মোট ২৯টি ম্যাচ। এর মধ্যে ১৩টি শেষ হয়েছে অমীমাংসিতভাবে (ড্র)। ভারত জিতেছে ১৩টিতে, আর বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র ৩টি ম্যাচে। একটা সময় দক্ষিণ এশীয় ফুটবলে বাংলাদেশ ও ভারতকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করা হতো। ফল যা-ই হোক না কেন, এই দুই প্রতিবেশী দেশের ফুটবল-লড়াই সীমান্তের দুই প্রান্তেই উত্তেজনা ছড়াত। লড়াই হতো হাড্ডাহাড্ডি, মাঠে থাকত আগুনের উত্তাপ। কিন্তু সময় বদলেছে। ভারত এগিয়েছে অনেকটা পথ। বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে হাভিয়ের কাবরেরার দল বেশ ভালো খেলছে। হামজা চৌধুরী ও শমিত শোমদের মতো খেলোয়াড় আসার পর বাংলাদেশের খেলা দেখতে দর্শকদের আগ্রহও বেড়েছে। তার বড় প্রমাণ, দুদলের সর্বশেষ লড়াই। এ বছর মার্চে শিলংয়ে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে গোলশূন্য ড্র হয়েছে সে ম্যাচ। সেটিই ছিল বাংলাদেশের জার্সিতে হামজার অভিষেক। তার আগে ২০২১ সালে মালেতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও ০–০ ড্র করেছে দুই দল।
২০১৯ সালের অক্টোবরের বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচটা ছিল আলাদা মাত্রার। কলকাতার সেই রাত দুই দেশের ফুটবল-প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় পুরোনো উত্তাপে। বাংলাদেশ জিততে জিততে ড্র করে—সেই আক্ষেপের মধ্যেই জন্ম নেয় নতুন এক স্মৃতি।
আজ বাংলাদেশ–ভারতের আরেকটি ম্যাচের আগে তাই অতীতের দ্বৈরথের গল্পও ফুটবলপ্রেমীদের রোমাঞ্চিত করছে।
ভারতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম মুখোমুখি হওয়া ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে। কিন্তু সেই ম্যাচের ফল ভুলে যেতে চাইবে বাংলাদেশ। বিদেশ বোস, হারজিন্দর সিং ও জাভিয়ের পিয়াসের গোলে বাংলাদেশ হেরেছিল ৩-০ ব্যবধানে। এছাড়াও, ১৯৯৭ সালে কাঠমান্ডু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচটিও বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা ভুলে যেতে চাইবেন। সেই ম্যাচে ৭৪ মিনিট পর্যন্ত স্কোরলাইন গোলশূন্য ছিল। এরপর আইএম বিজয়ন ও বাইচুং ভুটিয়ার কারিশমায় বাংলাদেশ হেরে যায় ৩-০ গোলে। বিজয়ন করেন দুটি গোল, আর তৃতীয় গোলটি ছিল বাইচুংয়ের।
ভারতের বিপক্ষে এগিয়েও ম্যাচ শেষ করতে না পারার নজির আছে অনেক। ১৯৮৫ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কলকাতায় ১–০ তে এগিয়ে থেকেও ২–১ এ হেরেছিল বাংলাদেশ। এরপর আরও চারটি ম্যাচে এগিয়ে থেকেও ড্র—১৯৮৯ ইসলামাবাদ সাফ গেমস, ২০১৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৪ গোয়া প্রীতি ম্যাচ আর ২০১৯ কলকাতার বাছাইপর্ব। চার ম্যাচের গল্পই একই—এগিয়ে গিয়ে শেষ মুহূর্তে আক্ষেপ।
নিরপেক্ষ মাঠে প্রথম দেখা ১৯৭৮ ব্যাংক এশিয়াডে—সেখানে ৩–০ তে জেতে ভারত। ১৯৯১ কলম্বো সাফে বাংলাদেশই জয় তুলে নেয় ২–১ এ। এরপর ভারত জেতে আরও চার ম্যাচ—১৯৯৪ কাতার ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ, ১৯৯৭ কাঠমান্ডু সাফ, ২০০০ লেস্টার প্রীতি ম্যাচ, ২০০৫ করাচি সাফ ফাইনাল।
বাংলাদেশ নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ভারতকে হারিয়েছে আর মাত্র একবার—১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফের সেমিফাইনালে।
১৯৯৪ দোহা ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ বাংলাদেশের জন্য ছিল ভুলে যাওয়ার মতো একটি দিন। গোলকিপার মোহাম্মদ মহসিনের ভুলে ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই ভারত এগিয়ে যায় ৩–০ তে। রক্ষণও ছিল এলোমেলো। তবু বাংলাদেশ দারুণভাবে লড়ে ফিরে আসে। স্কোরলাইন দাঁড়ায় ৩–২। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আরেকটি গোল হজম করে হারতে হয় ৪–২ এ। বাংলাদেশের দুই গোলই করেছিলেন ইমতিয়াজ আহমেদ নকিব।
আবুধাবি যেন বাংলাদেশ–ভারত লড়াইয়ের ‘শান্ত শহর’। দুদল এখানে খেলেছে দুটি ম্যাচ। দুটিই ড্র।
১৯৮৮ এশিয়ান কাপ বাছাই—গোলশূন্য। ১৯৯৯ একই প্রতিযোগিতায়—২–২। বাংলাদেশের দুই গোলই আলফাজ আহমেদের।
বাংলাদেশ–ভারত ম্যাচ মানেই টানটান উত্তেজনা। অনেক সময় সেটি মাঠ ছাড়িয়ে উঠে যায় গ্যালারিতে। ১৯৮৫ ঢাকার সাফ ফাইনালে উত্তেজনায় গ্যালারি এতটাই উত্তাল হয়েছিল যে ম্যাচ কিছুক্ষণ বন্ধ রাখতে হয়।
২০০৫ করাচি সাফেও একই ছবি—গ্যালারির গোলযোগ থামাতে ভারতের কোচ পিকে ব্যানার্জি ও বাংলাদেশের কোচ আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানিকে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার অনুরোধ জানাতে হয়েছিল।
১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে বাংলাদেশ শুরুতে ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের পক্ষে রেফারি একটি পেনাল্টি দিলে বাংলাদেশের ফুটবলাররা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। অধিনায়ক ইলিয়াস হোসেন স্বভাবতই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সরব। তিনি রেফারির সঙ্গে বাজে আচরণ করায় লাল কার্ড পান। তাঁর এই আচরণ ফিফা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ফলস্বরূপ, তাঁকে তিন বছরের সাসপেনশনের মুখে পড়তে হয়েছিল। সেই বহিষ্কারাদেশ তাঁর ক্যারিয়ারই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল।
ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের কিছু গোল আজও ফুটবলপ্রেমীদের চোখে লেগে আছে। ১৯৮৫ সাফ গেমসের ফাইনালে শেখ মোহাম্মদ আসলামের দারুণ এক গোল—বক্সের মাথা থেকে ভলিতে করা তাঁর সেই গোলটি ছিল অসাধারণ শিল্পকর্মের মতো। ১৯৮৯ ইসলামাবাদ সাফ গেমসে নূরুল হক মানিক ২৫ গজ দূর থেকে দুর্দান্ত শটে গোল করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে রিজভি করিম রুমির করা দুই গোলের একটিও ছিল দূরপাল্লার শটে। ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফে ‘সুপার-সাব’ শাহাজউদ্দিন টিপু মাঠে নেমেই দূরপাল্লার শটে গোল করেছিলেন। সেই গোলেই ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো সাফ গেমস ফুটবলে সোনার পদক জয়ের স্বপ্ন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ।
দুটি বাংলাদেশ–ভারত ম্যাচ গেছে টাইব্রেকারে। দুটিতেই জয় ভারতের। প্রথমটি ১৯৮৫ ঢাকা সাফ ফাইনাল—নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ে ১–১ এর পর টাইব্রেকারে বাংলাদেশ হেরে যায় ৪–১ এ। দ্বিতীয়টি ১৯৯৫ কলম্বো সার্ক গোল্ডকাপ সেমিফাইনাল—নির্ধারিত সময় গোলহীন থাকার পর ভাগ্য থেমে যায় টাইব্রেকারের সামনে।
এক সময় অমীমাংসিত ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য ‘গোল্ডেন গোলের’ নিয়ম ছিল। অতিরিক্ত সময়ে যে দল আগে গোল করত, ম্যাচ জিতে যেত তারাই। ঢাকায় ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে গোল্ডেন গোলেই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র থাকার পর অতিরিক্ত সময়ের সপ্তম মিনিটে মতিউর রহমান মুন্নার গোলে জয় ছিনিয়ে নেয় বাংলাদেশ।
২০১৩ সালে কাঠমান্ডুর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে আতিকুর রহমান মিশুর গোলে খেলার প্রায় শেষ পর্যন্ত ১-০ গোলে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু যোগ করা সময়ে বক্সের বাইরে থেকে পাওয়া একটা ফ্রিকিক দারুণ কারিশমায় কাজে লাগান সুনীল ছেত্রী। ২০১৪ সালে গোয়ায় প্রীতি ম্যাচ ২-২ গোলে ড্র হয়। সে ম্যাচে ভারত প্রথমে গোল করে এগিয়ে গিয়েছি ভারত। পরে সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। এরপর ভারতের আত্মঘাতী গোলে বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছিল ২-১ গোলে। পরে আবারও সমতায় ফেরে ভারত। খেলার একেবারে শেষ দিকে অবশ্য বাংলাদেশের একটি গোল বাতিল করে দিয়েছিলেন রেফারি। সেটি নিয়ে কিছুটা বিতর্কও তৈরি হয়েছিল। ২০১৯ সালের অক্টোবরে তো ৮৮ মিনিটে গোল করে মান বাঁচায় ভারত।
২০২১ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বশেষ বাংলাদেশকে হারায় ভারত। দোহায় বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বাংলাদেশ হেরেছিল ২-০ গোলে। এরপর ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ হয়েছে আরও দুটি। দুটিই ড্র।