
মৌসুমের শুরুতে জিনেদিন জিদান যখন বলেছিলেন, এবার লা লিগাই তাঁর মূল লক্ষ্য, কথাটি অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। ২০১৮–১৯ মৌসুমে যে ভয়ংকর (!) পারফরম্যান্স দেখিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ, এর পর এই দলের ওপর আস্থা রাখা কঠিন। একদিকে লিওনেল মেসি তাঁর সেরা ফর্মে আছেন, ওদিকে রিয়ালের খেলোয়াড়দের মধ্যে জয়ের ক্ষুধা হারিয়ে ফেলার চিহ্ন। এডেন হ্যাজার্ডের যোগ দেওয়ার পরও রিয়ালকে নিয়ে খুব একটা আশা করেনি কেউ।
সেই রিয়াল মাদ্রিদই গতকাল রাতে লিগ চ্যাম্পিয়ন হলো। এক ম্যাচ হাতে রেখেই লা লিগার শিরোপা নিয়ে উৎসবে মেতেছে রিয়াল। প্রত্যাবর্তনের পর টানা দশম জয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে ৭ পয়েন্টে এগিয়ে যাওয়া রিয়ালের লিগ জয়ের পেছনে অনেক ছোটখাট বিষয় কাজ করেছে। এর মাঝে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ দিক একটু আলোচনা করা যাক।
দৃঢ়চেতা মনোভাব
এবার লিগে রিয়ালের গোল ৩৭ ম্যাচে ৬৮টি। ম্যাচ প্রতি ২টি করেও গোল করেনি রিয়াল। অধিকাংশ ম্যাচেই ন্যূনতম ব্যবধানে জয়। প্রায় ম্যাচেই দেখা গেছে বেশ কিছু সময় প্রতিপক্ষ চেপে ধরে রেখেছিল। কিন্তু জিদানের দল ঠিকই চাপ সয়ে নিয়ে ম্যাচ বের করে নিয়েছে। দলের মূল তারকাদের কেউ না কেউ ঠিকই ম্যাচ বের করে নিয়েছেন চাপের মুহূর্তে।
জিদানের ট্যাকটিকস ও বড় স্কোয়াড
জিদানের দল সামলানোর ক্ষমতা সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন আগেই। কিন্তু তাঁর ট্যাকটিকস নিয়ে আলোচনা খুব কম হয়। এ মৌসুমে জিদান তাঁর ম্যানেজারিয়াল দক্ষতার সে দিকটাও দেখিয়েছেন। প্রায় প্রতি ম্যাচেই মূল একাদশে বদল এনেছেন। প্রতিপক্ষের শক্তির জায়গা বুঝে ফরমেশনে পরিবর্তন এনেছেন প্রতিদিন। শুরু করেছিলেন ৪-৩-৩ ফরমেশনে। সেটা কখনো ৪-৪-২ হয়েছে। কখনো ৪-৫-১ হয়েছে, আবার প্রয়োজনে ৪-২-৩-১ করেছেন। তাঁকে সহযোগিতা করেছে তাঁর স্কোয়াডে ভালো খেলোয়াড়ের প্রাচুর্য্য। একদিকে গ্যারেথ বেল ও হামেস রদ্রিগেজের মতো খেলোয়াড়েরা অব্যবহৃত ছিলেন। অর্ধেক মৌসুম চোটে ছিলেন হ্যাজার্ড। তবু জিদানের লিগ জিততে শেষ দিনের অপেক্ষা করতে হয়নি।
২১ জন গোলদাতা
লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় লিওনেল মেসির পরই আছেন করিম বেনজেমা। কিন্তু ২১ গোল করা বেনজেমার পর আর কোনো নির্দিষ্ট গোল ভরসা ছিল না জিদানের। পেনাল্টির দায়িত্ব বুঝে নেওয়া অধিনায়ক রামোস শুধু দুই অঙ্ক ছুঁয়েছেন। আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে বেনজেমার পর লিগে সর্বোচ্চ গোল ভিনিসিয়ুসের, ৩টি! তবু জিদানের দল লিগে সর্বোচ্চ জয় পেয়েছে। কারণ, গোলে দলের সবাই অবদান রেখেছেন। দলের ২১জন খেলোয়াড় লিগে গোল পেয়েছেন। মিডফিল্ডারদের কাছ থেকে এসেছে ১৫ গোল। ডিফেন্ডারদের কাছ থেকে এসেছে ১৬টি।
দুর্দান্ত রক্ষণ
রিয়ালের রক্ষণের প্রশংসা! এমন বিস্ময়কর কিছু কে ভাবতে পেরেছে? সেটাই করতে হয়েছে এবার। ফেরলাঁ মেন্দিকে কিনে এনে রিয়াল রক্ষণের চেহারা বদলে দিয়েছেন জিদান। এতদিন রিয়ালের বাঁ প্রান্তে মার্সেলো আক্রমণে উঠে গিয়ে দলের রক্ষণে শূন্যস্থান রেখে দিতেন। রক্ষণের বাঁ প্রান্তেই আবার খেলেন আক্রমণাত্মক মানসিকতার সার্জিও রামোস। ফলে প্রতিপক্ষ রক্ষণের এ দুর্বলতা কাজে লাগাত। মেন্দির আবির্ভাব সে দুর্বলতাকে শক্তির জায়গা বানিয়েছে। আর থিবো কোর্তোয়াও বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক হওয়ার ফর্মটা এক মৌসুম পর ফিরে পেয়েছেন এবার। ৩৪ ম্যাচে মাত্র ২০ গোল খেয়েছেন এই বেলজিয়ান। প্রতি ম্যাচেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেভ করেছেন।
রামোসের নেতৃত্ব
ডিফেন্ডার রামোসকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কারণ, গোলের নেশা নিয়ে জন্মানো এই ডিফেন্ডার প্রায়ই দলের রক্ষণকে দুর্বল রেখে আক্রমণে চলে যান। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বগুণ নিয়ে কখনো কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেননি। এ মৌসুমে সেটার সর্বোচ্চ প্রয়োগ দেখা গেছে। দলের পেনাল্টি নেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এবং সবগুলোই লক্ষ্যে পাঠিয়েছেন। রক্ষণেও মেন্দির বিকল্প থাকায় এবার আরও জমাট মনে হয়েছে রামোসকে।
বেনজেমার ক্যারিয়ার সেরা ফর্ম
রিয়াল যদি এবার ইউরোপেও সাফল্য পায় তবে বেনজেমার ব্যালন ডি' অর পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না সম্ভবত। রিয়ালের আক্রমণভাগ একাই টেনেছেন। গোল করেছেন। তুলনামূলক কম বয়সী ভিনিসিয়ুস রদ্রিগোদের গড়ে ওঠায় অবদান রেখেছেন। খেলা সৃষ্টি করেছেন, গোল বানিয়ে দিয়েছেন। রিয়ালের প্রতিটি আক্রমণ গড়েছে তাঁর পা হয়ে। ২১ গোল করে অবদান রেখেছেন, তবে মাঠে বেনজেমার অন্য ক্ষেত্রের অবদানই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে জিদানের কাছে।