রিয়াল মাদ্রিদের ওয়েবসাইটে তাঁর প্রোফাইলে দিনটি ২২ সেপ্টেম্বর। দুই মিলান ও বার্সেলোনার ওয়েবসাইটেও একই দিন-তারিখ। চাইলে ইউরোপে তাঁর প্রথম ক্লাব পিএসভি আইন্দহফেনের ওয়েবসাইটেও ঢুঁ মারতে পারেন। সেখানেও তাঁর জন্মতারিখ ২২ সেপ্টেম্বর।
কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজ অনেকেই তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় বিভিন্ন পোস্ট করছেন। খটকাটা তাই জাগেই। আরেকটু গভীরে নামলে খটকাটা পরিণত হতে পারে বিস্ময়ে। যে এসি মিলানের ওয়েবসাইটে তাঁর জন্মতারিখ ২২ সেপ্টেম্বর লেখা, সেই ক্লাবই ২০১৮ সালে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিল ১৮ সেপ্টেম্বর!
শুধু কি তা-ই, রিয়াল মাদ্রিদে তাঁর একসময়ের সতীর্থ ডেভিড বেকহাম গত বছর তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে লিখেছিলেন, ‘শুভ জন্মদিন, তোমাকে ভালোবাসি বন্ধু।’ কবে? সেই ১৮ সেপ্টেম্বর!
চাইলে সংবাদমাধ্যমও ঘাঁটতে পারেন। ২০১৬ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’-এ রব স্মিথ তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন ১৭ সেপ্টেম্বর। সেখানে লেখা ছিল, ‘আগামীকাল তাঁর জন্মদিন।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘাঁটলে এমন পোস্ট আরও মিলবে। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই ১৮ সেপ্টেম্বরে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। তবে অফিশিয়ালি তাঁর জন্মদিন ২২ সেপ্টেম্বর, আর তাই স্বাভাবিকভাবেই এদিন জন্মদিনের শুভেচ্ছা পান বেশি।
যাঁর জন্মদিন নিয়ে এই খটকা, সেই ভদ্রলোক নিজেই ২২ সেপ্টেম্বর অফিশিয়ালি নিজের জন্মদিন পালন করে যাচ্ছেন। ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নিজের এক্স হ্যান্ডলে করা পোস্টে তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘আজ আমার জন্মদিন...।’
ওহ, এত মারপ্যাঁচের মধ্যে বলাই হয়নি—ভদ্রলোকের নাম রোনালদো লুইস নাজারিও দি লিমা। ব্রাজিলের হয়ে দুবার বিশ্বকাপজয়ী। অনেকের বিচারে সর্বকালের সেরা নম্বর ৯।
প্রশ্ন হলো, রোনালদোর জন্মদিন নিয়ে কেন এই খটকা? তাঁর আসল জন্মদিন কোনটি—১৮ নাকি ২২ সেপ্টেম্বর?
একটা গল্প শুনুন।
চল্লিশের দশকে এই গল্পের শিকড় ছড়ায়। বাহিয়া থেকে রিও ডি জেনিরোর উত্তরাঞ্চলের পৌর শহর বেন্তো রিবেইরোয় আসেন মিসায়েল ও পের্জেন্তিনা বারাতা। এই দম্পত্তির মেয়ের নাম সোনিয়া দস সান্তোস বারাতা।
এক আদিবাসী নারীর ছেলে নেলিও নাজারিও দি লিমার সঙ্গে সোনিয়ার পরিচয়। একটি টেলিফোন প্রতিষ্ঠানে দুজনেই কাজ করতেন। সম্পর্ক বদলে ব্যাপারটা প্রণয়ে গড়ানোর পর দুজনের পেশাও বদলে যায়। নেলিও দোকানি, সোনিয়া আইসক্রিম বিক্রেতা।
দুজনের বয়স ২১ বছর পার হওয়ার আগেই ঘরে তিন সন্তান। রোনালদো সবার ছোট।
সোনিয়াকে সিজার করে রোনালদোকে যে চিকিৎসক পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন, তাঁর নামের সঙ্গেও আছে রোনালদো—সেই চিকিৎসকের পুরো নাম রোনালদো ভালেন্তে। ১৯৭৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রোনালদোর জন্ম। এর চার দিন পর রিও ডি জেনিরোর উত্তরাঞ্চলের শহর কাসকাদুরায় রোনালদোর জন্মনিবন্ধন করান তাঁর বাবা নেলিও।
তবে এই গল্পের আরেকটি সংস্করণও প্রচলিত। রোনালদোর জন্মের চার দিন পর নেলিও কেন তাঁর জন্মনিবন্ধন করিয়েছিলেন, সে বিষয়ে জরিমানার একটি প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। জরিমানা থেকে বাঁচতে নেলিও চার দিন পর, অর্থাৎ ২২ সেপ্টেম্বর রোনালদোর জন্মনিবন্ধন করান।
ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবো’ অবশ্য এই গল্পের আরও একটি সংস্করণ জানিয়েছে, ব্রাজিলে তখন বিনা পয়সায় জন্মনিবন্ধন করা যেত না। সেই অর্থ জোগাড় করতে চার দিন সময় লেগে যায় নেলিওর।
আরেকটি সূত্রের দাবি, জন্মনিবন্ধনের সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল। জরিমানা দিতে হতো। নেলিও বুদ্ধি করে চার দিন পরে যান ছেলের জন্মনিবন্ধন করাতে। অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী, রোনালদোর অফিশিয়াল জন্মনিবন্ধন নম্বর ৭৭৩০।
ব্রাজিলে অনেকের দাবি, নিবন্ধনের পর এই নম্বর নাকি বেশ কয়েকবার লটারি জিতেছে। সেটা হতে পারে কুসংস্কার। তবে রোনালদোর মধ্যেও এমন কিছু বিশ্বাস আছে। খেলোয়াড়ি জীবনে আগে বাঁ পা ফেলে কখনো মাঠে ঢোকেননি।
বলুন তো, নেলিও পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের নামটা কার নামে রেখেছিলেন নেলিও? ঠিকই ধরেছেন। যে চিকিৎসক তাঁর সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন—রোনালদো ভালেন্তে।
কোথাও কোথাও এমন তথ্য পাওয়া যায়, প্রসববেদনায় কাতর সোনিয়াকে ফক্সওয়াগন বিটলে করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন রোনালদো ভালেন্তে। চিকিৎসার খরচও নাকি তিনি নেননি। সম্ভবত কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই সেই চিকিৎসকের নামে ছেলের নাম রেখেছিলেন নেলিও।
ছোটবেলায় রোনালদোকে ‘দাদাদো’ নামে ডাকতেন অনেকেই। ১১ বছর বয়সে তাঁর মা–বাবার বিচ্ছেদ ঘটার পর রোনালদোর আর পড়াশোনা করা হয়নি। হোর্হে কালদেইরার রোনালদো: গ্লোরি অ্যান্ড ড্রামা গ্লোবালাইজড বই থেকে জানা যায়, রিও শহরের মেত্রোপলিতান চ্যাম্পিয়নশিপে সোশ্যাল রামোস ক্লাবের হয়ে ইনডোর ফুটবলে প্রথম বছরে ১৬৬ গোল করার পর সবার নজরে পড়েছিলেন রোনালদো।
১৩তম জন্মদিনের কাছাকাছি থাকতে শৈশবের আদর্শ জিকোর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে ফ্লামেঙ্গোয় ট্রায়াল দেন রোনালদো। ৪০০ প্রতিযোগীর মধ্যে টিকেও গিয়েছিলেন, কিন্তু পরের দিন আর ক্লাবটিতে যেতে পারেননি। যাতায়াত খরচ ছিল না।
সোশ্যাল রামোস ক্লাবের সঙ্গে এরপর খেলোয়াড় অদলবদল করে রোনালদোকে দলে টানে সাও ক্রিস্তোভাও (বর্তমানে রিও ডি জেনিরো রাজ্য লিগের চতুর্থ স্তরে খেলে)। ৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলের কিংবদন্তি স্ট্রাইকার জর্জিনিও সাও ক্রিস্তোভাওয়ের কোচ। তিন বছর সেই ক্লাবের থাকার পর জর্জিনিওই রোনালদোকে নিজের সাবেক ক্লাব ক্রুজেইরোয় পাঠান।
ক্রুজেইরোর হয়ে তাঁর প্রথম ম্যাচ ১৯৯৩ সালের ২৫ মে। ১৬ বছর বয়সী রোনালদো ২ হাজার ৪৮৪ জন দর্শকের সামনে যে স্টেডিয়ামে খেলেছিলেন, সেটার নামও রোনালদোও স্টেডিয়াম। পোকোস দে কালদেসের ঘরের মাঠটি ১৯৭৯ সালে নির্মাণের সময় শহরটির (পোকোস দে কালদেস) মেয়র ছিলেন রোনালদোও জুনকুইয়েইরা। তাঁর নামেই স্টেডিয়ামের নামকরণ। সাও ক্রিস্তোভাও-ও ঠিক এভাবেই মনে রেখেছে রোনালদোকে। তাঁদের স্টেডিয়ামের নাম রোনালদো লুইস নাজারিও দি লিমা!
ক্রুজেইরো থেকে রোনালদোর পরবর্তী সব কটি গন্তব্য আপনার জানা। পিএসভি, বার্সেলোনা, ইন্টার মিলান, রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান ঘুরে করিন্থিয়ান্সে ক্লাব ক্যারিয়ারের ইতি টানেন। জাতীয় দলে ৯৮ ম্যাচে ৬২ গোল করার পথে নিজের জন্মদিনের তারিখকেও জার্সি নম্বর হিসেবে পেয়েছেন রোনালদো। ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিকে ১৮ নম্বর জার্সি পরে খেলেছেন।
সেই অলিম্পিকেও তাঁর নাম নিয়ে আছে এক মজার ঘটনা। একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। ব্রাজিল জাতীয় দলে রোনালদোর অভিষেক ১৯৯৪ সালে। তখন রোনালদো রদ্রিগেজ দে জেসুস নামের এক ডিফেন্ডার ছিলেন ব্রাজিল দলে। সবাই তাঁকে রোনালদো নামেই জানত।
কিন্তু দলে আরও এক রোনালদো যোগ হওয়ায় তাঁর নামটা পাল্টে যায়—রোনালদোও (বড় রোনালদো)। পরে নামটি স্থায়ী হয়ে যায়। ১৯৯৬ অলিম্পিকেও ব্রাজিল দলের ডিফেন্সে ছিলেন আরেক রোনালদো। তাঁর পুরো নাম রোনালদো গুইয়ারো।
সেই রোনালদোর চেয়ে বয়সে দুই বছরের ছোট হওয়ায় রোনালদোকে তাই রোনালদিনিও (ছোট রোনালদো) নামে খেলতে হয় সেই অলিম্পিকে। বাকিটা আপনি জানেন, তারপর রোনালদিনিও একদিন রোনালদোয় ফেরত গেলেন। জার্সি নম্বরও ১৮ থেকে অর্ধেক হলো এবং তার কয়েক বছর পর আবির্ভূত হলেন আসল রোনালদিনিও।
তত দিনে অবশ্য ভক্তরা রোনালদোর অন্য নাম পেয়ে গেছেন। ও ফেনোমেনো।