‘আ ম্যান ফর অল সিজনস’ (১৯৬৬) ইতিহাসভিত্তিক সিনেমা। স্যার টমাস মুরকে নিয়ে বানানো। এ সিনেমার গল্পের ছাঁচে বানানো যায়, এমন একটা গল্প খুঁজছিলেন প্রযোজক ডেভিড পাটনাম। একটা চরিত্র, যে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ এবং খেলাধুলার বিশেষ ভূমিকা থাকবে।
পাটনাম গল্পটা আবিষ্কার করেছিলেন। সেটাও দুর্ঘটনাবশত। ১৯৭৭ সাল। ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মালিবুতে ভাড়া বাসায় শয্যাগত পাটনামের বই পড়ার অভ্যাস ছিল। তখন ‘অ্যান অ্যাপ্রুভড হিস্ট্রি অব দ্য অলিম্পিক গেমস’ বইয়ে পাটনাম আবিষ্কার করলেন তাঁর চরিত্র, গল্পও।
ডাক পড়ল ব্রিটিশ অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকার কলিন ওয়েলান্ডের। পাটনামকে চিত্রনাট্য লিখে দিতে হবে। ওয়েলান্ড অমানুষিক গবেষণা করে দাঁড় করালেন অস্কারজয়ী ‘চ্যারিয়টস অব ফায়ার’ বা অগ্নিরথ।
গল্পটা ১৯২৪ প্যারিস অলিম্পিকে দুই ব্রিটিশ দৌড়বিদ এরিক লিডেল ও হ্যারল্ড আব্রাহামসের। শেষের জন্য ইংরেজ ইহুদি, কেমব্রিজের ছাত্র। ট্র্যাকে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী। লিডেল জাতে স্কটিশ, কাজে ধর্ম প্রচারক আর দৌড়ান সৃষ্টিকর্তার জন্য। রোববার দৌড়ান না। সেদিন ‘স্যাবাটারিয়ানিজম’। বিনোদনমূলক কাজকর্ম ছেড়ে সৃষ্টিকর্তার উপাসনায় কাটানোর দিন। সে জন্য লিডেল ’২৪ অলিম্পিকে নিজের পছন্দের ১০০ মিটার দৌড়ের হিটেও অংশ নেননি। সেদিন রোববার ছিল তাই।
সত্য ঘটনা নিয়ে বানানো এ সিনেমায় লিডেল চরিত্রের সারাংশ সিনেমাতেই বেরিয়ে আসে। একটি জায়গায় লিডেল বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাকে ধর্মপ্রাণ বানিয়েছেন—দ্রুত দৌড়াতে পারিও তার জন্যই।’ লিথুয়ানিয়ান অভিবাসীর ছেলে আব্রাহামস একটু অন্য রকম। ইংল্যান্ডে নাম-যশ কামিয়েছেন। কিন্তু ইহুদি হওয়ায় অ্যাংলো-স্যাক্সন সমাজে তাঁর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ট্র্যাকের আব্রাহামস দৌড়ান তাই ট্র্যাকের বাইরের জীবনের আব্রাহামসের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে।
চিত্রনাট্য লেখার সময় ওয়েলান্ড সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি ছেপেছিলেন। ’২৪ অলিম্পিক দেখা এমন কেউ থাকলে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল ওয়েলান্ডের সঙ্গে। ওয়েলান্ড আব্রাহামসকেই পেয়ে যেতেন। দুর্ভাগ্য, ১৯৭৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মারা যান। তবে ইংরেজ অ্যাথলেট অব্রে মন্টেগুর যে চিঠিগুলো সিনেমায় দেখানো হয়েছে, সেগুলো সত্যি। ওয়েলান্ড তাঁর গল্পের গাঁথুনিতে এগুলো বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।
পাটনাম চিত্রনাট্য পেয়ে যাওয়ার পর তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন আগে কখনোই ফিচার ফিল্ম না বানানো হিউ হাডসনকে। বন্ধু ও অতীতের সহকর্মী, তাই হয়তো জানতেন ভালো বানাবেন। লিডেল চরিত্রে ব্রিটিশ মঞ্চ অভিনেতা ইয়ান চার্লসন দারুণ মানিয়ে যান। স্কটল্যান্ড বনাম আয়ারল্যান্ড দৌড় শেষে লিডেলের বক্তব্যটি চার্লসনের লেখা। চরিত্রটি ভালোভাবে রূপায়ণে প্রচুর বাইবেল পড়তে হয় তাঁকে। আব্রাহামস চরিত্রে অভিনয় করেন ব্রিটিশ অভিনেতা বেন ক্রস।
ব্রিটিশ কবি ও চিত্রশিল্পী উইলিয়াম ব্লেকের কবিতার লাইন ‘ব্রিং মি মাই চ্যারিয়ট অব ফায়ার’ থেকে সিনেমার নাম নেওয়া হয়। অস্কারে আটটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়ে সেরা সিনেমা, সেরা আবহসংগীত, সেরা মৌলিক চিত্রনাট্য ও সেরা কস্টিউম ডিজাইনে পুরস্কার জেতে এই সিনেমা। ১৯৯৫ সালে ভাটিকান প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ সিনেমার তালিকায় ‘মূল্যবোধ’ ক্যাটাগরিতে সিনেমাটি স্থান পায়। গত বছর খ্যাতিমান পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান জানান, এটি তাঁর অন্যতম প্রিয় সিনেমা এবং ‘ডানকার্ক’ বানানোর প্রেরণা তিনি এ সিনেমা থেকেই পেয়েছেন।
২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা রোয়ান অ্যাটকিনসন এ সিনেমা অবলম্বনে তাঁর পারফরম্যান্সের একটি চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন। বিখ্যাত চিত্রসমালোচক রজার এবার্ট এ সিনেমা নিয়ে নিজের রিভিউয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এটা অদ্ভুত। দৌড়ানো এবং ব্রিটেনের শ্রেণিব্যবস্থায় আমার কোনো আগ্রহ নেই। তবু “চ্যারিয়টস অব ফায়ার” দেখে কেন এত আন্দোলিত হয়েছি? ১৯৮১ সালের মে মাসে কান চলচিত্র উৎসবে সিনেমাটি দেখার পর থেকেই আমি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। উত্তর খুব সরল; অন্য সব অসাধারণ সিনেমার মতো “চ্যারিয়টস অব ফায়ার”ও সাধারণ একটি বিষয়কে মানব চরিত্র নিয়ে বড় বিবৃতির বিষয়বস্তু বানিয়ে ফেলেছে।’
চ্যারিয়টস অব ফায়ার (১৯৮১):
পরিচালক: হিউ হাডসন
চিত্রনাট্য: কলিন ওয়েলান্ড
অভিনয়: বেন ক্রস, ইয়ান চার্লসন, নিকোলাস ফ্যারেল, নাইজেল হার্ভেস।
আইএমডিবি রেটিং: ৭.১/১০
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৫ মিনিট