মোটরসাইকেল বা গাড়ির যন্ত্রাংশ দরকার? একটা কথাই মাথায় চলে আসবে সবার—ধোলাইখাল। পুরান ঢাকার বিখ্যাত এ জায়গা দিন-রাত গমগম করছে বিভিন্ন ধরনের পুরোনো যন্ত্রাংশের পসরা নিয়ে। তৈরি হচ্ছে সম্পূর্ণ দেশীয় কায়দায় জটিল সব যন্ত্র। তার চেয়েও জটিল এখানকার জীবন। চলুন ঘুরে আসা যাক অন্য এক ধোলাইখাল থেকে

মানুষটার বয়স আন্দাজ করা কঠিন। চামড়ায় বয়সের ছাপ নেই, চোখজোড়া যথেষ্ট উজ্জ্বল। অথচ মুখের সামনের পাটিতে বেশ কয়েকটি দাঁতের বেমানান অনুপস্থিতি। ১৪ মে দুপুর ১২টায় ধোলাইখালে পা রাখার পর থেকেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন আমাদের। ততক্ষণে আমরা পুরান ঢাকার বিখ্যাত ধোলাইখালের ‘টং মার্কেটের’ এ মাথা টু ও মাথা চক্কর দিয়ে এসেছি। চক্কর শেষে আবার গলির মুখটায় আসার পর বয়স আন্দাজ করতে না পারা ওই মানুষটির প্রশ্ন, ‘মামা, বরবটি, পুঁইশাক লাগবনি?’ প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্ত লাগল আসলে কী বলতে চাইছেন। রসিকতা বোঝার পরই হাসিমুখে উত্তর দিলাম আমরা, ‘লাগবে, কেজি কত করে?’ রসিক দোকানি ঠিক তাঁর উল্টো দিকের মতিন মোটরসের দিকে তর্জনী তাক করলেন, ‘মতিন মামুরে জিগান।’ বলেই গলা বাড়িয়ে মতিন মামুর উদ্দেশে তাঁর হাঁক, ‘মামু, তোমার বরবটির কাস্টমার আইসা গেছে!’ আমরা ততক্ষণে ‘মতিন মামুর’ তিন বাই বারো ফুটের ছোট্ট দোকানটার সামনে।
বরবটি, পুঁইশাক ও গলার মালা
চোখে চশমা, মুখে মানানসই গাম্ভীর্য। পরনে গাঢ় সবুজ ও ছাই রঙের হাফহাতা শার্ট। দোকানের পরিবেশের সঙ্গে যেন ‘ক্যামোফ্লেজ’ করে বসে আছেন মতিন মামু। আসল নাম মো. মতিন। তাঁর দোকানের ভেতরটায় একবার চোখ বোলালেই ‘বরবটি, পুঁইশাক’-রহস্যের জট খুলে যায়। মোটরসাইকেলের বিভিন্ন তার যেভাবে পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছেন, তাতে করে একটু কল্পনাপ্রবণ হলেই সেটাকে দিব্যি বরবটি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। কিংবা মোটরসাইকেলের বিভিন্ন আকারের বল্টুগুলো যেভাবে সুতা দিয়ে গাঁথা হয়েছে, তাতে করে একেকটা মালাকে প্রাচীন আমলের রাজা-বাদশাহদের গলার মালা ভাবাও খুব কঠিন নয়। এমন যান্ত্রিক শাকসবজি কিংবা অলংকারের দেখা মিলল পুরো টং মার্কেটেই। থরে থরে সাজানো বিয়ারিং কিংবা হেডলাইট; লোহার পাত্রে ছড়িয়ে রাখা নাট-বল্টু কিংবা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ যেন চাল-ডালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য। আসলেই এসব যন্ত্রাংশ এখন নিত্যপ্রয়োজনীয়। সারা দেশের মোটর মেকানিকেরা তাকিয়ে থাকেন ধোলাইখালের দিকেই। এখানকার পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়েই সারাই করা হচ্ছে দেশের প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল ও ছোট-বড় নানা ধরনের গাড়ি।
কোথা থেকে আসে ‘নাট’, কোথায় চলে যায়
নিবিষ্টমনে ট্রেতে ছড়িয়ে রাখা নাট-বল্টুতে তেল মাখছিলেন মনির হোসেন। বয়স আন্দাজ করেই তাঁর সামনে হাজির আমরা। ১৯৭৬ সাল অর্থাৎ ধোলাইখালের এ বাজারের শুরুর দিক থেকেই দোকান খুলে বসেছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব মনির হোসেনের ভাষায়, ‘চোখের সামনেই তো দেখলাম ক্যামনে এই মার্কেট দাঁড়ায় গেল। প্রথম প্রথম মাটিতে মাদুর পাইতা আমরা বইতাম টুকটাক যন্ত্রপাতি লইয়া। তারপর আস্তে-ধীরে একটা-দুইটা টং দোকান বইতে শুরু করল। এখন তো মনে হয় এইখানে প্রায় ছয়-সাত হাজার দোকান আছে। প্রতিটা দোকানে ধরেন কমসে কম তিন-চারজন কইরা কাজ করে। হিসাবটা মিলায়া লন তাইলে।’
আমরা হিসাব মিলিয়ে দেখি, অঙ্কটা আসলেই অনেক বড়। এত মানুষের জীবিকার কাঁচামাল মানে এই যন্ত্রপাতিগুলো আসে কোত্থেকে? ‘বেশির ভাগই আসে দেশের বাইরে থেকে।’ বলছিলেন বাদল মোটরসের মালিক সেলিম
আহাম্মেদ, ‘তার মধ্যে আছে জাপান, ইংল্যান্ড, দুবাই, সিঙ্গাপুর। আর কিছু আসে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। পুরোনো অকেজো মোটরগাড়ি থেকে খুলে নেওয়া হয়। এসবের মধ্যে কিছু যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকে, আমরা ঠিক করে নিই। বাকিগুলা একটু ঘষা-মাজা করলেই চলে যায়।’
ঝরনা শরবতে স্বস্তির ধারা
ধোলাইখালের পুরোনো যন্ত্রাংশের এ বাজারের আয়তনের কোনো গাছ-পাথর নেই। রাস্তার দুই ধারে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি অংশে বিভক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে এটি। একেক অংশে মেলে একেক ধরনের যন্ত্রাংশ। কোনো মার্কেটে মেলে নাট-বল্টুর মতো খুচরা যন্ত্রাংশ, কোনোটাতে আবার গাড়ির প্রধান যন্ত্র। একেক দোকানের একেক আকার। তবে যন্ত্রাংশের দোকানগুলোর অধিকাংশই টং আকৃতির, বড়জোর পাঁচ বাই বারো ফুটের ভেতর। বড় যন্ত্রাংশের দোকানগুলো আকারে বড়। কোনো কোনোটির দুটি করে ইউনিট, একটি বিক্রয়কেন্দ্র, অন্যটি স্টোররুম। প্রতিটি দোকানই একটার সঙ্গে আরেকটা লেগে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। মাথার ওপরে শেষ বৈশাখের খরতাপ, যন্ত্রের টুং-টাং, খুটখাট, খ্যারখ্যার, ক্যারক্যার শব্দ, মানুষের কোলাহল, ঘাম, হাসি-ঠাট্টা—সব মিলিয়ে গরমাগরম পরিস্থিতি। তার মধ্যে একটুখানি স্বস্তির ধারা যেন ‘ঝরনা রানীর লাচ্ছির দোকান’। প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো এ দোকান জমজমাট সকাল সাতটা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। ধোলাইখালের এমন কেউ নাকি নেই যে ঝরনা রানীর শরবতে গলা ভেজায়নি। আমরাই বা বাদ যাব কেন? দই দিয়ে তৈরি শরবতে প্রাণ ঠান্ডা। দোকানটির মালিক মো. মতিনের আবার বেশ নামডাক এলাকায়। তাঁর বসার আসনের সামনেই একটা বরফের বাক্স। পানিও আছে। কেউ চাইলেই ঠান্ডা পানির জোগান দিয়ে আসছেন বছরের পর বছর। কথাবার্তা বলে বোঝা গেল, ধোলাইখালের সবাই নিজেদের একটা পরিবারের সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেন। তার প্রমাণ মেলে সমঝোতার ভিত্তিতে দোকানের উপকরণ বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও। কেউ যদি তাঁর দোকানে মোটরসাইকেলের পিস্টন রাখেন, তাহলে তাঁর পাশের দোকানে পিস্টন রাখার নিয়ম নেই। সেই দোকানে হয়তো মিলবে মোটরসাইকেলের ব্রেকের যন্ত্রাংশ।
রসের রসিক না হলে
রাস্তার এপারে টং মার্কেট, উল্টো দিকে পুকুর পাড় মার্কেট। এই মার্কেটে মূলত গাড়ির বড় যন্ত্রাংশগুলো বেশি মেলে। এ ছাড়া মেলে গাড়ির ফ্যান, হর্নসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। গলির ভেতরে চলতি পথে হঠাৎ পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়। যেন গায়ের ওপর উঠে পড়ল একটা গাড়ি! সে কী কর্কশ হর্ন! মাথা ঘুরে তাকাতেই দেখা গেল, ছোট্ট একটা গাড়ির হর্ন নিয়ে খুটখাট করছেন প্রবীণ একজন। বারবার এমন হর্ন বাজাচ্ছেন কেন? চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে তাইজুদ্দিন নামের প্রবীণ জবাব দিলেন, ‘শব্দ নিয়া কারবার আমার। শব্দ বাজাইলে পরে বুঝি সমস্যা কোন জায়গায়।’ এই দক্ষতা এখানকার প্রায় সবারই আছে। চলন্ত যন্ত্রে হাত দিলেই বুঝে ফেলেন সমস্যা কোথায়। তবে আরেক সমস্যার কথা বললেন পোস্তগোলার শামসুদ্দিন মণ্ডল। ছোট্ট একটা যন্ত্র কিনতে এসেছিলেন। দরদাম করে কিনেও ফেললেন আমাদের সামনে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘২০০ দাম হাঁকল আর আপনি সেটা ৪০ টাকায় কিনে ফেললেন!’ উত্তর দিতে গিয়ে অর্থপূর্ণ একটা হাসি দিলেন শামসুদ্দিন, ‘ভাই, এই জায়গাটা কিন্তু অত সোজা না! এইখানে নতুন নতুন এলে বিপদে পড়বেন। দরদাম সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জেনে আসতে হবে। এ ছাড়া জিনিসটা ভালো না খারাপ—এটা অভিজ্ঞ দৃষ্টি না থাকলে বোঝা কঠিন।’
বুঝতে সমস্যা হলো না এখানে বিচিত্র মানুষের আনাগোনাও আছে। যেমন দেখা মিলল মোহাম্মদ আশরাফ নামে এক ‘যন্ত্রবাউলের’। যন্ত্রের এ দুনিয়ায় ফেরি করেন টুকটাক যন্ত্রপাতি। সস্তায় রাস্তাঘাট, ভাঙারির দোকান থেকে যন্ত্র কিনে ধোলাইখালে বিক্রি করেন। খুব বিচিত্র শ্মশ্রুমণ্ডিত আলাভোলা মানুষ। কথা বলতে বলতে আসর জমিয়ে ফেললেন লালনশাহর ‘রসের রসিক না হলে কে গো জানতে পায়’ গানটি দিয়ে। তাঁর কাছ থেকেই মিলল অবাক তথ্য, ‘শুনলাম, জাপানে একটা ক্যামেরা আবিষ্কার হইসে। যেই ক্যামেরায় ভবিষ্যৎও দেখন যায়!’
‘মাহাজনের’ ফ্যান ও কবিতার কারখানায়
নিজের ভবিষ্যৎ অবশ্য নিজেই দেখতে পাচ্ছে ৯-১০ বছর বয়সী আহমেদ হোসেন নামের ছেলেটি। কাজ করে রহমান মোটরসে। ‘বড় হয়ে কী হবে?’ প্রশ্ন শুনে খুব লাজুক একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘মাহাজন হইতে চাই। একটা দোকানের মালিক হমু।’ হোসেন যে দোকানে কাজ করে, সেখানে কেবল গাড়ির ফ্যানই পাওয়া যায়, মেরামতও করা হয়। দোকানভর্তি কেবল ফ্যান আর ফ্যান। মাঝখানে বসে ছিল ছেলেটা। তাই হোসেনকে যখন বলা হলো, ‘তুমি দেখি অনেক বিখ্যাত। তোমার তো অনেক ফ্যান!’ ছেলেটা রসিক আছে। উত্তরে বলল, ‘হ দেবের যেমন অনেক ফ্যান। আমিও তাঁর ফ্যান। হ্যার চ্যালেঞ্জ, পাগলু ছবিগুলা দেখসি।’
আমরা দেখা পেলাম সত্যিকারের ‘ফ্যান’ আছে এমন একজনের! পেশায় যন্ত্রমিস্ত্রি। নেশা তাঁর ছড়া-কবিতা। অশীতিপর একজন গাড়ির সার্কিট খুলছিলেন। সামনে গিয়ে জানতে চাই, ‘নাম কী আপনার?’ উত্তর আসে, ‘মো. সাহাব আলী।’ পাশ থেকে ওই কবি বলে যেতে থাকলেন, ‘মানুষ নিয়া করে ফালাফালি/টাকা নিয়া পরে ঘুরায় খালি/চেহারার মইধ্যে দুনিয়ার কালি!’ কবিতা শেষে জানা গেল ধোলাইখালে কবি হিসেবে জাকির হোসেনের বেশ নামডাক। ছোটবেলা থেকে ধোলাইখালে আছেন। চোখের সামনে দেখেছেন কী করে ধোলাইখাল ভরাট হলো। কী করে গড়ে উঠল দেশের অটোমোবাইল জগতের অলিখিত এ সূতিকাগার। দুঃখও ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠে, ‘এইখানে মনে করেন আমরা কিন্তু অনেক কষ্ট করি। সরকার যদি একটু নজর দিত, তাইলে হয়তো আমরা আরও ভালোভাবে অনেক কিছু করতে পারতাম। তার পরও তো এইখানকার যন্ত্রপাতি এখন বিদেশেও যায়। এইখান থেইকা সস্তায় যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় বইলা অনেক টাকাও বাঁইচা যায় দেশের।’
অতএব, সাবধান!
একটা চুটকি প্রচলিত আছে। এক লোক ধোলাইখালে গেছে গাড়ির খোয়া যাওয়া একটি যন্ত্রাংশ কিনতে। দর- কষাকষির পর বিক্রেতার কাছে জানতে চাইল, ‘ভাই, জিনিস অরিজিনাল তো?’ বিক্রেতার জবাব, ‘হানড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি! পার্টসটা তো আপনার এই গাড়ি থেইকাই খুইলা আনা হইসে!’
ধোলাইখালের ইতিহাস
অনেক ইতিহাসবিদেরই ধারণা, ধোলাইখালের আদি নাম ছিল দোলাই খাল। প্রধান জলপথ ও নগর রক্ষার পরিখা হিসেবে ঢাকার প্রথম সুবেদার ইসলাম খান চিশতি খালটি খনন করেছিলেন। গোড়ার দিকে এর উৎপত্তিস্থল ছিল বাবুবাজারের পাকুড়তলি। জিন্দাবাহার, গোয়ালনগর, নবাবপুর, নারিন্দা, জালুয়ানগর, এখনকার শরাফতগঞ্জ হয়ে সূত্রাপুরের লোহার পুলের নিচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশত এ খাল। মোগল আমলে এর ওপর ১০টি পুল নির্মিত হয়েছিল। ফলে শহরের সৌন্দর্যে যোগ হয়েছিল নতুন মাত্রা। সংস্কার করা হয়েছিল দুবার—১৮৬৪ ও ১৮৬৫ সালে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে ধোলাইখালের দুই তীরে ঘরবাড়ি উঠতে থাকে। অবধারিতভাবেই কদিন বাদে খালটি রূপান্তরিত হয় আবর্জনার ভাগাড়ে। ১৮৭২ সালে ধোলাইখালের দায়িত্ব বর্তায় ঢাকা পৌরসভার কাঁধে। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এটির আয়তন ছিল বিশাল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ঢাকার অধিকাংশ নর্দমা। খালবাহিত ময়লা-আবর্জনা চলে যেত বুড়িগঙ্গায়। ১৯৭০ সালে সে সময়ের ডিআইটি (এখনকার রাজউক) ধোলাইখাল ভরাট করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে শেষ হয় ধোলাইখালের ইতিহাস!
সূত্র: শরীফ উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ঢাকা কোষ