ফাইনালে ওঠার পর কান্না লুকাতে পারেননি নেস্থি পেতিসিও
ফাইনালে ওঠার পর কান্না লুকাতে পারেননি নেস্থি পেতিসিও

মুরগির বিষ্ঠা কুড়ানো পেতেসিওর গল্পটা চোখ ভিজিয়ে তোলার

একেকটি ঘুষি মারছেন।

বক্সিং রিংয়ে তাঁর ছোড়া জ্যাব আর পাঞ্চগুলো যেন প্রতিপক্ষের চোয়ালে নয়। নেস্থি পেতিসিওর একেকটি পাঞ্চ যেন হতাশার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া অভাবের শিকড়টাকে উপড়ে নেওয়ার চেষ্টা।

ফিলিপাইনের বক্সার পেতেসিওর ছোটবেলা কেটেছে প্রচণ্ড অভাবে। বাবা তিওদরো পেতেসিও ছিলেন কৃষক। সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য তিওদরো সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে মুরগির বিষ্ঠা কুড়াতেন। জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা এসব বিষ্ঠা বাজারে নিয়ে বেচতেন নেস্থি। একসময় দুর্গন্ধযুক্ত বিষ্ঠা কুড়ানো সেই পেতেসিও এবার পদক কুড়াচ্ছেন অলিম্পিকে!

এরই মধ্যে উঠে গেছেন মেয়েদের ফেদারওয়েটের ৫৪-৫৭ কেজি ওজন শ্রেণির ফাইনালে। আগামীকাল সোনার লড়াইয়ে পেতেসিও মুখোমুখি হবেন জাপানের সেনা ইরির।

২৬ জুলাই ফিলিপাইনকে প্রথম অলিম্পিক সোনার স্বাদ এনে দেন হিদিলিন দিয়াজ। ১২৫ বছরের অপেক্ষা ফুরিয়ে এই ভারোত্তোলক সেদিন দেশটির প্রথম নারী হিসেবে অলিম্পিকে জেতেন সোনা। আট দিনের ব্যবধানে আবারও ফিলিপাইনকে সোনার পদকের মঞ্চে দেখার সুযোগ করে দিতে যাচ্ছেন পেতেসিও।

সেমিফাইনালে স্নায়ুক্ষয়ী লড়াইয়ে ইতালিয়ান বক্সার ইরমা তেস্তাকে হারিয়ে রিংয়েই কেঁদে ফেলেন পেতেসিও। অবশেষে যেন স্বপ্নপূরণের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ২৯ বছর বয়সী বক্সার, ‘এটা আমার জন্য অনেক কিছু। এটা শুধু আমার একার স্বপ্ন নয়, বাবারও স্বপ্ন। আমার পরিবার, দেশ, ফিলিপাইনের সব মানুষ, যাঁরা আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন, সবাইকে ভালোবাসি।’

ইতালিয়ান বক্সার ইরমা তেস্তাকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠেন পেতেসিও

দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়তই লড়তে হয়েছে তাঁকে। ব্যাপারটা এমন নয় যে ভালোবেসে বক্সিংয়ে এসেছেন পেতেসিও। খেললে বাড়তি আয় হবে, এটা ভেবেই বাবা তাঁকে বক্সিং শেখাতে শুরু করেন। সংসারের বাড়তি উপার্জনের জন্য ছোট ভাই নরলান ও ছোট বোন নিকেজ্জাকেও রিংয়ে নামিয়ে দেন পেতেসিওর বাবা।

পেতেসিও বলছিলেন, ‘আমি যাতে পরিবারকে সাহায্য করতে পারি এবং বিনা বেতনে পড়াশোনা করতে পারি, এ জন্যই বক্সিং খেলা বেছে নিয়েছি। অথচ অন্য অনেক খেলা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল আমার সামনে। প্রথমত এটা আমার পছন্দ ছিল না। এটা ছিল শুধু নিজের আত্মরক্ষার জন্য শেখা।’

পরিবারে অভাব এতটাই জেঁকে বসেছিল যে ঠিকমতো দুবেলা খেতেও পারতেন না পেতেসিও। বক্সিং খেললে তবেই খাবার জুটত। সেই কষ্টের দিনগুলো মনে পড়লে এখনো কান্না পায় পেতেসিওর, ‘হারি বা জিতি, খেললেই খেতে পারতাম। ওই সময় সত্যিই আমাদের কিছুই ছিল না। শুধু অর্থ উপার্জন করতাম, যাতে খাবার কিনতে পারি।’

সাত বছর বয়সে বাবাই ছিলেন পেতেসিওর কোচ। বাবা স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে একজন ভালো বক্সার হবেন নেস্থি। বক্সিং খেলার জন্য কোনো নিয়মনীতির বালাই ছিল না তাঁর। খেলতে হতো প্রতিবেশীর সঙ্গে। রাস্তার ধারে বানানো কোনো বক্সিং রিংয়ে, বাস্কেটবল কোর্টে, সমুদ্রসৈকতে এমনকি ছেলেদের বিপক্ষেও লড়তে হতো! পেতেসিও সে কথাই বলছিলেন, ‘আমরা শুধু আশপাশের সবার সঙ্গে খেলতাম। খেলতাম কারণ জানি, জিতি বা হারি খেতে পারব।’

পেতেসিওর জীবনটা সংগ্রামের। বক্সিংয়ের রিংয়ে তেমনই এক সংগ্রাম জয়ের পর

১১ বছর বয়সে অর্থের জন্য বাবা একবার এক ছেলে বক্সারের বিপক্ষে লড়াই করতে বলেন পেতেসিওকে। যখন সবাই ভেবেছে পেতেসিও হেরে যাচ্ছেন, খেলাটা থামিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিচারকেরা।

কিন্তু পেতেসিও তো জন্মেছেন লড়াই করার জন্যই, ‘ওরা আমাকে বলছিল যেন খেলা থামিয়ে দিই। এবং জিজ্ঞাসা করছিল খেলা চালিয়ে যেতে পারব কি না? আমি বলেছিলাম, “হ্যাঁ”। আমার দিক থেকে কোনো অসম্মতি ছিল না। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল। আমি সত্যি লড়তে চেয়েছিলাম।’

শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জেতেন পেতেসিও। ওই ম্যাচ জিতেই ফিলিপাইন জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজর কাড়েন। ওই সময় বুঝতে পেরেছিলেন, বক্সিংই হতে পারে তাঁর জীবনের দারিদ্র্য তাড়ানোর সিঁড়ি।

এরপর একে একে আন্তর্জাতিক মঞ্চে লড়তে থাকেন নিয়মিত। পেতেসিওর শোকেস ভরে উঠতে থাকে পদকে। ২০১১, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে সাউথইস্ট এশিয়ান গেমসে জেতেন রুপা। ২০১৫ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও রুপা জেতেন। ওই বছর ইন্দোনেশিয়া প্রেসিডেন্টস কাপে জেতেন সোনা। ২০১৯ সালে সাউথইস্ট এশিয়ান গেমস ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও জেতেন সোনা।

বক্সিং পেতেসিওর জীবনে দারিদ্র তাড়ানোর সিঁড়ি

এত এত সাফল্য! তবু ২০১৬ রিও অলিম্পিকের বাছাইপর্ব পার হতে পারেননি। ২০১৮ সালে তো এশিয়ান গেমসে হেরে বক্সিং গ্লাভস চিরদিনের জন্য তুলে রাখতেই চেয়েছিলেন! ওই সময়ের কথা মনে করে বলছিলেন, ‘যখন ২০১৮ এশিয়ান গেমসের প্রথম বাউটেই হেরে গেলাম, সত্যি খেলাটা ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। তখন খেলা ছেড়ে চাকরি খোঁজা শুরু করি। আমি আসলে অন্য কিছু নিয়ে থাকতে চেয়েছিলাম। সত্যি তখন ভীষণ ভেঙে পড়ি। বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি, খুব মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম।’

পেতেসিওর একটু বিরতির দরকার ছিল এবং ওই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সময় চাইছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর বেশে ফেরেন ২০১৯ সালে। থাইল্যান্ড ওপেনে জেতেন ক্যারিয়ারের প্রথম কোনো বৈশ্বিক পদক।

ওই জয়টা যেন তাঁকে আত্মবিশ্বাসের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল, ‘২০১৯ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাটা আমাকে অনেক সাহায্য করে। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বহুগুণ।’

করোনায় এক বছর অলিম্পিক পিছিয়ে যাওয়ায় প্রস্তুতিটাও মনের মতো হয়েছে পেতেসিওর। এখন শুধু সোনার পদকটা গলায় পরার অপেক্ষা। পেতেসিওর সেই সোনালি হাসির মাঝে দূরত্ব শুধু একটি মাত্র জয়ের। সেই সোনালি দিনের জন্যই যে অপেক্ষায় আছেন পেতেসিও।