Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রযুক্তির কাটাছেঁড়া: আর্জেন্টিনা-আইসল্যান্ড ম্যাচ

>কত কত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় এখন ফুটবল মাঠে। এসব প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। ফুটবল বিশ্লেষণে বিশ্বখ্যাত অপটার প্রযুক্তি-সাহায্য নিয়ে প্রথম আলো অনলাইন বিশ্বকাপের বড় ও আলোচিত ম্যাচগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবে। নতুন ধারাবাহিক ‘প্রযুক্তির চোখে’র প্রথম পর্ব। গতকালকের আর্জেন্টিনা-আইসল্যান্ড ম্যাচ নিয়ে লিখেছেন নিশাত আহমেদ

প্রথম দৃশ্য। ডি-বক্সের একটু বাইরে বল পায়ে মেসি। ঘিরে আছেন আইসল্যান্ডের তিন-চার-পাঁচজন খেলোয়াড়। একটু একটু করে ওয়ান-টু করে ডি-বক্সের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলেন মেসি। পাস দেওয়ার পর দেখলেন, ওয়ান-টু করার জন্য সতীর্থের যে অবস্থানে থাকা দরকার, সেখানে নেই তিনি। ফলাফল? আইসল্যান্ডের কোনো একজন খেলোয়াড় বলটা ক্লিয়ার করে বিপদমুক্ত করলেন দলকে।

দ্বিতীয় দৃশ্য। এবারও বল পায়ে মেসি। যথারীতি আইসল্যান্ডের ডি-বক্সের বাইরে। সামনে আগুয়ান কোনো এক সতীর্থকে থ্রু বল দেওয়ার চেষ্টা করলেন একবার। সতীর্থ চেয়ে চেয়ে দেখলেন মেসির পাস দেওয়া, সেই বল আর দখলে নিতে পারলেন না। বল চলে গেল মাঠের বাইরে; অথবা, বল চলে গেল সেই সতীর্থকে মার্ক করে দাঁড়ানো আইসল্যান্ডের ডিফেন্ডারের পায়ে।

এ রকম দৃশ্য বারবার দেখা গেছে। মেসি চেষ্টা করে যাচ্ছেন, সতীর্থদের কাছ থেকে ন্যূনতম সহযোগিতাটুকুও পাচ্ছেন না। কখনো কখনো সতীর্থরা মেসির বাধা হয়ে উঠছেন। এভার বানেগা মেসির অন টার্গেট শট পিঠ দিয়ে ঠেকাচ্ছেন, কী এক কুৎসিত দৃশ্য! মেসি পেনাল্টির চাপ নিতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু বাকি আর্জেন্টিনা দলটাই-বা কেমন খেলেছে? মেসিকে মেসির মতো খেলতে দিতে হলে সবাইকে ভালো খেলতে হবে, বিশ্বকাপের আগে মাচেরানোর বলা কথাটা সতীর্থরা কতটা শুনেছেন? মেসির ওপর চাপের বোঝা আরও কি সতীর্থরাই বাড়িয়ে দেননি?

চাপেই ভেঙে পড়েছিলেন বোধ হয় ভেতরে-ভেতরে। মেসির পেনাল্টিটা আটকে দেন আইসল্যান্ডের গোলরক্ষক হলডরসন। ছবি: রয়টার্স

কালকের ড্রয়ের পুরো দায় মেসিকে দেওয়া হচ্ছে। মেসি তা নিচ্ছেনও। কিন্তু আসলেই মেসি কতটা দায়ী?
কাল ৪-২-৩-১ ছকে আর্জেন্টিনা আক্রমণভাগে খেলেছেন আগুয়েরো, মেসি, ম্যাক্সিমিলিয়ান মেজা ও ডি মারিয়ারা। মেসির পাশাপাশি এই আগুয়েরোর মধ্যেই সেই জিগীষাটুকু দেখা গেছে, বাকিদের মধ্যে তা-ও না। ম্যাক্সিমিলিয়ান মেজার বিষয়টা তা-ও বোঝা যায়, আর্জেন্টাইন ক্লাব ইন্দিপেন্দিয়েন্তের এই উইঙ্গার দুই দিন আগে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের ধারেকাছেও ছিলেন না। বিশ্বকাপের আগে একটা প্রীতি ম্যাচের কিছু অংশ খেলেছিলেন এই মেজা, কালকেই বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে প্রথম আর্জেন্টিনার মূল একাদশে থেকে ম্যাচ শুরু করলেন। সে কারণে পুরো ম্যাচেই তাঁর সেই স্নায়ুচাপটা বোঝা গেছে।

কালকের ম্যাচে মেজা। ছবি: অপটা ইনফোগ্রাফিকস

কিন্তু ডি মারিয়া? ক্লাবজীবনে চূড়ান্ত সফল এই উইঙ্গার খেলেছেন রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের মতো ক্লাবে। কিন্তু জাতীয় দলে এই নিয়ে তিন নম্বর বিশ্বকাপ খেলা ডি মারিয়া এখনো নিষ্প্রভ খেলে যান ম্যাচের পর ম্যাচ। কালকের ম্যাচটার কথাই চিন্তা করুন, লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলা আনহেল ডি মারিয়া নিজে একবারও ডি-বক্সে ঢোকার চেষ্টা করলেন না, ঢুকতে পারলেনও না কখনো কখনো। পুরো ম্যাচটাই বাঁ দিকে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সের একটু বাইরে অবস্থান করেই কাটিয়ে দিলেন। ৭৫ মিনিট মাঠে ছিলেন, বল ছুঁতে পেরেছেন ৪৪ বার মাত্র। সফল ক্রস করতে পেরেছেন ১টা।

ডি মারিয়ার হিপম্যাপ। ছবি: অপটা ইনফোগ্রাফিকস


অথচ ডি মারিয়ার মূল কাজ ছিল ক্রস করা। মাঝমাঠ দিয়ে এগিয়ে এসে সোজা বক্সে ঢুকতে না পারলে আর্জেন্টিনার আক্রমণের প্ল্যান বি হতে পারত ডি মারিয়ার ক্রস। ৭৫ মিনিট খেলে একটা বল ক্রস করে বক্সে ফেলতে পেরেছেন ডি মারিয়া! ওদিকে ক্রিস্টিয়ান পাভোন বদলি নেমে ম্যাচের শেষ ১৫ মিনিট খেলেই সফল ক্রস দিতে পেরেছেন একটা। সবচেয়ে বড় কথা, পাভোন নামার পর খেলায় গতি এসেছিল। ৭৫ মিনিটে ডি মারিয়া যা করেছেন, ১৫ মিনিটে পাভোন তা করে দেখিয়েছেন। অথচ অভিজ্ঞতায় কোথায় পাভোন, কোথায় ডি মারিয়া!
ক্রস সফলতার শতকরা হার ডি মারিয়ার ২৫, পাভোনের ৫০। মাঠের খেলাতেও বোঝা গেছে, শেষ ১৫ মিনিট যখন পাভোন খেলেছেন, ডি মারিয়ার থেকে অনেক বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছেন। পুরো ৭৫ মিনিট খেলে গোল বরাবর একটা শটও মারতে পারেননি ডি মারিয়া। যেখানে তাঁর পাশে থেকে মেসিই শট মেরেছেন ১১টা—বক্সের বাইরে থেকে ৭টা, আর ৪টা বক্সের ভেতর থেকে! মেসির সঙ্গে ডি মারিয়ার পারফরম্যান্সের পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন তো?

পাভোনের হিটম্যাপ। ছবি: অপটা ইনফোগ্রাফিকস

একই কথা বলা যেতে পারে অনভিজ্ঞ মেজার ক্ষেত্রেও। মেজার মেসির ডান দিকে থেকেও একটা শটও মারতে পারেননি। যদিও শট মারা ছাড়া আক্রমণে মেসিকে ডি মারিয়ার থেকে অন্তত অনেক বেশি সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। সফল পাস দিয়েছেন ৮৩.৩ শতাংশ, আক্রমণে চূড়ান্ত পাস বা ‘কি পাস’ দিয়েছেন পাঁচবার, যেখানে ডি মারিয়া ৭৫ মিনিট থেকে ‘কি পাস’ দিয়েছেন দুবার মাত্র!

অনভিজ্ঞ মেজা চেষ্টা করেছেন সাধ্যমতো। ছবি: অপটা ইনফোগ্রাফিকস

জান দিয়ে লড়া যাকে বলে, তা করেছেন হাভিয়ের মাচেরানো। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে খেলা মাচেরানো একাই কালকে বারবার আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়েছেন, যেখানে বাকি ডিফেন্স হাস্যকর সব ভুল করে নিজের দলকে হজম করিয়েছে এক গোল! মাচেরানোর খেলার পরিসংখ্যান একটু লক্ষ করুন, ট্যাকলে একটাও ভুল করেননি তিনি, সাফল্য শতভাগ, বিপৎসীমা থেকে বল ক্লিয়ার করেছেন তিনবার। সফল পাসের হার ৯৪.৩ শতাংশ। আবার সেন্ট্রাল ডিফেন্স থেকেই ‘কি পাস’ দিয়েছেন দুটো, যা আরও সামনে আক্রমণভাগে থাকা ডি মারিয়ার সমান!

মাচেরানোর হিটম্যাপ। কোথায় ছিলেন না তিনি! ছবি: অপটা ইনফোগ্রাফিকস

দলের সেরা খেলোয়াড় মেসি। স্বাভাবিকভাবেই মেসিকে আটকানোর কাজে একাধিক খেলোয়াড় নিবিষ্ট থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। বাকি খেলোয়াড়দের দায়িত্ব ছিল সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আক্রমণ করার। মেসি-নির্ভর ফুটবলের চূড়ান্ত প্রদর্শনী দেখিয়ে আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে মাঠ ছাড়তে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে।

আর্জেন্টিনা শট নিয়েছে ১৭টি, বল দখলও ছিল ভালো। কিন্তু আসল চাপটাই তৈরি করতে পারেনি। ছবি: অপটা ইনফোগ্রাফিকস

সাম্পাওলির কৌশলগত ভুল ছিল। আর্জেন্টিনা ভার্টিক্যাল আক্রমণ করেছে বেশি। সরাসরি বক্সে ঢোকার চেষ্টা করছিল। আর তা আটকে যাচ্ছিল রক্ষণে। উইং দিয়ে কেউ আতঙ্ক ছড়াতে পারেননি। আর্জেন্টিনা দলে সে রকম ফুলব্যাকও নেই যে বাড়তি অস্ত্র হিসেবে উইংয়ে কাজ করবে। পুরো ম্যাচে সফল ক্রস দেওয়ার হারই আর্জেন্টিনার ৩২ শতাংশ মাত্র! ২৫টা ক্রস করার চেষ্টা করেন, সফল ক্রস দিতে পেরেছে তারা ৮টা।

আর্জেন্টিনার সব আক্রমণই সোজাসুজি বক্সে ঢোকার চেষ্টা। বক্সের দুই প্রান্ত থেকে আক্রমণ নেই!
উইং নেই আর্জেন্টিনার। ডানাবিহীন এক পাখি যেন এই দলটা। সব আক্রমণ-শট সোজাসুজি!

আর মেসির ওপর অতিনির্ভরতা তো আছেই। মেসি চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু একা মেসি পারবেন না—এই সত্য সাম্পাওলিকে দ্রুত বুঝে নিতে হবে। বুঝে নিতে হবে, প্রথম একাদশের ছক ও খেলোয়াড় নির্বাচনে কী কী ভুল তিনি করেছেন। মাচেরানো আরও একটু ওপরে উঠে কী খেলবেন? পাভোনকে কি প্রথম একাদশে রাখা হবে? দিবালাকে সুযোগ করে দিয়ে মেসি কি মাঝখানে চলে আসবেন? পাভোন-মেসি-দিবালা সামনে আগুয়েরো; পেছনে মাচেরানো আর বানেগা...এটাই হতে পারে আর্জেন্টিনার আপাত-সমস্যার উত্তর। রক্ষণে রোহো সত্যিই অচল। ৩৭ বছর বয়সেও নবিশ খেলোয়াড়ের মতো নার্ভাস গোলরক্ষক কাবায়েরো। দুজনের বদলি কি দেখা যাবে সামনের ম্যাচে? আরমানি কি সুযোগ পাবেন? দেখা যাক কী হয়!

আর্জেন্টিনার শটগুলো কোথায় গেছে।