
নেইমারের বয়স এখন ২৬। শিরোপা জয়ের এটাই হয়তো সবচেয়ে ভালো সময়। কাতার বিশ্বকাপে বয়স গিয়ে ঠেকবে ত্রিশে। ত্রিশের কোঠায় পা দেওয়া নেইমার পারবেন তো হেক্সা জয়ের স্বপ্ন ছুঁতে?
শেষ বাঁশি বাজার সময় কী ভাবছিলেন নেইমার? ব্রাজিলে হলো না, রাশিয়া থেকেও ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। ত্রিশের কোটায় পা রেখে কাতারে কি হবে?
প্রশ্নবোধক চিহ্নটা চার বছর থাকবে কি না, তা তোলা রইল সময়ের হাতে। নেইমারের জিবের তলে আপাতত ব্রাজিলের তেতো স্বাদটা রাশিয়াতেও থেকে গেল। উপরি হিসেবে যোগ হলো সমর্থকদের দীর্ঘশ্বাস। কিছু কটূক্তি। খালি পড়ে গেলে খেলবে কখন! শেষ আট পর্যন্ত গোলের তুলনায় চুলের ছাঁটসংখ্যা বেশি। দুই বনাম তিন। হাতে কেউ বিদায়ের টিকিট ধরিয়ে দিলে মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন!
তবে সমর্থকদের চেয়ে সেই কষ্টটা নেইমারেরই বেশি। চার বছর আগে তাঁকে ঘিরে আশায় বুক বেঁধেছিল ব্রাজিল। ঘরের মাঠে খেলা, পারফরম্যান্স তাঁকে করতেই হবে। শেষ আট পর্যন্ত ৪ গোলই সেই প্রত্যাশার প্রতিদান। কিন্তু ব্রাজিলে এক বিশ্বকাপ ছাড়া বাকি সবই মিথ্যা!
রাশিয়ার নেইমারকে তাঁর সমর্থকেরা কতটুকু মনে রাখবে? পরিসংখ্যান বলছে, মনে রাখার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। বেলজিয়ামের মুখোমুখি হয়ে হওয়ার আগে নেইমার ছিলেন ডিফেন্ডারদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। সর্বোচ্চ ২৩ বার ফাউলের শিকার হওয়াই তার প্রমাণ। এই ম্যাচে আরও তিনবার। কিন্তু একেবারে অনুজ্জ্বল ছিলেন কি? তিনটি শট নিয়েছেন। এর মধ্যে বেলজিয়ামের পোস্টে ছিল একটি, যেটি থিবো কোর্তোয়া দেয়াল হয়ে না দাঁড়ালে ম্যাচটা হয়তো অতিরিক্ত সময়ে গড়াত। এই ম্যাচের পরিসংখ্যানে তাই নেইমারের ৪৫টি সফল পাস, যার মধ্যে ৩৫টিই অ্যাটাকিং থার্ডে এবং ৭টি সুযোগ সৃষ্টি শুধু সংখ্যা হয়েই থাকবে। আসল কাজটাই যে হয়নি! গোল পাননি।
তাতে আরও ক্ষুরধার হওয়ার সাধনাটা চার বছরের জন্য বাড়ল। যার শুরুটা হবে অনেক কঠিন। কারণ, রোমেলু লুকাকুরা ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ’ নিয়ে ফেরা মোটামুটি নিশ্চিত করলেও নেইমারের কাছে তা ‘ফ্রম রাশিয়া উইথ ট্রল’!
বিশ্বকাপের প্রায় চার মাস আগেই চোটে পড়েছিলেন। খেলতে পারবেন কি না, তা নিয়েই সন্দেহ ছিল। সেই সন্দেহ দূর করে নেইমার মাঠে ফিরলেও আসল নেইমারকে কতটুকু দেখা গেছে?
চোখ বুজলে গ্রুপ পর্বের প্রথম তিন ম্যাচে সেভাবে খোঁজ মেলে না। শেষ ষোলোয় দারুণ ইঙ্গিত ছিল। মেক্সিকোর বিপক্ষে সেই ম্যাচের পরই সমর্থকদের আশার পাল্লা ভারী হয়েছিল, নেইমার ফিরেছেন! কিন্তু সেই আশায় আজ গুড়েবালি।
তাই উপলব্ধিটাও সম্ভবত সত্যি, এই বিশ্বকাপের পাঁচ ম্যাচে নেইমার আসলে কখনোই নিজের সহজাত খেলাটা খেলতে পারেননি। সেটা পায়ের মারাত্মক সেই চোট, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের তার ওপর ক্রমাগত বেড়ে চলা ‘লোভ’, যা-ই বলুন না কেন, নেইমারকে সেভাবে দেখা গেল কোথায়!
অথচ এই রাশিয়াই ছিল নেইমারের সম্ভাব্য সেরা সুযোগ। ফুটবলে ২৬-২৭ বছর বয়সটা ক্যারিয়ারের সেরা সময়। মেসিকে দেখুন, ব্রাজিলে ফাইনাল খেলেছেন সাতাশে। নেইমার ছাব্বিশে বিদায় নিলেন শেষ আট থেকে।
ফুটবল একার খেলা না। কিন্তু এখানেই অজুহাত চলে না। রাশিয়ায় পা রাখার আগে থেকেই ফেবারিট ছিল ব্রাজিল। বলবেন, সে তো সব বিশ্বকাপেই! কিন্তু এবার সেটা ছিল দুর্দান্ত এক দলের জন্য। আলিসন, মার্সেলো, থিয়াগো সিলভা, কাসেমিরো, কুতিনহো, নেইমারদের মাঝে অনেকেই ২০০২ বিশ্বকাপের সেই পরিণত দলটার প্রতিচ্ছবি দেখেছেন। সেটা শুধুই কল্পনা নয়?
প্রায় দুই বছর ধরে দলটাকে গড়েছেন কোচ তিতে। বাছাই পর্বে তাঁর অধীনে লাতিন আমেরিকা থেকে ব্রাজিল চূড়ান্ত পর্বের টিকিট কেটেছে সবার আগে। বেলজিয়ামের মুখোমুখি হওয়ার আগে ২৬ ম্যাচে তিতের হার মাত্র দুটি। ২০ জয়, ২ ড্র। ৮ গোলর হজমের বিপরীতে ৫৩ গোল! এই ব্রাজিলকে সেরা না মেনে উপায় আছে? নেই বলেই নেইমারের আক্ষেপটা হয়তো বাড়বে। সেরা মানের দল ও কোচ থেকেও পারলেন না। কাতারে কী ঘটে কে জানে!
এই সংশয়টুকু অন্তত আজ জন্মাত না যদি কিংবদন্তিদের ভাগ্যটা নেইমার পেতেন। অন্তত এই ম্যাচে। সুযোগ তো সৃষ্টি করেছেন। সুযোগ যে একেবারে পাননি তা–ও নয়। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে দল বিপদে পড়লে ত্রাণকর্তা হয়ে উঠতে পারেননি। বড় মাপের খেলোয়াড়েরা এখান থেকেই কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। সেটা হোক ভাগ্য কিংবা ব্যক্তিগত দক্ষতায়।
চোট সেই ভাগ্যকে পরিণত করেছে খানিকটা দুর্ভাগ্যে। ডিফেন্ডারদের ক্রমাগত ফাউল তাঁর স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট করেছে। সুবিধা নিতে গিয়ে মাঠে বারবার পড়ে যাওয়াটা তো তাঁর এসব বোঝার ওপর ফুটবলপ্রেমীদের ঠাট্টার শাকের আঁটি। রাশিয়ায় নেইমারকে ঘিরে এটুকুই যা স্মৃতি! কাতারে কি নেইমার পারবেন এসব মুছে ফেলতে? ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ বলার সময় এখন নয়। কিন্তু নেইমারের বয়সটা সম্ভবত ‘না’ বলার পক্ষে। কে জানে!