এক দশক আগেও ১৫ থেকে ২০ কোটি ইউরো রিলিজ ক্লজকে আকাশচুম্বী ভাবা হতো। ধারণা করা তো, এই দাম দিয়ে কোনো ক্লাবই আরেক ক্লাবের খেলোয়াড় ছাড়িয়ে নিতে পারবে না।
কিন্তু আরবের ধনকুবেরেরা বিশ্বের নামীদামি তারকার দিকে হাত বাড়ানোর পর থেকে ধীরে ধীরে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। তাঁদের কাছে ১৫-২০ কোটি ইউরো কোনো ব্যাপারই নয়। এমনকি ৫০ কোটি ইউরো ঢেলেও জনে-জনে খেলোয়াড় কেনার সামর্থ্য তাঁদের আছে।
নিজেদের শীর্ষ ফুটবলারদের সুরক্ষিত রাখতে ইউরোপের ক্লাবগুলো তাই এমন রিলিজ ক্লজ ধার্য করা শুরু করেছে যেন অন্যরা চাইলেও তাঁদের দলে ভেড়াতে না পারে। ভেড়ালেও যেন ক্লাবটি আর্থিকভাবে বিপুল লাভবান হয়।
রিলিজ ক্লজের অঙ্কটা মিলিয়ন ছাড়িয়ে এখন বিলিয়নে পৌঁছে গেছে। বর্তমানে বিশ্বে এমন ১২ জন ফুটবলার আছেন, যাঁদের রিলিজ ক্লজ ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১৩ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকার সমান।
এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে রিলিজ ক্লজ সম্পর্কে ফুটবলপ্রেমীদের স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া যাক—
রিলিজ ক্লজকে বাইআউট ক্লজও বলা হয়। সহজ বাংলায় যেটিকে মুক্তির ধারা বলা যেতে পারে। এই ধারায় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ খেলোয়াড়ের চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকে। খেলোয়াড়, তাঁর প্রতিনিধি বা এজেন্ট এবং ক্লাব—এই তিন পক্ষের সম্মতিতে চুক্তি স্বাক্ষরের সময় তা নির্ধারিত হয়।
মূল ক্লাবের ইচ্ছার বাইরে ওই খেলোয়াড়কে অন্য কোনো ক্লাব নিতে চাইলে রিলিজ ক্লজ দিয়ে নিতে হয়। অস্বাভাবিক এই টাকার অঙ্ক একজন খেলোয়াড়কে পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দেয়। তিনি বর্তমান ক্লাবে থাকতে না চাইলে রিলিজ ক্লজের মাধ্যমে অন্য ক্লাবে যাওয়ার সুযোগ থাকে।
উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাক। ধরুন, একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে একটি ক্লাবের ২০২৭ সাল পর্যন্ত চুক্তি আছে। তাঁর জন্য ৫০ কোটি ইউরো রিলিজ ক্লজ ধার্য করা আছে। চুক্তির মেয়াদ ফুরানোর আগে সেই ক্লাব ওই খেলোয়াড়কে ছাড়তে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু মূল ক্লাবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্য ক্লাব যদি খেলোয়াড়টিকে কিনতে চায় এবং খেলোয়াড়ও চলে যেতে চান, তাহলে ৫০ কোটি ইউরো দিয়েই ছাড়িয়ে নিতে হবে। এতে ক্লাবটি তাদের পছন্দের খেলোয়াড়কে হারালেও আর্থিকভাবে বিপুল লাভবান হবে।
বর্তমানে যে ১২ ফুটবলারের রিলিজ ক্লজ রেকর্ড ১০০ কোটি ইউরো, তাঁদের ৬ জন রিয়াল মাদ্রিদের ও ৬ জন বার্সেলোনার।
রিয়ালের কিলিয়ান এমবাপ্পে, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, জুড বেলিংহাম, রদ্রিগো, এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা ও ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আরনল্ড এবং বার্সার লামিনে ইয়ামাল, গাভি, পেদ্রি, ফেরান তোরেস, আনসু ফাতি ও জুলস কুন্দে। স্পেনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই ক্লাবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের কেউ নিতে চাইলে জনপ্রতি ১০০ কোটি ইউরো দিয়ে নিতে হবে।
সম্প্রতি বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করেছেন ইয়ামাল। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, তুখোড় প্রতিভাবান এই তরুণ কাতালান ক্লাবটিতে থাকবেন ২০৩১ সালের জুন পর্যন্ত। চুক্তি নবায়নের সময়ই বার্সা কর্তৃপক্ষ তাঁর রিলিজ ক্লজের অঙ্কটা (১০০ কোটি ইউরো) জানিয়ে দিয়েছে।
লিভারপুল ছেড়ে আলেকজান্ডার-আরনল্ড রিয়ালে নাম লিখিয়েছেন গত মাসের শেষ সপ্তাহে। আজ সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। ক্লাবটিতে যোগ দিতে না দিতেই তাঁর রিলিজ ক্লজ ধার্য করা হয়েছে ১০০ কোটি ইউরো।
রিলিজ ক্লজের রকমফেরও আছে। এটি নির্দিষ্ট সময় পর বাড়তে বা কমতে পারে। যেমন বার্সার উরুগুইয়ান ডিফেন্ডার রোনাল্দ আরাউহোর রিলিজ ক্লজও ১০০ কোটি ইউরো ছিল। কিন্তু নাটকীয়ভাবে তা কমে ৬ কোটি ৫০ লাখে নেমে গেছে। এমন দরপতন এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বার্সা আরাউহোকে বিক্রি করে দিতে চায়।
এখন ফুটবলপ্রেমীদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ইউরোপীয় ক্লাবগুলো ইদানীং তাদের শীর্ষ খেলোয়াড়দের রিলিজ ক্লজের অঙ্কটা অস্বাভাবিক বানিয়ে ফেলছে কেন? এর কারণ মূলত দুটি—নেইমারের দলবদল থেকে শিক্ষা এবং সৌদি প্রো লিগের ক্লাবগুলোর কাড়িকাড়ি অর্থ নিয়ে দলবদলের বাজারে নামা।
২০১৭ সালে নেইমারকে বার্সেলোনার কাছ থেকে ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরোয় ছাড়িয়ে নেয় ফরাসি ক্লাব পিএসজি, যা এখনো দলবদল ইতিহাসের বিশ্ব রেকর্ড। বার্সা হয়তো ভেবেছিল, নেইমারের জন্য তারা যে রিলিজ ক্লজ দিয়ে রেখেছে, তা দিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই। কিন্তু কাতারি মালিকানাধীন পিএসজি বার্সার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দলবদলের বাজার নাড়িয়ে দেয়।
নেইমারকে পিএসজির হাতে তুলে দিয়ে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ইউরো লাভ করেছিল বার্সা। সেটিও এক খেলোয়াড়কে বিক্রি করে সর্বোচ্চ লাভের বিশ্ব রেকর্ড। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এই দলবদলের পর কাতালান ক্লাবটির বড় শিক্ষা হয়েছে। এর পর থেকেই নিজেদের তারকা খেলোয়াড়দের জন্য লাগামহীন রিলিজ ক্লজ নির্ধারণ করছে তারা।
সম্প্রতি দলবদলের বাজারে বিপ্লব ঘটিয়েছে সৌদি ক্লাবগুলো। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দেখানো পথ ধরে অনেক তারকাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন। নামীদামি তারকাদের দলে ভেড়াতে খোদ সৌদি সরকারই তাদের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল (পিআইএফ) থেকে ক্লাবগুলোকে অর্থায়ন করছে। যার ফলে ইউরোপ থেকে একের পর এক খেলোয়াড় নিয়ে আসতে পারছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা দাবি করে আসছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বিশ্বজুড়ে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। সুনাম ফেরাতেই সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রীড়াঙ্গনে অঢেল অর্থ বিনিয়োগ করছেন, যেটিকে বলা হচ্ছে ‘স্পোর্টস ওয়াশিং’।
এখন পর্যন্ত ফুটবলেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে সৌদি। তাদের পেট্রো ডলারের হাত থেকে শীর্ষ খেলোয়াড়দের সুরক্ষিত রাখতেই রিলিজ ক্লজ ধরাছোঁয়ার বাইরে নির্ধারণ করেছে রিয়াল-বার্সার মতো ক্লাবগুলো।
কিন্তু সৌদি আরবের অঢেল পেট্রো ডলারের সামনে কোনো অঙ্কই কি আসলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখা সম্ভব?