Thank you for trying Sticky AMP!!

মরণনেশা এড়িয়ে ফুটবলে মাঠ মাতাচ্ছে সাইদুর

গল্পটা মাদকের অন্ধকার থেকে ফুটবলে আলো ছড়ানোর

সাইদুর রহমানের ফুটবলার হওয়ার গল্প যেন সিনেমার কাহিনিকেও হার মানায়! যশোরের বেনাপোল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী গ্রামের নাম ভবারবেড়। গ্রামটি মাদক, চোরাচালান আর সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। যে গ্রামে মরণনেশা ইয়াবা গ্রাস করে নিয়েছে বেশির ভাগ তরুণকে।

বেচাকেনা ও পাচারের জন্য যে গ্রামে মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে এলাকার শিশু-কিশোরদের। ভয়ংকর মরণনেশা এড়িয়ে সেই গ্রাম থেকে উঠে এসে ঢাকার ফুটবল মাঠ মাতাচ্ছে সাইদুর রহমান।

Also Read: মা হারানোর শোক নিয়ে মাঠে নেমে কলিনদ্রেস যা করলেন

পল্টন আউটার মাঠে আজ শুরু হয়েছে জাতীয় স্কুল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্ব। উদ্বোধনী ম্যাচে বেনাপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩-১ গোলে হারিয়েছে হবিগঞ্জ আলী ইদ্রিস হাইস্কুলকে। বেনাপোলের স্কুলের আজকের জয়ে বড় ভূমিকা সাইদুরের। পুরোটা সময় দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দেওয়া সাইদুর নিজে তো জোড়া গোল করেছেই, অন্যটি করিয়েছে ফাহিম ফয়সালকে দিয়ে। আলী ইদ্রিস হাইস্কুলের একমাত্র গোলটি ইমরান মিয়ার।

মাদকের চেয়ে ফুটবলের শক্তি যে বেশি, তা দেখিয়ে দিয়েছেন বেনাপোল স্কুলের কোচ সাব্বির আহমেদ। প্রাথমিক পর্ব পেরিয়ে ঢাকায় খেলতে এসেছে সারা দেশের আট অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন আটটি স্কুল। বেনাপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয় সেগুলোরই একটি। এই স্কুলের ফুটবলারদের মধ্যে সাতজনই মাদকের অভয়ারণ্য ভবারবেড়ের। সাইদুরের সঙ্গে খেলতে ঢাকায় এসেছে ভবারবেড়ের রাতিন রেজা, নাফিদুল হাসান, সানজিদ গাইন, হারুনুর রশিদ, সৌরভ হোসেন ও অনিক হোসেন।

জোড়া গোল পাওয়ার পর সাইদুরের উচ্ছ্বাস

ম্যাচ শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায় পল্টন মাঠে দাঁড়িয়ে ভবারবেড় গ্রামের ভয়ংকর মাদক সমস্যার বর্ণনা দিচ্ছিলেন কোচ সাব্বির আহমেদ, ‘যখন এই গ্রামে প্রথম গেলাম, তখন সেখানকার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ইয়াবাসহ নানা রকমের মাদকের ব্যবসা করত। এখনো অনেকে এই ব্যবসায় জড়িত। আমার এই দলের দুই ফুটবলারের মা–বাবা মাদক ব্যবসায়ী। আমি প্রতিদিন অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করি। ছেলেদের মাদক থেকে দূরে রাখতে ফুটবল মাঠে নিয়ে আসি।’

Also Read: সাফল্য আছে, আছে কিছু প্রশ্নও

Also Read: জয় করেছেন জয়া

সাবেক ফুটবলার সাব্বিরের পরিবারের দুই সদস্য মাদকের ভয়াল থাবার শিকার, ‘আমার দুই ভাই প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র ছিল। ওরাও নেশা করে নষ্ট হয়ে গেছে। আমার পরিবারকে দেখেছি, মাদকের কারণে কীভাবে তছনছ হয়ে গেছে। একসময় মনে হলো, ফুটবলই পারে মাদক থেকে ছেলেদের দূরে রাখতে। এরপর যখন বেনাপোলের আলহাজ নূর ইসলাম একাডেমিতে কোচের দায়িত্ব পেলাম, মনে হলো এমন কাজই খুঁজছিলাম। খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়া ছেলেদের ফুটবলে আনতে পেরেই খুশি আমি।’
২০১৬ সালে যশোর শহর থেকে নূর ইসলাম একাডেমিতে কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেন সাব্বির। বেনাপোলের মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের বাবার নামে গড়া এই একাডেমির ফুটবলাররাই খেলছেন এবারের জাতীয় স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপে।

শুরুতে কাজটা মোটেও সহজ ছিল না সাব্বিরের জন্য। যে ছেলেরা চোরাচালান আর মাদকের ব্যবসা করত, অভিভাবকের বুঝিয়ে তাদের খেলার মাঠে পাঠাতে অনুরোধ করতেন সাব্বির। এ জন্য অনেক হুমকিও পেতে হয়েছে তাঁকে, ‘অনেকে এসে বলত, “স্যার, আপনি যশোরের ছেলে যশোরে চলে যান। এখানে থাকবেন না।” আমি কোনো ভয় পাইনি। আজ যখন আমার ছেলেরা বিভিন্ন একাডেমি আর টুর্নামেন্টে খেলে, এটা দেখে খুব ভালো লাগে।’

Also Read: মালয়েশিয়ার সঙ্গে আজ জিততে পারল না মেয়েরা

কোচ সাব্বিরের সঙ্গে সাইদুর

অবশ্য এই গ্রামের উজ্জ্বল ব্যতিক্রম সাইদুর। শহরের বেনাপোল রেলস্টেশনের পাশের বাজারের সবজির দোকানের কর্মচারীর কাজ করত সাইদুর। এলাকার সচেতন অভিভাবকদের একজন সাইদুরের বাবা লাল মিয়া। তিনি চাইতেন, ছেলে যেন পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়। কিন্তু সাইদুরকে ফুটবলের নেশায় ঢুকিয়ে দেন কোচ সাব্বির। এ জন্য সাইদুরের বোন মামলা করার হুমকিও দেন কোচকে, ‘রাহুল (সাইদুর রহমানের ডাক নাম) সবজির দোকানে কাজ করে প্রতিদিন ৫০ টাকা পেত। কিন্তু ফুটবল খেললে সেই আয় বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্য ওর বোন আমার নামে মামলা করতে চেয়েছিল। ওকে বাড়িতে আটকে রেখেছিল অনেক দিন। পরে অনেক কষ্টে ওদের বুঝিয়ে আবার এই ছেলেকে ফুটবলে নিয়ে আসি।’

Also Read: ২ হাজার ৮২ দিন পর শেখ জামাল ক্লাবকে হারাল মোহামেডান

চোখের সামনে শৈশবের বন্ধুদের নষ্ট হয়ে যেতে দেখেছে সাইদুর, ‘আমাদের এলাকার সবচেয়ে খারাপ জায়গায় থাকি আমি। ঘুম থেকে উঠে অনেক কিছু দেখতে হয়। ওরা যেসব ব্যবসা করে, এটাকে আমাদের এলাকায় ব্ল্যাক বলে। বন্ধুদের যাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম, তাদের অনেকে এখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে, নেশা করছে। অনেকে মাদক ব্যবসা করে। আমি ছাড়া গ্রামের অন্য চার-পাঁচটা পরিবার এসবের মধ্যে নেই। তবে ওদের দেখে খুব খারাপ লাগে।’

বল পায়ে সাইদুরের টার্ন। পুরো সময় দুর্দান্ত ফুটবল দেখা গেছে তাঁর পায়ে

এই গ্রামে জন্মেও অনেকে ভবারবেড় গ্রামের পরিচয় দিতে চায় না। কিন্তু সাইদুর ফুটবল দিয়ে এই গ্রামের হারানো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে চায়, ‘এলাকায় এমন একটা অবস্থা হয়েছে যে নিজের বাড়ি ভবারবেড়, সেই পরিচয় দিতেও লজ্জা করে। জায়গাটা খারাপ বলে অনেকে তাদের পরিচয় দিতে চায় না। কিন্তু আমরা এমন কিছু করতে চাই যেন তারা গর্ব করে বলতে পারে, “আমার বাড়ি ভবারবেড় রাহুলের বাড়ির পাশে।”’

Also Read: মালয়েশিয়ার সঙ্গে আজ জিততে পারল না মেয়েরা