মিজানুরের মাসিক আয় এখন সাত লাখ টাকা
ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফ্রিল্যান্সিংকে পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে নিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন মিজানুর রহমান। এখন প্রতি মাসে ফ্রিল্যান্সার মিজানুর রহমানের আয় প্রায় সাত লাখ টাকা।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতার জন্য ২০২০ ও ২০২১ সালে পরপর দুই বছর ব্যক্তিগত বিভাগে বেসিস আউটসোর্সিং পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
যেভাবে শুরু
ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে ২০১৩ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে এ ব্যাপারে আগ্রহ জাগে মিজানুর রহমানের। এরপর ঢাকার যাত্রাবাড়ির একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ভর্তি হন। প্রশিক্ষণ শেষ করে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। ২০১৪ সালে প্রথমে ফ্রিল্যান্সিং কাজ পাওয়ার ওয়েবসাইট ওডেস্কে (বর্তমানে আপওয়ার্ক) প্রোফাইল খোলেন তিনি। টানা চার মাস চেষ্টার পর মাত্র ২ দশমিক ২২ ডলারের একটি কাজ পান। তবে কাজটা মোটেও সহজ ছিল না তাঁর কাছে। মিজানুর বলেন, ‘কাজটা করতে সময় লেগেছিল পাঁচ দিন। তবে প্রথম কাজেই ক্রেতার কাছ থেকে পাঁচ তারকা রিভিউ পাওয়ায় আগ্রহ বেড়ে যায়। ফ্রিল্যান্সিংয়ে আরও সময় দিতে শুরু করি।’
২০১৭ সাল পর্যন্ত হিসাবে মাসে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয় হতো মিজানুরের। সে সময় গ্রাহকের চাহিদামতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির তথ্য সাজিয়ে দেওয়ার কাজ করতেন। দক্ষতা বাড়াতে আরও প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন তিনি।
২০১৭ সালে আপওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ক্রাউডফান্ডিং সংস্থা ফান্ডেড টুডে এলএলসির সঙ্গে কাজের সুযোগ আসে মিজানুরের। তিনি বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আমার দুই বছরের চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিতে বলা ছিল, নামমাত্র মূল্যে কাজ করতে হবে। বিনিময়ে তারা আমাকে ক্রাউড ফান্ডিং ব্যবসায় উন্নয়ন শেখাবে। যেহেতু আমি নিজের দক্ষতা উন্নয়নের পথ খুঁজছিলাম, তাই প্রস্তাবটা গ্রহণ করলাম। এভাবে নিজেকে ক্রাউডফান্ডিং বিজনেস ডেভেলপার হিসেবে গড়ে তুলি।’
তবু চাকরি
আর দশজন তরুণের মতো মিজানুরও বিসিএস কর্মকর্তা হতে চেয়েছিলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্মে স্নাতক (সম্মান) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাই ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হয়ে ভালো আয় করলেও পরিবারের সদস্যরা সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। পরিবারের চাপে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন মিজানুর। বিসিএসে উত্তীর্ণ হতে পারেননি মিজানুর। তবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০১৮ সালে শিক্ষকতা শুরু করেন তিনি। যোগ দেন ভোলার উত্তর চণ্ডীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
মিজানুর বলেন, ‘চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। কোনো কাজেই ভালোভাবে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হলে আরও বেশি ফ্রিল্যান্সিং কাজে যুক্ত হলাম। কিন্তু স্কুল খোলার পর দেখা গেল, একসঙ্গে দুই কাজ সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তাই ২০২১ সালের ডিসেম্বরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ফ্রিল্যান্সিংয়ে সময় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’
যেভাবে এগিয়ে যাওয়া
২০১৯ সাল থেকে ক্রাউডফান্ডিং বিজনেস ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করা মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার জানামতে, এই ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশে আর তেমন কেউ কাজ করেন না। বিশ্বের একমাত্র ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আমি এই ক্যাটাগরিতে ৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয়ের মাইলফলক ছুঁয়েছি। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে আমার আয় হয়েছে প্রায় ৭ লাখ টাকা।’
এরই মধ্যে ৭৫টি দেশের গ্রাহকদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে ফান্ডেড টুডে এলএলসি, এনভেনটিজ পার্টনারস, কোরি গ্রুপ, গ্যাজেট ফ্লো, ক্রাউডস্টারের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানও আছে।
পেরোতে হয়েছে অনেক বাধা
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফল হতে অনেক বাধাই পেরোতে হয়েছে মিজানুরকে। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে বললেন, ‘দেশে ফ্রিল্যান্সিং পেশার চ্যালেঞ্জ হলো বিষয়টি নিয়ে মানুষের পরিষ্কার ধারণা না থাকা এবং পেশাটির সামাজিক স্বীকৃতি না থাকা। শুরুতে অনেকে বলছিল, দুই নম্বরি ব্যবসা করি, ডলার জালিয়াতি করি, কম্পিউটারে প্রতারণা করি ইত্যাদি। না বুঝেই মানুষ এসব কথা বলত। আমার জীবনযাপনের পরিবর্তন দেখে ২০২০ সালে কিছু মানুষ আমার নামে থানায় অভিযোগও করে। সে সময় আমাকে থানায় যেতে হয়েছিল। আমি ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) সাহেবকে বুঝিয়ে বলি, ফ্রিল্যান্সিং কী, আমার কাজ কী। তিনি বিষয়টা বুঝতে পারায় সমস্যা হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয়, সব ফ্রিল্যান্সারই এ ধরনের সমস্যায় পড়ে।’
কম গতির ইন্টারনেটের পাশাপাশি দেশে পেপ্যাল চালু না হওয়াকেও ফ্রিল্যান্সিংয়ের বড় বাধা বলে মনে করেন তিনি। মিজানুর বললেন, ‘সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ধীরে ধীরে এসব সমস্যার সমাধান হচ্ছে। আশা করি, ভবিষ্যতে ফ্রিল্যান্সাররা আরও বেশি কাজের সুযোগ পাবে।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ক্রাউডফান্ডিং ডেভেলপমেন্ট যেহেতু বাংলাদেশে এখনো সেভাবে প্রচলিত নয়, তাই এ বিষয়ে মানুষকে আরও বেশি জানাতে চান মিজানুর রহমান। জানালেন, এ খাতে কাজের পরিধি অনেক বড়। আর তাই এ খাতে আরও ফ্রিল্যান্সার তৈরির জন্য ইউটিউব চ্যানেল খুলে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে মিজানুরের। এ ছাড়া ক্রাউডফান্ডিং ডেভেলপমেন্ট সেবা দিতে এজেন্সিও খুলতে চান। ফলে দেশে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হতে পারে।
মিজানুর বলেন, ‘আমার মামা সুমন পাটোয়ারীর হাত ধরে আমার ফ্রিল্যান্সিংয়ে যাত্রা শুরু। এ ছাড়া যাত্রাবাড়ি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের প্রশিক্ষক আমিন আহমেদ, প্রাইম আইটির শিক্ষক মো. জহিরুল ইসলাম, বিজকোপের প্রতিষ্ঠাতা নাহিদ হাসান, সফল ফ্রিল্যান্সার সুমন সাহা, শরিফ মোহাম্মদ শাহজাহানসহ অনেকেই আমাকে চলার পথে প্রেরণা জুগিয়েছেন।’
মিজানুর জানালেন, শুরুতে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পরিবারের সমর্থন পাননি তিনি। তবে এখন পরিবার তাঁর পাশে রয়েছে।
আরও পড়ুন
-
পৃথিবীর কোন দেশে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকতে পারছে অবাধে: ওবায়দুল কাদের
-
পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনে হাজার কোটি টাকা বাড়তি চায় চীনা ঠিকাদার
-
রাঙামাটিতে এলোপাতাড়ি গুলিতে ইউপিডিএফের কর্মীসহ দুজন নিহত
-
বিশ্বের সেরা এয়ারলাইনস আট মাসের বেতনের সমান বোনাস দিচ্ছে
-
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজের ভেন্যুতে ঝড় বয়ে গেছে