‘ভালো বউ পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার’

তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জিতেছিল বাংলাদেশ। যে জয়ের মহিমা এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আলাদা করে বোঝানোর দরকার নেই। পরের বছর হায়দরাবাদে কেনিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম জয়টাও তাঁর নেতৃত্বে। ৮ টেস্ট ও ৪৪ ওয়ানডের ক্যারিয়ার শেষেও তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যাননি। নির্বাচক, প্রধান নির্বাচক,বোর্ড পরিচালক—অনেক পরিচয়েই দেখা গেছে তাঁকে। তারেক মাহমুদকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে চেনা যাবে ব্যক্তি আকরাম খানকেও।

প্রশ্ন

জাতীয় দলে খেলছেন, অধিনায়কত্ব করেছেন। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে নির্বাচক ও বোর্ড পরিচালক হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনও খুব গোছানো। সাবিনা ভাবির সঙ্গে আপনার সুখী দাম্পত্য জীবনের তো অনেক খ্যাতি। এক জীবনে এত কিছু...কোনটা বেশি উপভোগ্য মনে হয়েছে?

আকরাম খান: (হাসি) সবই দারুণ! প্রেমের আগে তো আমার জীবনে ক্রিকেট এসেছে। খেলাটা খুবই উপভোগ করতাম। আমি বলব, আমাদের প্রজন্ম সৌভাগ্যবান। কারণ, আমাদের মাত্র দুটো অপশন ছিল—লেখাপড়া আর খেলাধুলা। এখনকার মতো ডিভাইস ছিল না। বিটিভিতে এক সপ্তাহ পরপর মুভি অব দ্য উইক দেখাত, ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’, ‘ফলগাই’ ছিল। এ রকম সিনেমাগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। স্কুল থেকে এসে মাঠে চলে যেতাম, রাতে হয়তো টিভিতে কোনো একটা সিনেমা-নাটক থাকত। এর বাইরে কিছু করার ছিল না। আর আমাদের পরিবারটাই ছিল খেলাপাগল। আপনি জানেন, আমার বড় ভাই (জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার নাফিস ইকবাল ও তামিম ইকবালের বাবা প্রয়াত ইকবাল খান) ফুটবল খেলতেন। আমার জন্য মজার ব্যাপার ছিল আমি ফুটবল, ক্রিকেট দুটোই খেলতাম। সাবিনাদের বাসা ছিল আমাদের বাসার পাশেই। আমাদের বারান্দা থেকে ওদের বারান্দা দেখা যেত। আমি বারান্দায় যেতাম, সে–ও আসত। আমাদের বারান্দাটা ছিল অনেক লম্বা। এমনও দিন গেছে, আমি তিন-চার ঘণ্টা বারান্দায় ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতাম। আমার বন্ধু শ্যামল টেনিস বল ছুড়ে মারত। সাবিনা ওদের বারান্দা থেকে দেখত। অ্যারোপ্লেন টেনিস বল তখন আমাদের কাছে বেশ দামি। বারান্দায় নেট লাগিয়ে নিয়েছিলাম যেন বল নিচে পড়ে হারিয়ে না যায়। জানালার কাচ ভেঙেছি অনেক।

প্রশ্ন

ওটা আসলেই প্র্যাকটিস ছিল, নাকি ভাবিকে দেখানোর জন্য...!

আকরাম: প্র্যাকটিসই ছিল, আবার ওকেও দেখতাম (হাসি)। সে অবশ্য বেশিক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত না। তবে দেখত...। পরে তো ঢাকায় চলে এলাম খেলতে। খেলার ব্যাপারে পরিবার থেকে পুরো সমর্থন ছিল, বিশেষ করে আম্মা অনেক উৎসাহ দিতেন।

প্রশ্ন

আপনাদের যৌথ পরিবার ছিল। প্রচুর বন্ধুবান্ধবও নিশ্চয়ই ছিল চট্টগ্রামে। যখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন লিগ খেলতে, শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল?

আকরাম: খেলার জন্য ছোটবেলায়ই বাসা থেকে বের হয়ে গেছি, ’৮৪-৮৫ সালে হবে। ঢাকায় এসে প্রথম রেলওয়ে ক্লাবে খেললাম। চট্টগ্রামের বাসার পরিবেশ খুব মিস করতাম। শুরুর দিকে একা একা থাকতাম। আমি ছাড়া আমার ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে চট্টগ্রামের বাসাতেই থাকত। আমাদের বাসার কালচার ছিল, সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। বড় ভাইয়ের ফুটবল খেলার সুবাদে বাসায় তখন অনেক সুপারস্টার আসতেন। মুন্না ভাই তখন বাংলাদেশের সুপারস্টার, আশীষ ভাই, ইউসুফ ভাই, নান্নু ভাই, মঞ্জু ভাই—ওনারা চট্টগ্রামে গেলেই আমাদের বাসায় যেতেন। প্রচুর খাওয়াদাওয়া হতো। তো আমি সব ছেড়ে ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় অবশ্য ওনারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তবে ঢাকায় এসে আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেল। ঢাকায় খেলতে খারাপ লাগেনি, তবে একটা কথা কাউকে কখনো বলিনি—প্রথম প্রথম আমি অনেক কাঁদতাম। হোটেলে থাকতাম, খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হতো। তবু খেলাটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। অনেকে শুনে অবাক হবেন, জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আগে আমি কিন্তু কখনো বড় ক্লাবে খেলিনি। মনে আছে, রেলওয়েতে খেলে প্রথমবার দুই হাজার টাকা ও পরেরবার ছয় হাজার টাকা পেয়েছিলাম।

নিজের ব্যাটিংয়ের ছবির পেপার কাটিং যত্ন করে রেখে দিয়েছেন আকরাম খান
প্রশ্ন

ওই টাকা দিয়ে কী করেছিলেন, মনে আছে?

আকরাম: সোজা চলে গিয়েছিলাম ব্যাট-প্যাড কিনতে। রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার জাকির ভাই আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমার জীবনে আজ এই জায়গায় আসার পেছনে কিছু মানুষের অনেক অবদান আছে, জাকির ভাই সে রকমই একজন। উনিই আমাকে একটা দোকানে নিয়ে গিয়ে ওই টাকা দিয়ে ভালো ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস কিনে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন

ওগুলোই কি আপনার জীবনে প্রথম দামি খেলার জিনিস ছিল?

আকরাম: হ্যাঁ, চট্টগ্রামে তো আমরা ভালো জিনিসগুলো পেতাম না। তাই যখন টাকাটা পেলাম, ভাবলাম ভালো ব্যাট-প্যাড কিনি। ক্লাব থেকে দিনে এক-দুই শ টাকা দিত। সেটা দিয়ে খাওয়া হয়ে যেত। ওই সময়ই আমি ঢাকায় মোটামুটি সবার চোখে পড়ে গেছি। মোহামেডান আমাকে নিতে চাইল, সাইনও করেছিলাম। কিন্তু মোহামেডানে তখন খেলতে পারিনি; কারণ, তখন নিয়ম ছিল, একজন খেলোয়াড় যে ক্লাবের হয়ে প্রথম রেজিস্ট্রেশন করবে, সেই ক্লাবে তিন বছর খেলতে হবে। আমি তাই রেলওয়েতেই খেলেছি।

প্রশ্ন

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন নতুন খেলোয়াড় হিসেবে। তারপর ক্যারিয়ারটা কীভাবে ঘুরে গেল, কীভাবে তারকা হয়ে উঠলেন?

আকরাম: আমার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্টটা এনে দিয়েছিলেন ফুটবলার আশীষ ভদ্র। উনি আমাকে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছিলেন। আশীষ ভাই আমাকে একদিন বললেন, ‘ঢাকা লিগে আবাহনীর মতো ভালো পরিবেশ কোথাও পাবে না। তুমি আবাহনীতে খেলো।’ আমি খুশিমনে রাজি হয়ে গেলাম। ওই সময় আমাকে মোহামেডান চাইছিল, বিমানও চাইছিল, রূপালী ব্যাংক চাইছিল। এই দলগুলো খুবই ভালো ছিল তখন। তো আশীষ ভাইয়ের সঙ্গে আমি গেলাম আবাহনীতে। উনি তখন আবাহনীর সুপারস্টার, যেখানেই যান ওনার পেছনে দু-তিন শ লোক থাকত। তখন আবাহনীর ফুটবল প্র্যাকটিসে যত লোক হতো, আবাহনীর ক্রিকেট ম্যাচেও তত লোক হতো না। আবাহনী ক্লাবে আসার পর আমার অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো। বিশেষ করে মামুন ভাই, তামিম ভাই, আরেকজন ছিলেন ফয়েজ ভাই। ফয়েজ ভাই মারা গেছেন। বলতে পারেন, উনি আমার অভিভাবকই ছিলেন। ওনার স্নেহ না থাকলে আমার এই জায়গায় আসা কঠিন হতো। ওনাদের কারণে আবাহনীতে গিয়ে আমার জীবনটা আরেকবার বদলে গেল। তখনই তারকা হওয়ার শুরু।

আকরাম খান যখন বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন
প্রশ্ন

‘আকরাম খান’ নামটা তো এরপর বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু ক্রিকেট খেলে কোনো দিন তারকা হবেন, এ রকম লক্ষ্য কি ছিল আপনার? নাকি খেলতে খেলতে হয়ে গেছেন?

আকরাম: দেখুন, আমি যখন ক্রিকেট খেলছি, তখন কিন্তু জাতীয় দলে খেলার কোনো লক্ষ্য ছিল না। কারণ, জাতীয় দল বছরে খেলতই দু-তিনটা ম্যাচ। এমসিসি আসত, হায়দরাবাদ ব্লুজ আসত। মাঠে ও রকম দর্শক হতো না। আসল খেলা হতো আবাহনী-মোহামেডানের। এই ম্যাচ ঘিরেই ছিল সব আগ্রহ, উত্তেজনা। সময় সবকিছুই পরিবর্তন করে দেয়। আমি একদিন জাতীয় দলের অধিনায়ক হব, এটা তো কোনো দিন চিন্তাই করিনি। তবে সব সময় চাইতাম, যেখানে খেলব, ভালো খেলব। আব্বা ব্যবসা করতেন, ক্রিকেট না খেললে আমিও হয়তো ব্যবসা করতাম। তবে আমি ফুটবলও খুব পছন্দ করতাম। আমার বড় ভাই তখন ফুটবলার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। মনে আছে, চট্টগ্রামের মাঠে একদিন ফুটবল প্র্যাকটিস করছিলাম। মুন্না ভাই (প্রয়াত মোনেম মুন্না) সেদিনই আমাকে প্রথম মাঠে দেখে জানতে চান, ‘ওই মোটাটা কে?’ আমার ফুটবল খেলা তাঁর পছন্দ হয়েছিল। অন্যরাও বলত, আমি ফুটবল ভালো খেলি। তবে ক্রিকেটে আমি খুব ভালো মারতে পারতাম। তখন তো ওভারে তিন-চার রান করে হতো। কিন্তু আমি অনেক মেরে খেলতাম। কিছু দর্শক ছিল যারা শুধু আমার ব্যাটিং দেখতে মাঠে আসত। তাদের অপেক্ষাই ছিল—আকরাম কখন ব্যাটিং করতে নামবে? বাংলাদেশ ১৫০ রান করলেই সবাই খুশি, কিন্তু আমি মেরে খেলব—এটাই চাইত সবাই। আমার এ রকম দর্শক যখন আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল, আমি তাদের আনন্দ দিতেই খেলতে লাগলাম। ওদের জন্য খেলাটা হয়ে দাঁড়াল আমার দায়িত্ব। দর্শক-সমর্থকদের জন্য হলেও আমাকে ভালো খেলতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা বেড়েছে, খেলাই হয়ে গেল জীবন।

প্রশ্ন

আপনার সমসাময়িক আমিনুল ইসলাম, মিনহাজুল আবেদীন—তাঁদেরও তো নিশ্চয়ই আলাদা দর্শক-সমর্থক ছিল। ভক্ত-সমর্থকের দিক দিয়ে আপনাদের মধ্যে কে বেশি এগিয়ে ছিলেন? এ নিয়ে কি নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতো?

আকরাম: সত্যি বলতে কি, আমি নিজেই নান্নু ভাইয়ের অনেক বড় ফ্যান ছিলাম। নান্নু ভাই, নোবেল ভাই, মাসুদ ভাই—চট্টগ্রামে আমাদের সবার বাসা খুব কাছাকাছি ছিল। ওনাদের খেলা হলে আমি চলে যেতাম দেখতে। আমি যখন খেলা শুরু করি, তখন কিন্তু নান্নু ভাই সুপারস্টার। উনি সিনিয়র ছিলেন, আমি ওনাকে একটু ভয়ই পেতাম। অনেক উঁচুমানের ব্যাটসম্যান ছিলেন নান্নু ভাই। কার ভক্ত বেশি, নিজেদের মধ্যে কী ধরনের কথা হতো, এখন আর সেভাবে মনে নেই; তবে নিশ্চয়ই হয়েছে। তখন তো এগুলোই ছিল আলোচনা। নোবেল ভাই সিনিয়র হলেও ওনার সঙ্গে অনেক দুষ্টুমি করতাম। আমরা অনেক দিন, ১৩-১৪ বছর ধরে একসঙ্গে খেলেছি। আমাদের ভক্তও অনেক ছিল। একটু লম্বাচওড়া ছিলাম বলে এদিক দিয়ে মনে হয় আমি একটু এগিয়ে ছিলাম (হাসি)। ৬ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা তো আমি!

লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে আকরাম খান–আমিনুল ইসলামরা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সময়
প্রশ্ন

আপনার যে শারীরিক গড়ন, শুরু থেকে সবাই আপনাকে এমনই দেখে আসছে। কিন্তু যে আকরাম খানকে চেনে না, হঠাৎ দেখায় ভাবতে পারে, আপনি কীভাবে ক্রিকেট খেলেছেন! যদিও মাঠে আপনার খেলায় আমরা কখনো এর প্রভাব দেখিনি। এটা কীভাবে মেইনটেইন করতেন?

আকরাম: আমার ওজন সব সময়ই বেশি। ক্লাস সেভেনের পর থেকেই আমি ওভারওয়েট। আমাদের বাসায় খাওয়াদাওয়া অনেক বেশি হতো, নিজেরা খেতাম, মেহমান এলে খেতাম। তো এই খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেলে যা হয় আরকি...।

প্রশ্ন

আপনি তাহলে বলছেন, বেশি খেয়েই ওভারওয়েট হয়েছিলেন, এটা বংশগত কিছু নয়...

আকরাম: আমাদের পরিবারের সবার হাইট ভালো ছিল। সবই ঠিক ছিল, তবে আমাদের বেশির ভাগ ফ্যামিলি মেম্বার ওভারওয়েট ছিল এবং সেটা খাদ্যাভ্যাসের জন্যই। গরুর মাংস প্রচুর চলত, বিরিয়ানি, পরোটা, সব ধরনের রিচ ফুড...। চিটাগংয়ের মানুষ গরুর মাংসটাই বেশি পছন্দ করে। কালাভুনা বলেন, মেজবানি মাংস বলেন...। এমন নয় যে কোনো উৎসব উপলক্ষে, এমনিতেই এসব খাওয়া হতো। আগেই বলেছি, ভাইয়া ছিলেন ফুটবলার। প্রতি সপ্তাহে ২০-২৫ জন ফুটবলার আসতেন আমাদের বাসায়। ওনারা এলেই বাসায় খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হতো, মেজবান হতো। বাসায় এসবের জন্য বাবুর্চি ছিল।

আইসিসি ট্রফি হাতে আকরাম খান
প্রশ্ন

তো এত খাওয়া, ভারী শরীর...এগুলো তো খেলাধুলার সঙ্গে যায় না। তারপরও আপনি খেলোয়াড়ই হলেন?

আকরাম: আমার প্লাস পয়েন্ট ছিল, আমি ফুটবল অনেক বেশি খেলতাম। ফুটবলারদের সঙ্গে অনুশীলন করতাম। খুব এনজয় করতাম ফুটবলটা। শুনলে অবাক হবেন, আমার শুরুতে ফুটবলার হওয়ারই ইচ্ছা ছিল। ফুটবলে অনেক ইতিহাসও আছে আমার। তবে বললে হয়তো অনেকে হাসবেন, আমি মোটা বলে ফুটবল খেলতে আমার লজ্জা লাগত। বলতে পারেন এটাও কারণ আমার ফুটবলার না হওয়ার। মোটা হওয়ায় আমি বেশি মানুষের সামনে যেতে লজ্জা পেতাম। যাদের সঙ্গে কমফোর্টেবল ছিলাম, তাদের সঙ্গে খেলতেই ভালো লাগত। নতুন মানুষের কাছে যেতে বিব্রত হতাম। এখন তো আশপাশে অনেক মোটা লোক, তখন কিন্তু মোটা মানুষ এত বেশি ছিল না। যারা মোটা, তারা অটোমেটিক আলাদা হয়ে যেত। সবাই তাদের আলাদা চোখে দেখত।

প্রশ্ন

ক্রিকেট ভালোই খেলেছেন, একসময় বাংলাদেশের ক্রিকেটের মুখ ছিলেন আপনি। তবু কখনো কি মনে হয়নি শারীরিক কারণে খেলতে সমস্যা হচ্ছে? ফুটবল খেলতেও কি সমস্যা হতো না? ওটা তো অনেক পরিশ্রমের খেলা...

আকরাম: শুনুন, চট্টগ্রাম সেকেন্ড ডিভিশন ফুটবলে আমার হ্যাটট্রিকও আছে। স্ট্রাইকার ছিলাম আমি। আমার লং রানিংয়ে সমস্যা ছিল। এক ঘণ্টা দৌড়ানো আমার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু স্প্রিন্টে খুব ভালো ছিলাম। আমি ফার্স্ট ডিভিশনেও খেলতে পারতাম। ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার অফার ছিল আমার। তা না খেলে সেকেন্ড ডিভিশনে কেন খেলেছি, সেটাও বলি আপনাকে (হাসি)। ফার্স্ট ডিভিশনের খেলা হতো বিকেলে, প্রচুর লোক আসত খেলা দেখতে। লজ্জায় তাই আমি ফার্স্ট ডিভিশনে খেলতাম না। এত মানুষের সামনে খেলতে আমার লজ্জা লাগবে। সেকেন্ড ডিভিশনের একটা ম্যাচ হতো সকালে, আরেকটা বিকেলে। শতদল ক্লাবের হয়ে আমি শুধু সকালের ম্যাচটা খেলতাম। কারণ, সকালে অত বেশি দর্শক মাঠে আসত না। আর তখন হাফপ্যান্ট পরাও অনেক বড় ব্যাপার ছিল। যারা খেলাধুলায় ছিল, ওরাই শুধু হাফপ্যান্ট পরত। এর বাইরে কাউকে হাফপ্যান্ট পরতে দেখা যেত না। এখন আমরা থ্রি–কোয়ার্টার পরি, তখন ওটাও ছিল না। যা–ই হোক, ফুটবলটা এ রকমই গেল। তারপর তো ক্রিকেটে সিরিয়াস হয়ে গেলাম।

ভাতিজা তামিম ইকবালের সঙ্গে আকরাম খান
প্রশ্ন

কখনো ওজন কমাতে চেষ্টা করেছেন? ভারী শরীরের মানুষদের বেলায় একপর্যায়ে এটা খুব কমন ব্যাপার। বা মনে হয়নি, ফিটনেস আরেকটু বাড়ালে ভালো হবে?

আকরাম: ও রকম মনে হয়নি। আমার মোটা হওয়াটা খেলাধুলায় কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। আসলে ফিটনেস অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলও না তখন। পারফর্ম করতে পারলেই হতো। তারপরও আমি ফিটনেস নিয়ে কাজ করতাম, অনেক প্র্যাকটিস করতাম। আবাহনী ক্লাবে প্র্যাকটিস হতো বেলা ২-৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। কিন্তু আমি সকাল ছয়টায় উঠে যেতাম। লোক ঠিক করে রাখতাম প্র্যাকটিসে আমাকে সাহায্য করার জন্য। তবে হ্যাঁ, আমি ভাবতাম, সুন্দর দেখানোর জন্য আমাকে পাতলা হতে হবে। কোথাও গেলে লজ্জা লাগত, সবাই তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। ১৯৯৮ সালের দিকে তো আমি অনেক বেশি মোটা হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা আসলে তখন বুঝতামও না যে কীভাবে ওজন কমাতে হবে, পথটা কী? আস্তে আস্তে আমরা ট্রেনার পেলাম, ফিজিও পেলাম। শ্রীলঙ্কায় ১৯৯৭–এর এশিয়া কাপ খেলতে গিয়ে আমার ব্যাকে একটা সমস্যা হলো। তখন ফিজিও বলল যে ওভারওয়েটের কারণে এটা হচ্ছে। আমাকে বলল, ‘তুমি চিনি খাওয়া ছেড়ে দাও।’ ১৯৯৯–এর বিশ্বকাপ যখন খেলতে যাই, তখন আমার ওজন ১০৩ কেজি। ১৯৯৮ সালে ছিল ১১৯ কেজি। এখন ১০৫ থেকে ১০৭ কেজি থাকে।

প্রশ্ন

এখন তো আপনি খুব স্বাস্থ্যসচেতন। নিয়মিত এক্সারসাইজ করেন, বুঝেশুনে খান...

আকরাম: তারপরও এখনো সাত-আট কেজি ওজন বেশি আছে আমার। নিয়মিত হাঁটি, জিম করি। যে পরিমাণ চাপ নিতে হয়; কিছু ওয়ার্কআউট করলে শরীর, মন দুটোই ভালো থাকে। সারা দিনে যেকোনো সময় নিজেকে যদি এক ঘণ্টা সময় দেওয়া যায়, সেটা আপনাকে অনেক ভালো রাখবে। আমি যখন ইকবাল রোডে থাকতাম, তখন হাঁটার অভ্যাসটা একজনের কারণে হয়েছে। এহসান ভাই, উনি একজন ডাক্তার। আমাকে সব সময় হাঁটার জন্য উৎসাহ দিতেন। বলতেন, সাত দিন হাঁটলেই দেখবেন সারা জীবনের জন্য অভ্যাসটা হয়ে গেছে। সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। স্পোর্টসম্যানরা বেশির ভাগ দেখবেন...বিশেষ করে আমাদের সময়ের, খেলা ছাড়ার পর মোটা হয়েছে। ৮০ শতাংশ সাবেক খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য।

প্রশ্ন

কিন্তু খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে একটা যোগাযোগ তো এখনো রেখেছেন। চট্টগ্রামে আপনাদের পারিবারিক রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, ঢাকায় আপনার রেস্টুরেন্ট ক্রিকেটার্স কিচেন তো খুব জনপ্রিয়...

আকরাম: (হাসি) ওইটা ইনশা আল্লাহ আমরা বন্ধ করব না (চট্টগ্রামের রেস্টুরেন্ট)। ওইটা আমার আব্বার প্রথম ব্যবসা। ঢাকারটাও থাকবে।

আকরাম খানের রেস্টুরেন্ট ক্রিকেটার্স কিচেন অ্যান্ড ক্যাফে
প্রশ্ন

অবসরে কী করতে ভালো লাগে?

আকরাম: পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। ১৯৯০ সালের আইসিসি ট্রফি খেলতে হল্যান্ডে গিয়েছিলাম। সেখানে ৪০ দিন থাকার পরও ফেরার সময় আমি আর নান্নু ভাই ছাড়া সবাই ইংল্যান্ডে রয়ে গেল বেড়াতে। আমার যদি কোনো কাজ না–ও থাকে, তবু আমি পারিবারিক অনুষ্ঠান ছাড়া বাইরে খুব একটা যাই না। মেয়েরা এখন বাইরে থাকে, বাসায় স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোটাই বেশি পছন্দ করি। হ্যাঁ, চাপে থাকলে বা কোনো কারণে মন খারাপ হলে হাঁটি বা পরিবারের সঙ্গে বসে কথা বলি। এটা আমাদের চট্টগ্রামের কালচার—সবাই একসঙ্গে মিলে সময় কাটানো। আমি সবকিছু নিয়েই সাবিনার সঙ্গে আলোচনা করি, কথা বলি। ও যদি একটা কিছু নিয়ে পজিটিভ কিছু বলে, তখন মনটা অনেক ভালো হয়ে যায়। আগে তো যখনই বাইরে যেতাম, আম্মাকে নিয়ে যেতাম। আমি কিন্তু খুব কমই একা বিদেশে গিয়েছি। আম্মা কখনো না গেলেও সব সময় আমার স্ত্রীকে নিয়ে গেছি। আমি দেখেছি, একা আমি ঘুরতে পারি না। পরিবার নিয়ে ঘুরতে, শপিং করতেই বেশি উপভোগ করি।

আকরাম খানের দুই মেয়ে
প্রশ্ন

বেশি ভালো লেগেছে কোন দেশ?

আকরাম: পরিবারের সঙ্গে গেলে সব দেশই ভালো লাগে। তারপরও আলাদা করে বললে বেশি ভালো লেগেছে নিউজিল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে এসব জায়গায় বেশি দিন থাকাটা বোরিং। এখন অবশ্য কিছু জিনিস বদলেছে। মেয়েরা ইংল্যান্ডে, কানাডায় আছে। এখন ওদের কাছেই বেশি যাই।

প্রশ্ন

আপনার ব্যাপারে ভাবির জাজমেন্টগুলোকে খুব গুরুত্ব দেন মনে হয়...

আকরাম: অবশ্যই। অনেক সময় ওর অনেক কথায় আমি হঠাৎ অনেক খেপে যাই, কিন্তু পরে দেখা যায় যে সে-ই ঠিক ছিল। খেলোয়াড়ি জীবনের একটা ঘটনা বলি। গাড়ি চালিয়ে একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাচ্ছি। তো কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে বলল, ‘তুমি চিটাগং ক্লাবের মেম্বার হবা...।’ জানি না কে কীভাবে নেবেন, ক্লাবের মেম্বার হওয়াটাকে আমি তখন ভালো ভাবতাম না। ওর কথা শুনে আমি রেগে গিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতেই জানালার গ্লাসে জোরে ঘুষি মারলাম, গ্লাস ফেটে গেল। আমার রাগ দেখে সে কেঁদে দিয়েছিল। পরে আমি ঠিকই মাত্র ২০ হাজার টাকায় ক্লাবের মেম্বার হয়েছি, যেটাতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। পরে বুঝেছি, ক্লাবের মেম্বার হওয়াটা খারাপ কিছু নয়। খাওয়ার কথা বলি। আমি আগে মাছ খেতাম না। মাংসই ছিল আমার পছন্দ। মাছ যে এত মজার জিনিস, অনেক বছর পর্যন্ত আমি সেটা জানতাম না। এটা ঝোল দিয়ে রান্না হতে পারে, সে ধারণাও ছিল না। আমার পছন্দের খাবার এখনো যদিও পরোটা-মাংস, তবে এখন সেটা অনেক নিয়ন্ত্রিত। ঢাকায় আসার পর থেকে আমার স্ত্রী–ই আমাকে খাওয়া কন্ট্রোল করতে উৎসাহ দেয়। সে–ই আমাকে মাছ খাওয়া শিখিয়েছে। জীবনে এত খেয়েও আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত তো সুস্থ আছি। এ রকম অনেক কিছু...পরিবার, ব্যবসা, বাচ্চাদের পড়াশোনা—বেশির ভাগই ওর পরিকল্পনা থেকে হয়েছে। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য ঢাকায় এলে ভালো হবে, এটা আমার মাথায় আসেনি কখনো। ওদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, এগুলো সে–ই করেছে। আমি বিশ্বাস করি, ভালো বউ পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার।

স্ত্রীর সঙ্গে বিদেশে আকরাম খান
প্রশ্ন

আপনার কি চিন্তা ছিল, খেলা ছাড়ার পর চট্টগ্রামেই থিতু হবেন?

আকরাম: হ্যাঁ, খেলা ছাড়ার পর চট্টগ্রামে থাকব, ওখানে ব্যবসা করব, আবার সেই খাওয়াদাওয়া (হাসি)। অন্যভাবে চিন্তা করিনি কখনো। আমি এই চিন্তাও করিনি যে আমার বাচ্চারা কোথায় পড়বে। যখন ঢাকায় এলাম, আমি ‘জিরো’ ছিলাম। পরে আস্তে আস্তে সব হলো।

প্রশ্ন

পরিবারই আপনার প্রথম ও শেষ কথা। তারপরও মানুষের জীবনে তো আরও কিছু নেশা থাকে। গান শোনা, বেড়ানো, বই পড়া বা অন্য কিছু। আপনার সে রকম কিছু নেই, যেটা একা করতে ভালো লাগে?

আকরাম: গান প্রচুর শুনি। মাথার ভেতর কোনো একটা গান ঢুকে গেলে সেটাই বাজতে থাকে। লতা, কিশোর কুমারের গান অনেক পছন্দ। আদনান সামির গানও খুব ভালো লাগে। আরেকটা জিনিস আছে ভালো লাগার, একা বসে থাকা। এটা আমার খুব পছন্দের একটা সময় কাটানোর পদ্ধতি। চিটাগংয়ে গেলে চিটাগং ক্লাবে হাঁটতে যাই। একটু দেরিতে যাই, রাত ৮টার দিকে। ওখানে একটা নিরিবিলি জায়গা আছে। ৯টার পর আমি ওখানে গিয়ে একা বসে কিছু সময় কাটাই। নানা রকম চিন্তা মাথায় আসে তখন। অফিসে বা ব্যস্ততার মধ্যে অনেক কিছু ভাবা যায় না। একটার মধ্যে আরেকটা চলে আসে, ফোন চলে আসে, লোক চলে আসে। কিছু সময় একা কাটালে সেই সুযোগটা পাওয়া যায়। আমি মনে করি, প্রত্যেকের নিজেকে এই সময়টা দেওয়া দরকার। আমার যখন নিজের বাসা হলো, আমি একটা আলাদা ঘর রেখেছি, যেখানে একটু চুপচাপ সময় কাটানো যায়।

আকরাম খানকে বিসিবির বিভিন্ন দায়িত্বে দেখা গেছে
প্রশ্ন

শেষ প্রশ্ন, এবার তো বিসিবির নির্বাচন করলেন না। সেটাও কি পরিবার আর নিজেকে আরও সময় দিতেই?

আকরাম: সে রকম কিছু নয়। ক্রিকেটে সময় দেওয়াটা ম্যানেজ করে নেওয়া যায়। আসলে আমার কাছে মনে হচ্ছিল, গত এক-দেড় বছরে ক্রিকেটের পরিবেশটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর আমার পরিচিতির জন্য ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হওয়ার দরকারও নেই। আমি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলাম, চার বছর নির্বাচক ছিলাম, দুই বছর প্রধান নির্বাচক ছিলাম, তারপর পরিচালক হলাম। আমি আকরাম খান বাংলাদেশের ক্রিকেটে সব সময়ই ছিলাম। তবে এখন মনে হয় আমার থাকাটা উচিত নয়। অনেক জায়গায় আমি খুব অপমানিত বোধ করেছি, অনেক জায়গায় নিজেকে ছোট মনে হয়েছে। সে কারণেই আমি চেয়েছি এগুলো থেকে দূরে থাকতে। খেলা ছাড়ার পর আমি যদি নির্বাচক না হতাম, ক্রিকেট বোর্ডে না আসতাম; আমার বিশ্বাস, তবু বাংলাদেশের মানুষ একজন ক্রিকেটার হিসেবেই আকরাম খানকে চিনত। সেই জিনিসটাই আমি ধরে রাখতে চাই। ওটাই আমার আসল পরিচয়।