সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ

ফরিদপুরের গর্ব

এগিয়ে চলেছেন রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সালমান রহমান
এগিয়ে চলেছেন রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সালমান রহমান

ঢাকা থেকে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ, পদ্মা পেরুলেই ফরিদপুর। আর ফরিদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র ঝিলটুলিতে ঐতিহ্যবাহী রাজেন্দ্র কলেজ, এখন যার নাম হয়েছে রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। ‘রাজেন্দ্র’ নামটার মধ্যেই কেমন একটা রাজা রাজা ভাব। ব্যাকরণও তাই বলে—রাজা+ইন্দ্র! জানতে ইচ্ছে হলো কলেজটির নামকরণের পেছনের ইতিহাস, দেখতে ইচ্ছে হলো ক্যাম্পাস। হালকা কুয়াশাঢাকা বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা মিলল কজন তরুণের। ক্লাস শেষে আড্ডায় মেতেছেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে সঞ্জয় রায় ইতিহাস চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। তিনি জানালেন, অম্বিকাচরণ মজুমদারের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ফরিদপুরের বাইশরশির জমিদার রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর অর্থানুকূল্যে ১৯১৮ সালে এই কলেজের প্রতিষ্ঠালাভ হয় এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী পিতা রাজেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরীর নামানুসারে এই কলেজের নামকরণ হয় ‘রাজেন্দ্র কলেজ’।

রাজেন্দ্র কলেজটির বর্তমানে দুটি শাখা রয়েছে—অনার্স ও ডিগ্রি শাখা। কলেজ সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে ব্যাগ খুলে ইতিহাসের কিছু বই বের করলেন সঞ্জয়, আর তাঁর বন্ধু এস এম ইস্তিয়াব বের করলেন ল্যাপটপ। ইস্তিয়াব হিসাববিজ্ঞান চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী, হিসাব নিয়েই যাঁর কারবার। ইন্টারনেট ব্যবহারেও অভিজ্ঞ তিনি। বই আর ইন্টারনেট ঘেঁটে কলেজ সম্পর্কে জানা গেল আরও অনেক কিছু। একই বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন আইরিন জাফর। গৌরবমিশ্রিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘জানেন, আমাদের পল্লিকবি জসীমউদ্দীন এই কলেজে পড়েছেন।’

গণিতে স্নাতকোত্তর করছেন প্রদীপ বিশ্বাস। সাহিত্যের প্রতি টান আছে তাঁর—এ কথা জানিয়ে তিনি যোগ করলেন, ‘আরও কয়েকজনের কথা না বললেই নয়। কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র, ঔপন্যাসিক আবু ইসহাক প্রমুখ এই কলেজে পড়েছেন। আমরা উত্তরসূরি হিসেবে তাঁদের জন্য গর্ববোধ করি, অনুপ্রেরণা পাই।’

এভাবেই ইতিহাস হাতড়ে বেশ কিছু সুখময় স্মৃতি সামনে আনা হলো। গল্পের এই পর্যায়ে পাশের দোকান থেকে চা এল। কড়া লিকারের লাল চা। সেই চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন হলো, কেমন লাগে কলেজটাকে? সবাই একবাক্যে তাঁদের ভালো লাগার কথা স্বীকার করলেন। কিন্তু মফস্বলের কলেজ, সুযোগসুবিধা কেমন? পড়ালেখার পরিবেশই বা কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তরে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া গেল। সঞ্জয় জানালেন, ‘অবশ্যই ভালো। একসময় বৃহত্তর ফরিদপুরে এটাই ছিল একমাত্র নামকরা কলেজ। শিক্ষার্থীরা দূর-দূরান্ত থেকে পড়তে আসতেন এখানে। এখন যুগ পাল্টেছে, অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে। তবু এখনো অনেকেই দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পড়তে আসেন। ভালো লাগে এই ব্যাপারটা।’ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সালমান রহমান আক্ষেপ করে বললেন, ‘কলেজটি এত পুরাতন, অথচ আজও এটা বিশ্ববিদ্যালয় হলো না। মাঝে একবার আশা পেয়েছিলাম, কিন্তু আজ পর্যন্ত হলো না।’ ‘বৃহত্তর ফরিদপুরের ঐতিহ্য হিসেবে এই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার দাবি রাখে।’—যোগ করলেন রসায়ন চতুর্থ বর্ষের নাজমুল ইসলাম ।

কিন্তু আক্ষেপকে তো মনে বাসা বাঁধতে দিলে চলবে না! স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্নেই মুক্তি। সালমান জানালেন, তিনি ব্যবস্থাপনায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বড় কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চান। তাঁর শখ আলোকচিত্রী হওয়া। ইসরাত জাহানের ইচ্ছা ব্যাংকার হবেন। দ্বিতীয় বর্ষের মাহবুবা সামিয়া ও ব্যবস্থাপনা চতুর্থ বর্ষের শহিদুল ইসলামের স্বপ্ন বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি। প্রদীপের ইচ্ছা, শিক্ষক হয়ে জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবেন। আর ইস্তিয়াবের শখ গান গাওয়ার। অন্যদের স্বপ্ন শুনব, তার আগেই গিটারটা হাতে নিয়ে তিনি গেয়ে উঠলেন, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই “রাজেন্দ্রর” রাজত্বে!’