আইফোনের সিরি এবং মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ ও হ্যালোর করটানা সবচেয়ে পরিচিত ডিজিটাল ব্যক্তিগত সহকারী। প্রশ্ন করলে নারী কণ্ঠে আসে উত্তর, যেন সত্যিকারের কোনো মানুষই কথা বলছে। কখনো কখনো পুরুষ কণ্ঠও কথোপকথন চালায়। কখনো কি ভেবেছেন, যান্ত্রিক এই কণ্ঠের আড়ালের মানুষ আসলে কে? এ কণ্ঠ কি প্রোগ্রামিং সংকেত লিখে লিখে তৈরি, নাকি কোনো মানুষই কথা বলেছেন এই যান্ত্রিক ব্যবস্থায়।

সুজান বেনেট
সিরি
২০১১ সালে স্টিভ জবসের মৃত্যুর ঠিক এক দিন আগে ৪ অক্টোবর পঞ্চম আইফোন হিসেবে আইফোন ৪ এস প্রকাশ করা হয়। স্মার্টফোনটির সঙ্গে যুক্ত করা হয় ‘সিরি’র পরীক্ষামূলক সংস্করণ। আইফোন হাতে নিয়ে উপস্থাপক যখন জিজ্ঞেস করেন, আজ কি বৃষ্টি হবে? নারী কণ্ঠে সিরি উত্তর দেয়, ‘আজ বৃষ্টি হবে বলেই মনে হচ্ছে।’ করতালিতে ফেটে পড়ে অ্যাপলের কুপার্টিনো মিলনায়তন। এরপর থেকে আইফোনের প্রতিটি সংস্করণেই সিরি ব্যবহারকারীর নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আসছে। আত্মবিশ্বাসী দৃঢ় যে কণ্ঠে প্রশ্নগুলোর উত্তর আসে, পর্দার আড়ালের সে মানুষটি কে?
মানুষটি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার কণ্ঠদাতা সুজান বেনেট। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম থেকে শুরু করে বিমানবন্দর বা টেলিফোনের স্বয়ংক্রিয় কণ্ঠে ঘোষণা, অসংখ্য বিজ্ঞাপন, ভিডিও গেমস কিংবা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সদ্য ৬৭ বছরে পা দেওয়া সুজান বেনেট এখনো উদয়াস্ত কাজ করেন। পেশাটি যে তাঁর খুব পছন্দের।
৩১ জুলাই ছিল সুজানের জন্মদিন। সেদিন ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে কিছুটা সময় চেয়ে নেন তিনি। পরে প্রথম আলোকে জানালেন তাঁর সিরি হয়ে ওঠার পেছনের কথা। শুরুতেই রসিক সুজান মজা করে লেখেন, ‘হ্যালো বাংলাদেশ! সিরি ওয়ান্ট টু নো হাউ ক্যান শি হেল্প ইউ?’
শুরুটা সেই ২০০৫ সালে। আইফোন তখনো কল্পনার বাইরে। স্ক্যানসফট নামের প্রতিষ্ঠান সুজানকে তাদের কাজের জন্য পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে জানানো হয়েছিল লেখা থেকে কথা (টেক্সট-টু-স্পিস) সফটওয়্যারে ব্যবহারের জন্য আমার কণ্ঠ দরকার। ২০০৫-এর জুলাইয়ের প্রতিটা দিন একটানা চার ঘণ্টা কাজ করেছি।’
কাজ করেছেন, পারিশ্রমিক পেয়েছেন। তারপর ভুলে গেছেন সে কথা। এরপর ২০১১ সালে আইফোন ৪ এস বাজারে আসে। উদয়াস্ত মানুষ সিরির মাধ্যমে সুজানের কণ্ঠে উত্তর পাচ্ছেন। কিন্তু সুজান এর কিছুই জানতেন না। একদিন এক সহকর্মী তাঁকে ই-মেইলে জানান, সিরির কণ্ঠটি কি তোমার? সে সময় সুজানের হাতে নতুন আইফোন না থাকায় অ্যাপলের ওয়েবসাইট ঘেঁটে সিরির ওপর নির্মিত ভিডিও চিত্র দেখে বুঝতে পারেন যে তিনিই সিরি।
আইওএসের সপ্তম সংস্করণ থেকে নারী কণ্ঠের পাশাপাশি যোগ করা হয় পুরুষ কণ্ঠ। ব্রিটিশ কণ্ঠদাতা জন ব্রিগসের কণ্ঠ এটি। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ান কণ্ঠদাতা ক্যারেন জ্যাকবসন কণ্ঠ দিয়েছেন সিরির অস্ট্রেলীয় সংস্করণে।
জেন টেইলর
করটানা
যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠদাতা জেন টেইলরের কণ্ঠে কথা বলে মাইক্রোসফটের করটানা কথাগুলো। এক সাক্ষাৎকারে জেন বলেন, ‘আমিই করটানা, করটানাই আমি। শুরুতে এটা আমার জন্য জীবিকার মাধ্যম হলেও দীর্ঘ এক যুগের পথচলায় আমরা এখন এক হয়ে গেছি।’ এক যুগ? কেমন যেন খটকা লাগে! তবে যারা কম্পিউটার গেম খেলেন, তাঁরা নিশ্চয় বুঝে গেছেন কে এই জেন টেইলর ওরফে করটানা। হ্যালো সিরিজের গেমগুলোর জনপ্রিয় চরিত্রের নাম করটানা। গেমের মাঝেও করটানা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক সহকারী—সবকিছুই যার জানা। জেন টেইলর কণ্ঠদাতা হলেও অভিনয়েও দেখিয়েছেন দক্ষতা। ৪২ বছর বয়সী করটানার জন্ম ওয়াশিংটনের সিয়াটলে, সেখানেই বেড়ে ওঠা।
যেভাবে কাজ করে
কণ্ঠদাতাদের কাজের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন সুজান বেনেট। প্রতিটা স্বরধ্বনির সঙ্গে প্রতিটা ব্যঞ্জনধ্বনির সমন্বয়ে যত ধরনের উচ্চারণ সম্ভব, তার সবই তাঁরা ধারণ করা হয়। সঙ্গে সম্ভাব্য উত্তর হিসেবে পূর্ণাঙ্গ বাক্যও ধারণ করা হয়। সেগুলোকে ডেটাবেজে রাখা হয়। কেউ যখন সিরিকে কোনো প্রশ্ন করেন তখন ডেটাবেজে সংরক্ষিত পূর্বনির্ধারিত কোনো বাক্য উত্তর হিসেবে দেওয়া হয়। যেখানে পূর্বনির্ধারিত বাক্য ধারণ করা হয়নি, সে ক্ষেত্রে অ্যালগরিদম এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যাতে ডেটাবেজে থাকা বিভিন্ন অক্ষরের সমন্বয়ে উচ্চারণগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে বাক্য তৈরি করা যায়।