সুয়ারেজের সেই কামড়: যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও

লুইস আলবার্তো সুয়ারেজ দিয়াজ। তবে বিশ্ব চেনে লুইস সুয়ারেজ নামেই। কেউ কেউ আবার আদর করে ডাকেন ‘এল পিস্তলেরো’ বা বন্দুকধারী। তিনি নিজ প্রজন্মের অন্যতম সেরা তো বটেই, অনেকের মতে সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকারদের একজন। কিন্তু সুয়ারেজের জীবন মানেই যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এক পিঠে অনিন্দ্যসুন্দর সব গোল, অন্য পিঠে শুধুই বিতর্ক। আর সব বিতর্ককে ছাপিয়ে সবার আগে মনে আসে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে তাঁর সেই কুখ্যাত ‘কামড়-কাণ্ড’।ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক ফ্রাঙ্ক ওরাল তাঁর লেখা ‘লুইস সুয়ারেজ: দ্য বায়োগ্রাফি অব ওয়ার্ল্ডস মোস্ট কন্ট্রোভারশিয়াল ফুটবলার’ বইয়ে ‘দ্য বাইট’ নামে একটি গোটা অধ্যায়ই রেখেছেন এ ঘটনা নিয়ে। সুয়ারেজ তখন লিভারপুলের প্রাণভোমরা। সেই কামড়-কাণ্ডের পর কেন তিনি লিভারপুল ছাড়তে চেয়েছিলেন, কীভাবে কী ঘটল এবং স্বয়ং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কীভাবে এতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেই রোমাঞ্চকর বয়ানই আছে এ অধ্যায়ে।

কী আছে ‘দ্য বাইট’ অধ্যায়ে

লুইস সুয়ারেজের ক্যারিয়ারে বিতর্কিত ঘটনা কম নেই। আমস্টারডামে সেই কামড়, এভরার সঙ্গে বর্ণবৈষম্যমূলক বিবাদ এবং সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফরাসি খেলোয়াড়ের সঙ্গে তাঁর হাত না মেলানো। কিন্তু ২০১৩ সালের এপ্রিলে অ্যানফিল্ডে চেলসির সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র ম্যাচে সুয়ারেজ ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের একদম তলানিতে নেমে যান।

কাজটা এতই বিতর্কিত ছিল যে তার আগে সুয়ারেজের যা কিছু ভালো, সতীর্থদের প্রতি তাঁর খেলোয়াড়ি মানসিকতা—লোকে সবই ভুলে যায়। কাজটা ছিল, চেলসি ডিফেন্ডার ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচের হাতে কামড় দেন সুয়ারেজ। এমনকি সেই ঘটনায় সুয়ারেজে মুগ্ধ লিভারপুল সমর্থকেরাও চুপ মেরে যান।

আমস্টারডামেও একই কাজ করেছিলেন সুয়ারেজ। এ কারণে ইভানোভিচকে দেওয়া সেই কামড় সবার কাছে আরও বেশি অগ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। সবাই ভেবেছিল, আমস্টারডাম থেকে শিক্ষা নিয়েছেন সুয়ারেজ। আর আমাকেও (লেখক) সূত্র জানিয়েছিল, আমস্টারডামের সেই ঘটনা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছেন সুয়ারেজ এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আর কখনোই সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। কিন্তু ভেতরকার পশু প্রবৃত্তির কারণে ইভানোভিচের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। যে কারণে তিনি নিজেই নিজের বিষয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সুয়ারেজ স্বীকার করেছিলেন, ব্লুজরা পেনাল্টি থেকে ২-১ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর তাঁর শুভবুদ্ধি উড়ে গিয়ে পাগলামি ভর করেছিল।

ইভানোভিচকে কামড় দেন সুয়ারেজ

ইভানোভিচকে কামড় দেওয়ার পর সুয়ারেজ বুঝতে পেরেছিলেন, কী ভুলটা তিনি করেছেন। মানসিকভাবে আহত ও হতবাক দেখাচ্ছিল তাঁকে। চেলসি গোলকিপার পিওতর চেক তাঁকে বুঝিয়ে বলেন এই মাত্র কী কাণ্ডটা তিনি ঘটালেন! কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। এ ঘটনায় সুয়ারেজ ইংলিশ ফুটবলে ‘অচ্ছুত’ হয়ে পড়েন এবং লিভারপুল থেকে তাঁর বিদায় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। টিকে গিয়েছিলেন ব্রেন্ডন রজার্স ও লিভারপুল–ভক্তদের সমর্থনের কারণে।

‘ক্ষমার অযোগ্য’ কাজটির জন্য সুয়ারেজ তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমা চান। অনুরোধ করেন, তিন ম্যাচের বেশি যেন তাঁকে নিষিদ্ধ না করা হয়। ক্ষমার আবেদন করে সুয়ারেজ তেমন কোনো সাহায্য পাননি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের এক মুখপাত্রও বলেন, সুয়ারেজকে বলির পাঁঠা বানানো উচিত।

১০ ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সুয়ারেজ।

এর অর্থ হলো সুয়ারেজের মৌসুম ওখানেই (এপ্রিলে) শেষ হয়ে যায়। পরের মৌসুমের শুরুতেও তাঁকে পাওয়ার সুযোগ ছিল না। সেই মৌসুমের বাকি চার ম্যাচ এবং পরের মৌসুমের ছয় ম্যাচে তাঁকে ছাড়াই খেলতে হয় লিভারপুলকে। তবে ক্লাবটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়ান আয়রে ঘোষণা করেছিলেন, স্বাধীন নিয়ন্ত্রক কমিশনের দেওয়া শাস্তিতে খেলোয়াড় ও ক্লাব চমকে গেলেও সুয়ারেজকে বিক্রি করা হবে না।

সেই কামড়ের কারণে সুয়ারেজকে পুলিশের মুখোমুখি হতে হবে না, সেটাও তখনই নিশ্চিত হয়। মার্সেসাইড পুলিশের মুখপাত্র বলেন, ‘পুলিশের কর্মকর্তারা ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন। তাঁর কোনো শারীরিক ক্ষত নেই এবং অভিযোগ করতে চাননি। এখন এটা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের বিষয়।’

সুয়ারেজ তখন ইংলিশ ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছেন। ইংলিশ ফুটবলও সুয়ারেজের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে।

সুয়ারেজের প্রতি রাগ পুষে রাখেননি ইভানোভিচ

অ্যানফিল্ড ছেড়ে যাবেন—সুয়ারেজকে নিয়ে এ আলোচনা তখন তুঙ্গে। সুয়ারেজ নিজেও এই গুঞ্জন থামাতে কোনো পদক্ষেপ নেননি। উল্টো ২০১৪ সালের জুনে মন্টেভিডিওতে উরুগুয়ের জাতীয় টিভি চ্যানেলে ওই কামড়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে জানান, লিভারপুল ছেড়ে তিনি রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন।

প্রশ্নকর্তা এরপর জানতে চান, রিয়ালে যোগ দিলে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবং তিনি মিলে বার্সেলোনার লিওনেল মেসি ও নেইমারকে হারাতে পারবেন কি না? সুয়ারেজ হেসে বলেন, ‘আমি জানি না। বার্সেলোনা অনেক ট্রফি জিতেছে এবং নেইমারকে মানিয়ে নিতে হবে; কারণ, সব চোখ তার প্রতি। আর রোনালদো মাদ্রিদে, আমি লিভারপুলে। কী ঘটবে, তা আমি জানি না।’

সুয়ারেজের সেই কামড়ে গোটা ইংলিশ ফুটবলে তোলপাড় শুরু হলেও ইভানোভিচ কিন্তু টুঁ শব্দটি করেননি। মাসখানেক পর সার্বিয়ান সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ঘটনা যখন ঘটল, তখন চমকে গিয়েছি। কিন্তু ম্যাচ শেষে সব শান্ত হয়। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। পরের দিন আমরা (সুয়ারেজ) ফোনে কথা বলেছি এবং তার ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ করি। আমি তাকে আক্রমণ করিনি কিংবা বাঁচানোর চেষ্টাও করিনি। কিন্তু ক্ষমা করেছি। এটা হতেই পারে। এসব নিয়ে এত ভাবি না।’

লিভারপুল কোচ ব্রেন্ডন রজার্স এ শাস্তিতে অসন্তুষ্ট হন। দাবি করেন, ডেভিড ক্যামেরনের মতো ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপ স্বাধীন কমিশনের রায়ে প্রভাব ফেলেছে, ‘এমনকি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এমন বিষয়ে অংশ নিয়েছেন, যা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এমন উঁচুমানের ব্যক্তিরা যখন এমন মন্তব্য করেন, তখন পক্ষপাতই স্বাভাবিক।’

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন

ক্যামেরন উত্তর দেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে নিজের মতামত দিয়েছি, ঠিক যেভাবে একজন বাবা খেলা দেখেন। আমার সাত বছর বয়সী সন্তান ফুটবল ভালোবাসে। খেলা দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু যখন খেলোয়াড়েরা এমন আচরণ করেন, তখন সেটা দেশের তরুণদের জন্য নিকৃষ্টতম উদাহরণ হয়।’

রজার্স তাঁর অবস্থান থেকে একচুলও নড়েননি। বলেছিলেন, তাঁর বিশ্বাস, ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ) অপরাধ নয়, ‘মানুষ’কে শাস্তি দিয়েছে। ঘটনাটা সেখানেই শেষ ধরে নিয়ে সুয়ারেজকে তখনো লিভারপুল ‘পরিবারের সদস্য’ হিসেবে দেখেছিলেন রজার্স। তিনি আসলে দলের সেরা খেলোয়াড়কে হারাতে চাননি। তাঁকে ছাড়তেও চাননি, যে চেষ্টাটা করেছিলেন সুয়ারেজ।

লিভারপুলের সমর্থকেরা ইন্টারনেটে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন সুয়ারেজের সেই কামড়ে। কারও মতে শাস্তিটি বেশি কড়া হয়ে গেছে। কারও যুক্তি ছিল, খেলোয়াড় নয়, ক্লাবের সম্মানটা আগে বিবেচনা করা উচিত ছিল রজার্সের।

ঘটনাটা এরপর সেখানেই শেষ হয়। কিন্তু সুয়ারেজ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তা ফিরিয়ে আনেন অন্য এক কায়দায়। ২০১৩ সালের মে মাসের পর থেকে সুয়ারেজ যাঁকে যেখানে পেয়েছেন, তাঁকেই বলেছেন, তিনি লিভারপুল ছাড়তে চান।

লিভারপুলে ভালো সময় কেটেছে সুয়ারেজের

অত্যন্ত গর্হিত এক ঘটনায় ক্লাব তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। স্বার্থপরের মতো বারবার ক্লাব ছাড়ার কথা বলে সুয়ারেজ প্রতিদান দিয়েছিলেন।

শেষ পর্যন্ত আগস্টে এসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে নিজের মনের কথাটা বলে দেন সুয়ারেজ, ‘গত বছর আমার বড় কোনো ইউরোপীয় ক্লাবে যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু থেকে যাই এই শর্তে যে যদি আমরা পরবর্তী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারি, আমাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। গত মৌসুমে সবকিছু উজাড় করে দিয়েও আমরা শীর্ষ চারে থাকতে পারিনি। এখন আমি চাই, লিভারপুল আমাদের চুক্তিকে সম্মান করবে...লিভারপুল এমন এক ক্লাব, যারা সঠিকভাবে সব করতে পারে। আমি শুধু চাই, গত মৌসুমের প্রতিশ্রুতি তারা পূরণ করুক।’

সুয়ারেজের বিশ্বাস ছিল, লিভারপুলের সঙ্গে তাঁর চুক্তিতে একটি ধারা আছে। সেই ধারার বলে তিনি ক্লাবটি ছাড়তে পারবেন, যদি কোনো ক্লাব তাঁকে কেনার জন্য চার কোটি পাউন্ডের বেশি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ব্যাপারটি নিয়ে ইংল্যান্ডের পেশাদার ফুটবলারদের অ্যাসোসিয়েশন পর্যন্ত নিয়ে যান। সংস্থাটির চেয়ারম্যান গর্ডন টেলরও তা স্বীকার করেন।

কিন্তু লিভারপুলের পক্ষ থেকে বলা হয়, অর্থের ওই অঙ্ক ন্যূনতম, যেখান থেকে তারা দর–কষাকষি শুরু করবে। অবশ্যই তারা তাঁকে ধরে রাখতে চায় সঠিক বদলি না পাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু সুয়ারেজের সঠিক বদলি? সবাই জানত, কাজটা মোটেই সহজ নয়।

মেসি ও নেইমারের সঙ্গে বার্সায় ‘এমএসএন’ আক্রমণ গড়েছিলেন সুয়ারেজ

ব্যাপারটা আরও প্যাঁচ লেগে যায় যখন আর্সেনাল সুয়ারেজকে কিনতে ৪ কোটি পাউন্ড এবং সঙ্গে আরও ১০ লাখ পাউন্ড দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। লিভারপুল এ প্রস্তাব শুধু প্রত্যাখান করেনি, এর পাশাপাশি সুয়ারেজের চুক্তিপত্রে যে অমন কোনো শর্ত আছে, সেটাও অস্বীকার করে বসে। প্রায় ১২ মাস পর লিভারপুলের মালিক জন ডব্লিউ হেনরি স্বীকার করেন সেই শর্তের অস্তিত্ব। এটাও বলেন, সুয়ারেজকে ধরে রাখার স্বার্থেই তাঁরা সেই শর্ত অগ্রাহ্য করেছিলেন।

সুয়ারেজ তখন আর এগোতে পারেননি। মালিকের অনড় অবস্থানে থেকে যেতে হয়। পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে লিভারপুল। সুয়ারেজ ছিলেন তার পুরোধা।

২০১৩ সালের মৌসুমে সুয়ারেজ ছিলেন স্বার্থপর। ক্লাব ও সমর্থকেরা পাশে দাঁড়ালেও তিনি চলে যেতে চেয়েছিলেন।

এই আনুগাত্যহীনতা সুয়ারেজ ভুলিয়ে দিয়েছিলেন পরের মৌসুমে। ২০১৩-১৪ মৌসুমে লিভারপুল ইউরোপের সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পা রাখে, যেখানে তারা ফিরতে চেয়েছিল। লিভারপুল ঠিক এভাবেই তৈরি করেছিল সুয়ারেজকে—ঠিক যেভাবে অন্ধকার রাতের পর সূর্যোদয় ঘটে।

পাঠকের জন্য তথ্য

লুইস সুয়ারেজ এখন ইন্টার মায়ামির খেলোয়াড়, যেখানে তিনি আবারও সতীর্থ হিসেবে পেয়েছেন বন্ধু লিওনেল মেসিকে। ৩৮ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড এখন ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে। আয়াক্স, লিভারপুল, বার্সেলোনা ও আতলেতিকো মাদ্রিদে কাটিয়েছেন সোনালি সময়। বার্সায় মেসি ও নেইমারের সঙ্গে তাঁর ‘এমএসএন’–ত্রয়ী ফুটবল ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। উরুগুয়ের জার্সিতে তিনি সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং কোপা আমেরিকাজয়ী নায়ক।ইস