বাংলাদেশের ফুটবলে ইংলিশ খেলোয়াড়

টাইলস মিস্ত্রি থেকে পেশাদার ফুটবলার

ঢাকার মাঠে আবাহনীর ইংলিশ স্ট্রাইকার লি টাক l প্রথম আলো
ঢাকার মাঠে আবাহনীর ইংলিশ স্ট্রাইকার লি টাক l প্রথম আলো

হোটেল রুমের পর্দা সরিয়ে যখন সামনে তাকান, তাঁর মনে পড়ে যায় বাড়ির কথা। কত দিন বাড়ির বাইরে! দেখা হয় না মা-বাবা, ভাইয়ের সঙ্গে। হয়তো মা এখনো তাকিয়ে থাকেন পথের দিকে, এই বুঝি খোকা এল! বয়স যদিও ২৮ হয়ে গেছে, কিন্তু মায়ের কাছে সে তো এখনো ছোট্ট খোকাই। মায়ের হাতে খাওয়া, শৈশবে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের মাঠে মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো—কত কত স্মৃতি দোল খায় লি টাকের মনে!
আনমনে ভাবেন মাত্র ১১ বছর বয়সে জন্মভূমি হাডার্সফিল্ডের ডিভিশন-টুর দল হেলিফ্যাক্সের একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার কথা। ছয় বছর একাডেমিতে কাটিয়ে প্রথম আনুষ্ঠানিক চুক্তি ওই হেলিফ্যাক্সের সঙ্গেই। এলাকারই ছেলে ক্যামেরন জেরমের (বর্তমান দল নরউইচ সিটি) সঙ্গে তখন হেলিফ্যাক্সের দলে খেলার সুযোগ হয়েছে।
হেলিফ্যাক্স থেকে পরের বছরই লির ঠিকানা হলো ফার্সলে সেলটিক। ওখানেও সুবিধা করতে না পেরে এক বছর পরই ২০১০ সালে নোঙর ফেলেন থাইল্যান্ডে। এখানে তিনি রাজা। ছয় বছরে নাম, যশ, অর্থ সবই জুটেছে। ২০১২ সালে ব্যাংকক এফসির হয়ে ৩২ ম্যাচে ২৩ গোল করে লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা। পরের বছরও ২৩ গোল, মাত্র এক গোলের জন্য সর্বোচ্চ গোলদাতা নন! এভাবেই থাইল্যান্ডে ফুটবলের প্রিয় মুখ হয়ে উঠলেন। বড় বড় প্রতিবেদন হলো ব্যাংককের কাগজে। দারুণ সব গোলের ভিডিও চিত্র ছড়াল ইউটিউবে।

এসব এখন লির কাছে ভালো লাগার মন্ত্র, উজ্জীবনী শক্তি। থাইল্যান্ডে সর্বশেষ নাকন রাতসামিসা ক্লাবের হয়ে খেলার সময়ই শেখ জামালের রাডারে ধরা পড়েন। কিন্তু চুক্তি থাকায় ঢাকায় আসতে পারেননি। তবে সাড়ে চার মাস পর আবাহনীর কল্যাণে তাঁর ঠিকানা হলো ঢাকা। মৌসুমের প্রথম টুর্নামেন্টে স্বাধীনতা কাপে রানার্সআপ ও ফেডারেশন কাপে আবাহনীকে চ্যাম্পিয়ন করতে লির আছে বড় অবদান।

ব্যাংককে খেলেছেন ৯ নম্বর জার্সি গায়ে, আবাহনীতেও তা-ই। তবে এখানে খেলেন অনেকটা নিচে নেমে। আকাশি-সাদা জার্সিতে গোল আছে ছয়টি। সবচেয়ে মূল্যবান গোলটি আরামবাগের বিপক্ষে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে, জয়সূচক একমাত্র গোল। সব মিলিয়ে আবাহনী পর্ব নিয়ে তাঁর নিজের মূল্যায়ন, ‘সো ফার, সো গুড।’

প্রিমিয়ার লিগ খেলতে দলের সঙ্গে রয়েছেন চট্টগ্রামে। বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো পেশাদার ইংলিশ ফুটবলার খেলছেন, এটাই তাঁকে আলাদা করে দিচ্ছে। লির ফুটবল জীবন, বেড়ে ওঠার গল্পটাও তাঁকে চেনায় অন্যভাবে। হোটেল রুমে লম্বা আড্ডায় লি গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেন, যোগ দেন পাশে বসা জীবনসঙ্গিনী জর্জা। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকলেও ব্যাংকক থেকেই লির নিত্যসঙ্গী মাত্রই শিক্ষাজীবনের ইতি টানা ইংলিশ তরুণী।

ছোটবেলায় অবশ্য আর দশটি ছেলের মতো বাবাই ছিলেন লির সার্বক্ষণিক সঙ্গী। বাবা কাঠমিস্ত্রি, ভাই ইলেকট্রিশিয়ান। আর লি ছিলেন টাইলস মিস্ত্রি। ‘পেশাদার ফুটলার না হলে হয়তো বা টাইলস মিস্ত্রির কাজটাই করে যেতাম (ফ্লোরের টাইলস দেখিয়ে বলছিলেন)’—অকপটে বলে যান লি।

বাড়ির কাছাকাছি ১১০-১২০ কিলোমিটারের মধ্যে ওল্ড ট্রাফোর্ড, লিডস, বোল্টন, লিভারপুল। তবে মাত্র ১২ বছরের ছেলেকে ৫০ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে বাবা নিয়ে গেলেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে, ইউনাইটেডের ম্যাচ দেখাতে। লি পেছনে তাকান, ‘বিশাল স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখলাম জনসমুদ্র। চারদিকে তাকিয়ে আমি তো অবাক।’

বংশানুক্রমিকভাকেই পরিবার ইউনাইটেডের সমর্থক। তবে ইউনাইটেডের খেলা দেখাটা সহজ ছিল না লির কাছে, ‘ওরে বাপ রে, টিকিটের যা দাম। তা ছাড়া টিকিট পাওয়াও যায় না।’ তবু চেষ্টা করতেন ইউনাইটেডের খেলা দেখার। রোনালদোকে দেখতে ছুটতেন ওল্ড ট্রাফোর্ডে। তবে ইউনাইটেডের কেউ নন, তাঁর ছোটবেলার হিরো লিভারপুলের স্টিফেন জেরার্ড। এখন ইনিয়েস্তা-মেসিদেরই বেশি ভক্ত।

মজার ব্যাপার, জর্জার পরিবারও ইউনাইটেডের পাঁড় সমর্থক। দুজনের বাসা গাড়িতে পাঁচ মিনিটের রাস্তা। ছোট থেকেই জানাশোনা। সেই সুবাদে মন দেওয়া-নেওয়া। এখন তো জর্জা ব্যাংকক, ঢাকা, চট্টগ্রামের মাঠে বসে উৎসাহ দেন লিকে। পারফরম্যান্স খারাপ হলে লি রাতে মন খারাপ করে পায়চারি করেন। ‘আমি তখন ওকে বলি ভালো-মন্দ হবেই। তুমি অত টেনশন কর কেন’—হেসে বলছিলেন জর্জা।

তিন বছর আগে লির জন্মদিনে জর্জা উপহার দিলেন বার্সেলোনা-ভিয়ারিয়াল লা লিগা ম্যাচের টিকিট! বাড়ি থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার বিমানযাত্রায় ওই ম্যাচ দেখাটা ছিল তাঁদের অনন্য অভিজ্ঞতা। তবে বাড়িতে লি এবং জর্জার মায়ের বিশেষ পছন্দ টেনিস। দুই বেয়াইন নাকি চলে যান টেনিস দেখতে। কদিন আগে উইম্বলডন দেখতে যেমন লন্ডন ছোটেন জর্জার মা।

ব্যাংককের স্মৃতিটা লির কাছে সততই আনন্দদায়ী। ২০-২৫ কিলোমিটার দূরের অনুশীলন মাঠে যেতেন সাইকেল চালিয়ে। ওখানে মোটরসাইকেল কিনেছেন, কিনেছেন গাড়িও। বাংলাদেশে আসার সময় বিক্রি করে এসেছেন গাড়িটা। ফুটবল খেলে পাওয়া রোজগারে ইয়র্কশায়ারে কিনেছেন দুটি ফ্ল্যাট বাড়ি।

জীবনে সফলতা এলে মানুষের মধ্যে অহংকার থাকে না। লির মধ্যেও এতটুকু অহংকার নেই। পরিশ্রম আর নিয়মানুবর্তিতাই তাঁর সাফল্যের রহস্য। বাংলাদেশে যানজটটা একটু খারাপ লাগে তাঁর কাছে, তবে বাকি সবকিছুতেই নাকি মানিয়ে দিয়েছেন। মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকলে কি আর টাইলস মিস্ত্রি থেকে সংগ্রাম করে পেশাদার ফুটবলার হতে পারতেন!