হতে পারেন? ক্রিকেটের আইনকানুন তৈরি করে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব বা এমসিসি। তাদের বইয়ে সব মিলিয়ে ১০ ধরনের আউটের কথা উল্লেখ আছে—বোল্ড, ক্যাচ, এলবিডব্লু (লেগ বিফোর উইকেট), রানআউট, স্টাম্পড, রিটায়ার্ড আউট, হিট দ্য বল টোয়াইস, হিট উইকেট, অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড ও টাইমড আউট।

ক্রিকেটের সঙ্গে টুকটাক পরিচিতি থাকলে আপনার কিছু আউট সম্পর্কে জানা থাকার কথা—যেমন বোলার যদি বল করে ব্যাটসম্যানের স্টাম্প ভেঙে দিতে পারেন, তাহলে বোল্ড, আকাশে তুলে মারলে বল মাটিতে পড়ার আগে বাউন্ডারির ভেতরে থাকা ফিল্ডার ধরে ফেললে ক্যাচ, রান নেওয়ার সময় ক্রিজের ভেতরে ব্যাটসম্যান বা তাঁর ব্যাট প্রবেশ করার আগেই ফিল্ডারদের কেউ স্টাম্প ভেঙে দিলে রানআউট, ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গেলে যদি উইকেটরক্ষক স্টাম্প ভেঙে দেন, তাহলে স্টাম্পড।

তবে এসবের বাইরে আরও কিছু আউটও ক্রিকেটে আছে, যেগুলো সচরাচর দেখা যায় না। আমাদের আলোচনা ওসব আউট নিয়েই….

টাইমড আউট

এই আউটের সঙ্গে অনেকেরই প্রথম পরিচয় ২০২৩ বিশ্বকাপের সময়। তা–ও বাংলাদেশের সৌজন্যে। ঘটনাটি কি মনে পড়েছে? বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান আবেদন করার পর আউট হয়ে গিয়েছিলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। সেই ঝাঁজ পরে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচগুলোতে ছিল, অনেকে সমালোচনায়ও মুখর ছিলেন সাকিবদের। কিন্তু ক্রিকেটের আইন মেনেই আউটটি হয়েছিল।

২০২৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে টাইমড আউট হয়েছিলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস

এমসিসির আইনের ৪০ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যাওয়ার পর ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যে নতুন ব্যাটসম্যানকে উইকেটে এসে বল খেলার জন্য তৈরি থাকতে হবে। সময়টা নির্ভর করে কোন সংস্করণে খেলা হচ্ছে তার ওপর। যদি তা না হয়, তাহলে ফিল্ডিং দলের আবেদনের ভিত্তিতে আম্পায়াররা উইকেটে আসা ব্যাটসম্যানকে আউট দিতে পারবেন। এমনকি বেশি দেরি হলে আম্পায়াররা ফিল্ডিং করা দলকে জয়ী হিসেবেও ঘোষণা করতে পারেন।

ক্রিকেটের ১৪৮ বছরের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাথুসই টাইমড আউট হওয়া একমাত্র ব্যাটসম্যান। টেস্ট বা টি-টোয়েন্টিতে এ ঘটনা কখনোই ঘটেনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও টাইমড আউট হয়েছেন মাত্র ৬ জন ব্যাটসম্যান।

অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড

যদি কোনো ব্যাটসম্যান তাঁর কথায় বা কাজে, ফিল্ডারদের কাউকে বাধা দেন বা বিভ্রান্ত করেন—তখন তাঁকে ফিল্ডিং দলের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড আউট দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডের লেন হটন ১৯৫১ সালে প্রথমবারের মতো এমন আউট হন। সেটিই এখনো একমাত্র আউটের ঘটনা।

পরে ‘হ্যান্ডলড দ্য বল’ আউটকেও এই আউটের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়। হ্যান্ডলড দ্য বলের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যাটসম্যান যদি ইনজুরি থেকে বাঁচা অথবা ফিল্ডিং দলের অনুমতি ছাড়া বল হাত দিয়ে ধরেন, তখন তিনি আউট হয়ে যান। তবে এটিও এখন ‘অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড হিসেবেই ধরা হয়।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মিরপুরে হাত দিয়ে বল ধরে আউট হন মুশফিকুর রহিম

এমন আউটের ঘটনাও খুব বেশি নয়—টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৬ জন ব্যাটসম্যান হ্যান্ডলড দ্য বল করার কারণে আউট হয়েছেন। সর্বশেষ ঘটনাটি বাংলাদেশের মুশফিকুর রহিমের। ২০২৩ সালে মিরপুরে তিনি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাত দিয়ে বল ধরে আউট হন। এই আউট হওয়া বাকি ৫ ব্যাটসম্যান হলেন—দক্ষিণ আফ্রিকার উইলিয়াম রাসেল এন্ডিন, অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু হিলড্রিচ, পাকিস্তানের মহসিন খান, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ডেসমন্ড হেইন্স, ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ, অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ ওয়াহ ও ইংল্যান্ডের মাইকেল ভন।

হিট উইকেট

এমন আউটের সঙ্গে পরিচয় থাকার কথা অনেকেরই। কোনো ব্যাটসম্যান যদি শট খেলার সময় অথবা প্রথম রান নিতে যাওয়ার শুরুতে নিজের শরীর বা ব্যাট দিয়ে স্টাম্প ভেঙে ফেলেন, তখন তিনি হিট উইকেট আউট হন। ব্যাটসম্যানের কোনো সরঞ্জামের মাধ্যমেও যদি স্টাম্প ভাঙে, সে ক্ষেত্রেও এই আউট ঘোষণা হয়। তবে ব্যাটসম্যানের দিকে যদি বল থ্রো করা হয় অথবা রানআউট থেকে বাঁচতে ব্যাটসম্যান স্টাম্প ভাঙেন, সে ক্ষেত্রে এই আউট হবে না।

হিট দ্য উইকেটের ঘটনা যদিও ক্রিকেটে কম নয়—সব মিলিয়ে টেস্টে ১৬৪, ওয়ানডেতে ৭৭ আর টি-টোয়েন্টিতে ৩৫ বার এমন ঘটনা ঘটে। নারী ক্রিকেটেও এমন আউটের ঘটনা আছে ২৬ বার।

২০১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হিট উইকেটে আউট হয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিল

হিট দ্য বল টোয়াইস

যদি কোনো ব্যাটসম্যান ইচ্ছাকৃতভাবে বলে দুইবার হিট করেন, তখন তিনি হিট দ্য বল টোয়াইস আউট হন। সেটি যে ব্যাট দিয়েই করতে হবে, এমনও নয়, শরীরের দিয়েও বলে দুইবার আঘাত করা যাবে না। এমন কাজ ব্যাটসম্যান করতে পারবেন কেবল যদি বল স্টাম্পের দিকে চলে যায়, তখন।

এমন আউটের ঘটনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একবারই ঘটেছে। ২০২৩ সালের আগস্টে রোমানিয়ার বিপক্ষে মাল্টার ওপেনার ফানিয়ান মুগল এই আউট হয়েছিলেন। শুরুতে শট খেলতে যান তিনি, পরে রোমানিয়ার উইকেটকিপার বল ধরতে এলে আবার ব্যাট দিয়ে বল আঘাত করে আউট হন মুগল।

রিটায়ার্ড আউট

৪ আগস্ট পাকিস্তানের বিপক্ষে রিটায়ার্ড আউট হন ওয়েস্ট ইন্ডিজের রোস্টন চেজ

ব্যাটসম্যান যদি চোট ছাড়া অন্য কারণে আম্পায়ারের অনুমতি ছাড়া মাঠ ছাড়তে চান, তখন তাঁকে রিটায়ার্ড ঘোষণা করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ অধিনায়কের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ইনিংস আবার শুরু করার সুযোগ থাকে। সেটি যদি তিনি না করতে পারেন, তাহলে তাঁকে রিটায়ার্ড আউট হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

টেস্ট ক্রিকেটে এ ঘটনা ঘটেছে দুবার। সেটিও একই ইনিংস বাংলাদেশের বিপক্ষেই—২০০১ সালে ২০১ রান করা মারভান আতাপাত্তু ও ১৫০ রান করা মাহেলা জয়াবর্ধানে রিটায়ার্ড আউট হন। মূলত পরের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং অনুশীলনের সুযোগ করে দিতে আউট হয়ে যান তাঁরা। তবে সেটি অখেলোয়াড়সুলভ হিসেবে বিবেচনা করে তখন সমালোচনা হয়।

এমন ঘটনা ঘটতে পারত আরও একটি—১৯৮৩ সালে অসুস্থ মেয়েকে দেখতে ভারতের বিপক্ষে ১৫৪ রানে ব্যাট করার সময় উইকেট ছেড়ে চলে যান গর্ডন গ্রিনিজ। দুই দিন পর তাঁর অসুস্থ মেয়ে মারা যান। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে গ্রিনিজ থেকে যান রিটায়ার্ড নট আউট।