মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন প্রায় চার বছর। সেই থেকে বিছানাবন্দী ছিলেন। চলাফেরা করতে পারতেন না। ষাটের দশকের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট হামিদা বেগম আর সুস্থ হয়ে ফিরবেন না ক্রীড়াঙ্গনে। আজ সকালে ঢাকায় নিজ বাসায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ বাদ আসর পল্টন হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
স্বাধীনতার আগে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকসে খেলতেন হামিদা। প্রতিবছর রিলেতে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতত তাঁর দল আজাদ স্পোর্টিং। হামিদা ছিলেন সেই দলের অন্যতম সদস্য। ১৯৬৭ সালে পূর্ব বাংলার অ্যাথলেটিকসে হার্ডলসে তিনি রুপা জিতেছিলেন।
সে সময় ৫০, ১০০, ২০০ মিটার দৌড়ে সব সময় রুপা বা ব্রোঞ্জ পেতেন হামিদা। তবে তিনি বেশি করতেন হার্ডলস। স্বাধীনতার পর আর খেলেননি, তবে যুক্ত ছিলেন খেলার সঙ্গেই। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহকারী ক্রীড়া পরিচালক ছিলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা। নারী খেলাধুলায় অবদান রাখার জন্য ২০০৯ সালে পেয়েছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার।
হামিদা বেগমকে নিয়ে চল্লিশের দশকের ক্রীড়াবিদ রাবেয়া খাতুন তালুকদার তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘আমার অন্যতম ক্রীড়া অন্তপ্রাণ ছাত্রী (মাঠের) হামিদা বেগম আজীবন ক্রীড়াকলাপে নিজেকে নিয়োজিত রেখে দেশের ক্রীড়া উন্নয়নে অবদান রাখছে। ধীর, স্থির, নম্র স্বভাবের মেয়েটিকে দেখে মনে হতো না যে সে একজন খেলোয়াড়। কিন্তু মাঠে নামলেই সে নিজেকে একজন জাত খেলোয়াড় হিসেবে প্রকাশিত করত। তার প্রীতি ও শ্রদ্ধায় আজও আমি অভিষিক্ত আছি।’
ষাটের দশকে হামিদা বেগমরা অনুশীলন করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে। কখনো কখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও তাঁকে নিয়ে যেতেন তাঁর মা। পড়তেন সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট স্কুলে। এই স্কুলে পড়তেন সাবেক অ্যাথলেট রওশন আখতার ছবিসহ অনেকে। হামিদা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘স্কুলের ফাইনাল খেলা হলে ওখান থেকে খেলোয়াড় নির্বাচন করে ক্লাবে নিয়ে যেতেন কোয়েল আপা। তিনিই আমাদের খেলায় এনেছেন। ওনার আব্বা ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। সবকিছুই উনিই করতেন।’
ধীর, স্থির, নম্র স্বভাবের মেয়েটিকে দেখে মনে হতো না যে সে একজন খেলোয়াড়। কিন্তু মাঠে নামলেই সে নিজেকে একজন জাত খেলোয়াড় হিসেবে প্রকাশিত করত।হামিদা বেগমকে নিয়ে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন চল্লিশ দশকের ক্রীড়াবিদ রাবেয়া খাতুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের ছাত্রী হিসেবে হলের খেলা খেলেছেন হামিদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তাঁর সঙ্গে পড়তেন সুলতানা আহমেদ খুকী (সুলতানা কামাল), যিনি ছিলেন রোকেয়া হলের ছাত্রী। নাজমা শামীম (সমাজবিজ্ঞান), প্রয়াত সালমা রফিকও একই হলের ছাত্রী।
হামিদা বেগম বলেছিলেন, ‘তখন খেলাধুলা করে আমরা কিছুই পেতাম না। বাবা–মায়ের টাকায় রিকশা ভাড়া দিয়ে আসতাম খেলতে। এখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এলে শুধু আগের কথা মনে পড়ে। আমাদের সময় গ্যালারি থাকত দর্শকে ঠাসা। হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের ওপাশ দিয়ে ‘প্লেয়ার্স গেট’ নামে একটা গেট দিয়ে খেলোয়াড়দের ঢাকা স্টেডিয়ামে ঢোকানো হতো। তখন সব ক্লাব ছিল বঙ্গভবনের উল্টো দিকে। পরে তা স্থানান্তরিত হয় মতিঝিল-আরামবাগ এলাকায়। ক্লাবের ভেতর দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে খেলোয়াড়দের নিয়ে আসা হতো ঢাকা স্টেডিয়ামে।’
ষাটের দশকের খেলাধুলার নীরব সাক্ষী ছিলেন হামিদা বেগম। স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছিলেন, ‘ঢাকা স্টেডিয়ামে ঢোকার দুই পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত, অটোগ্রাফ নিত আমাদের। আমরা যখন ট্র্যাকে দাঁড়াতাম, লাল–হলুদ ড্রেস ছিল আমাদের, অর্থাৎ আজাদ ক্লাবের। লাল শর্টস, ওপরে হলুদ। গ্যালারি থেকে দর্শকেরা ‘লাল–হলুদ’, ‘লাল–হলুদ’ বলে চিৎকার করত। এতেই শক্তি অনেক বেড়ে যেত।’
তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা।