ক্রিকেট দলীয় খেলা। তবে অন্য যেকোনো দলীয় খেলার চেয়ে এ খেলাতেই ব্যক্তিগত রেকর্ড নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়। কে বেশি রান করলেন, কে বেশি উইকেট নিলেন, কার কয়টা সেঞ্চুরি—আরও কত ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান নিয়েই না গবেষণা। অনেকে তো রেকর্ড-পরিসংখ্যানের ভারে দলের চেয়েও বড় হয়ে ওঠেন।
ক্রিকেট ইতিহাসে এমন কিছু খেলোয়াড় আছেন, দলে যাঁদের অবদান পরিসংখ্যানে চোখ বোলালেই স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। মুত্তিয়া মুরালিধরনই যেমন। নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের শুরুতে ভালো ব্যাটসম্যানের দেখা কম পাননি। তবে মুরালি তাঁর স্পিন-জাদু নিয়ে হাজির হওয়ার পরই মূলত বদলে গেছে শ্রীলঙ্কার ভাগ্য। লঙ্কানরা নিয়মিত টেস্ট জিততে শুরু করে তাঁর সময় থেকেই। লঙ্কানদের বদলে যাওয়ায় মুরালির কতটা অবদান, প্রমাণ আছে পরিসংখ্যানেই। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হিসেবে অবসরে যাওয়া মুরালি নিজের খেলা ম্যাচে দলের ৩৮.৬৪ শতাংশ উইকেট নিয়েছেন। উইকেট নেওয়ার শতকরা এই হিসাবেও মুরালিই ইতিহাসের সেরা বোলার। হিসাবটা অবশ্য যাঁরা কমপক্ষে ২৫টি টেস্ট খেলেছেন তাঁদের নিয়েই করা। সেই হিসাবের সেরা দশে আছেন বাংলাদেশের এক বোলারও—মোহাম্মদ রফিক। তাঁর সময়ে টেস্টে বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ (৩০.৪৮ শতাংশ) উইকেটই পেয়েছিলেন এই বাঁহাতি স্পিনার।
১৯৯২ সালে মুত্তিয়া মুরালিধরনের অভিষেকের আগে খেলা ৩৯ টেস্টে মাত্র দুবারই জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছিল শ্রীলঙ্কা। ১৮ বছর পর যখন ৮০০ উইকেট নিয়ে ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হিসেবে টেস্ট ক্রিকেট ছাড়লেন মুরালি, শ্রীলঙ্কায় জয় ৫৪টি। মুরালি শ্রীলঙ্কার হয়ে টেস্ট খেলেছেন ১৩২টি। যার অর্থ, তাঁর সময়ে শ্রীলঙ্কা প্রতি আড়াই টেস্টেই একটি জয় পেয়েছে। শ্রীলঙ্কা ছাড়াও বিশ্ব একাদশের হয়ে একটি টেস্ট খেলেন এই অফ স্পিনার। টেস্ট ক্যারিয়ারে ২২ বার ১০ উইকেট পেয়েছেন মুরালি, এর ১৮টিতেই শ্রীলঙ্কা জিতেছে।
১৯১৩-১৪ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে চার টেস্টেই ৪৯ উইকেট নিয়েছিলেন ইংলিশ কিংবদন্তি। যা এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড হিসেবে টিকে আছে এখনো। সেটি ছিল আবার ২৭ টেস্টেই ১৮৯ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করা এই মিডিয়াম পেসারের ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ। দুই দিকেই সুইং করাতে ওস্তাদ ছিলেন বার্নস। লেগ ব্রেক ও অফ ব্রেক করেও ব্যাটসম্যানকে বিপদে ফেলা বার্নস ১৯১১-১২ মৌসুমে ৩৪ উইকেট নিয়ে অ্যাশেজ জিতিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে।
১৭ বছরের ক্যারিয়ারে নিউজিল্যান্ডের বোলিং ভার একাই টেনেছেন সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। টেস্টে ৪০০ উইকেট নেওয়া ইতিহাসের প্রথম বোলার ১৯৯০ সালে ৩৯ বছর বয়সে অবসর নেন। আশির দশকে ইয়ান বোথাম, ইমরান খান ও কপিল দেবের সঙ্গে সময়ের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে একই নিশ্বাসে উচ্চারিত হতো হ্যাডলির নাম। ৮৬ টেস্টে ৪৩১ উইকেট নেওয়া হ্যাডলির রেকর্ড ভাঙেন ভারতের কপিল দেব।
ক্রিকেট খেলতেই জন্মভূমি নিউজিল্যান্ড ছেড়ে প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন ক্ল্যারি গ্রিমেট। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ক্রিকেট বিশ্বকে অস্ট্রেলিয়ার উপহার দেওয়া অন্যতম সেরা স্পিনার গ্রিমেট। ৩৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে ২১৬ উইকেট নেওয়া গ্রিমেটের সময় ২০টি টেস্ট জেতে অস্ট্রেলিয়া।
যুগ যুগ ধরে বিখ্যাত সব বোলার উপহার দেওয়া পাকিস্তানের প্রথম তারকা বোলার ফজল মাহমুদ। পাকিস্তান টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর শুরুর দিকে বোলিং ভারটা একাই সামলেছেন এই পেসার। টেস্টে দলের এক-তৃতীয়াংশ উইকেট (৩৩.৯০ শতাংশ) শিকার করেন তিনি। বলা যায়, পাকিস্তানের বোলিং ঐতিহ্যের বীজ বপন করেছিলেন এই কিংবদন্তি।
ক্ল্যারি গ্রিমেট অবসরে যাওয়ার আগেই আরেক লেগ স্পিন কিংবদন্তিকে পেয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। ১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে ২৭ টেস্টের ক্যারিয়ারে ১৪৪ উইকেট পেয়েছেন ও’রিলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে তাঁর ক্যারিয়ারটা নিশ্চিত আরও সমৃদ্ধ হতো।
তাঁর সময়ের সেরা লেগ স্পিনার। ১৯৫১ সালে অভিষেকের পর ভারতীয় এই বোলার ১০ বছরের ক্যারিয়ারে ৩৬ টেস্টে নিয়েছেন ১৪৯ উইকেট। তাঁর গুগলি পড়তে পেরেছেন খুব অল্প কিছু ব্যাটসম্যানই। ভারতের প্রথম স্পিন তারকা ঘরের চেয়ে দেশের বাইরেই বেশি ভালো করেছেন। ঘরের মাঠে ২১ টেস্টে ৩০.৩৪ গড়ে ৮৪ উইকেট নেওয়া গুপ্তে দেশের বাইরে ১৫ টেস্টে ৬৫ উইকেট নিয়েছেন ২৮.৫২ গড়ে।
বয়স ৩০ পেরোনোর পরই পাকিস্তানের জার্সিতে প্রথম খেলার সুযোগ মেলে এই অফ স্পিনারের। হারানো সময়টা পুষিয়ে নিতেই যেন একের পর এক উইকেট ঝুলিতে পুরতে শুরু করেন সাঈদ আজমল। ২০০৯ থেকে ২০১৪, এই পাঁচ বছরে ৩৫ টেস্টে ১৭৮ উইকেট পেয়ে যান। ২০১৪ সালে অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের দায়ে নিষিদ্ধ হওয়ার পর আর ফিরে আসতে পারেননি আজমল।
সাঈদ আজমল নিষিদ্ধ হওয়ার পরেই পাকিস্তান দলে সুযোগ মেলে ২০০২ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা এই লেগ স্পিনারের। সুযোগটা কাজে লাগাতে দেরি করেননি ইয়াসির শাহ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক সিরিজে ১৭ গড়ে ১২ উইকেট নেওয়া ইয়াসির চোখ কাড়েন সবার। প্রয়াত অস্ট্রেলীয় লেগ স্পিনিং কিংবদন্তি শেন ওয়ার্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, দুই শতাধিক উইকেট পাবেন ইয়াসির। ৪৮ টেস্টে ২৪৪ উইকেট নিয়েছেন ২০২২ সালে সর্বশেষ টেস্ট খেলা এই পাকিস্তানি বোলার। ৩৩ টেস্টেই ২০০ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়া ইয়াসিরই এই মাইলফলকে দ্রুততম।
বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে প্রবেশ করার পর দলে কার্যকর কোনো বোলার বলতে মোহাম্মদ রফিকই ছিলেন। ৩৩ টেস্টের ক্যারিয়ারে ঠিক ১০০ উইকেট পাওয়া রফিক ছিলেন এমন ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট মাশরাফি বিন মুর্তজার (৪২)। আট বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে সাতবার ৫ উইকেট নেওয়া রফিক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়েও। চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৪১.৪ ওভার বোলিং করে ৬৫ রানে ৫ উইকেট পেয়েছিলেন।