
কারণে-অকারণে মিথ্যা বলা, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সংগতি না থাকা, নীতি বিসর্জন দেওয়া...বড়দের এই আচরণগুলোই ছোটদের মনে দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। অতঃপর তার আচরণেও দেখা দেয় অসংগতি। নামকরা স্কুল, একাধিক কোচিং ক্লাস কি পারে এই অসংগতি থেকে তাকে রক্ষা করতে?
সোফায় বেশ আরাম করে বসে ফোনে কথা বলছেন আপনি। সামনে টিপয়ে ধোঁয়া ওঠা চা। সকালের সূর্য আকাশে। পাশে বসে আছে আপনারই কিশোর সন্তান, ওর চোখের সামনে আজকের পত্রিকা। ও না চাইলেও আপনার বলা কথাগুলো ওর কানে আসছে। আপনি বলছেন টেলিফোনে, ‘আরে আরেকটু অপেক্ষা করো। আমি পরশু ঢাকায় ফিরব, তার পরই তোমার টাকা শোধ করে দেব।’
আপনার সন্তানটি আপনার দিকে অবাক চোখে তাকাল, সেটা আপনি খেয়ালও করলেন না। ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে বসে আপনি বলছেন, ঢাকায় ফিরবেন পরশু, তার মানে কাউকে অসত্য বলছেন আপনি। আপনার সন্তান কিন্তু জেনে গেল, ওর বাবা মিথ্যা বলে। জেনে গেল, এভাবে মিথ্যা বলা যায়। তাই, স্কুলে শেখা ‘সদা সত্য কথা বলিব’ নীতিবাক্যটি ওর কাছে ঝাপসা হয়ে আসে।
কিংবা, সন্তানের সামনেই আপনি আপনার নিকটতম প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলছেন। ‘জ্যোৎস্না যে শাড়িটা পরে কাল এসেছিল, ওটার দাম কত জানো? ৭০ হাজার টাকা! ওর বর বেতন পায় ৫০ হাজার টাকা। বুঝতেই পারছ...’—বলে আপনি বেশ রহস্যময় হাসি হাসলেন। আপনার সন্তান কিন্তু জেনে গেল, ওর মা পরচর্চা করতে পছন্দ করেন। জেনে গেল, যে জ্যোৎস্না আন্টি ওর প্রিয়, তাঁর স্বামীটির উপরি আয় আছে। উপরি আয়ের টাকায় কেনা শাড়িটিতে জ্যোৎস্না আন্টিকে বেশ মানায়। ও ভাবতে শেখে, ঘুষ-দুর্নীতি খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
এ রকম হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে এবং তা রবারের মতো। যতই টানা হোক, ছিঁড়বে না একেবারেই। আপনি ভাবছেন, সন্তান মানুষ করার জন্য একটা ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষক থাকলেই হলো। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে স্কুল আর শিক্ষকের ব্যবস্থা করলেন আপনি। কিন্তু আপনার শিশুর মনোজগৎটা রইল আপনার অগোচরে। শিশু কোনো মজার কথা বলতে এল আপনাকে। আপনি তা না শুনেই গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তোমার বাড়ির পড়া শেষ হয়েছে? ভালোমতো পড়াশোনা কোরো। জিপিএ-৫ পাওয়া চাই! সজীবের মা বলল, সজীব অঙ্কে ১০০ পেয়েছে, তুমি ৯৮ কেন?’ তারপর আপনার হাত চলে গেল টেলিভিশনের রিমোটে। সন্তানের চেয়ে অনেক আকর্ষণীয় বিষয় আছে এই বোকা বাক্সে। এভাবে কখন যে আপনি আপনার সন্তানের কাছে অপরিচিত হয়ে গেলেন, কিংবা সন্তান আপনাকে বাদ দিয়েই কখন ওর জীবনের পরিকল্পনা করে ফেলছে, তা আপনি টেরই পেলেন না। যখন বড় কোনো অঘটন ঘটল, শুধু তখনই আপনার টনক নড়ল, তখন আর সন্তানকে ফেরানো গেল না—ফেরারি পাখিরা কূলায় ফেরে না।
পত্রিকার পাতায় আপনার সন্তান দেখছে, ছাত্রনেতারা ঠিকাদারি ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে যান, কোনো এক ভবনে ঘুষ দিলে সরকারি কাজ পাওয়া যায়, ড্রাগসের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে মাস্তান হয়ে যায় ওর বন্ধু, চারপাশে যারা নীতিবাক্য আওড়াচ্ছে, তাদের জীবনে নীতিহীনতা দেখে ও ক্লান্ত। তাহলে এই সন্তানকে কী করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন আপনি? কিংবা, যে শিক্ষক ক্লাসরুমে নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াচ্ছেন, তাঁর মলিন বেশ, অথচ যে শিক্ষক ক্লাসে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীকে তাঁর কাছে কোচিং করতে বাধ্য করছেন, তাঁর রমরমা দেখেও তো বিভ্রান্ত হচ্ছে শিশু। পড়াশোনা তো ক্লাসরুমে আর বাড়িতেই হওয়ার কথা ছিল। কোচিং কেন চেপে বসছে শিশুর কাঁধে? ও যে বখে যাচ্ছে, ও যে নেশা করছে, ও যে মিথ্যা বলছে, ও যে আয়-ব্যয়ের বৈপরীত্য দেখে দুর্নীতির পথকেই ঠিক পথ বলে মেনে নিচ্ছে, তার দায় কি ওরই কেবল? নাকি আপনি এবং আপনার আশপাশের বড়রাই ওর ওড়ার আকাশটা ছিনিয়ে নিলেন?
সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার রবি পিউরিফিকেশনও বললেন, মা-বাবা কিংবা অভিভাবকদের আচরণে বৈপরীত্য থাকলে তা শিশুদের মনে সাংঘাতিক দাগ কটে। প্রতিষ্ঠানে সে যে শিক্ষা পায়, সেটা বাস্তবে না মিললে তার মন দোদুল্যমান হয়ে ওঠে। স্কুলে পড়াচ্ছি, সত্য কথা বলবে, অথচ ও বাইরে গিয়ে দেখছে অনেক অভিভাবকই সত্য বলছেন না, তখন ওর মনে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। অনেক সময় বাচ্চারা আমাদেরও বলে, আপনারা যে কথা বলছেন, সেটা তো ঠিক না। বাইরে তো বিপরীতটাই দেখি। বিশেষ করে, টিনএজ ছেলেরা এই প্রশ্ন করে বসে। এর প্রতিক্রিয়ায় ওদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বাবা-মা যদি অন্যায় করেন, তাহলে সন্তান খুব কষ্ট পায়। কাউকে বলতেও পারে না। এই মানসিক চাপটাই একসময় বিস্ফোরণ ঘটায়। বাবা যদি সিগারেট খান, তাহলে শিশু কেন ভাববে সিগারেট খাওয়া অন্যায়? ধূমপান তো নেশার গেটওয়ে। এভাবেই সে বদলে যেতে থাকে। বাস্তবতা ও সত্যের মধ্যে বৈপরীত্য আছে বলেই ও অচেনা হয়ে যায়। আমি একটা ইতিবাচক উদাহরণ দিই। এক শিশু বাবার কাছে একটা দামি জিনিস চেয়েছিল। সে জিনিস দেওয়ার সামর্থ্য নেই বাবার। বাবা নিজের বেতন এনে শিশুটির হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমি এই টাকা বেতন পাই। তুমি সংসার খরচ চালিয়ে যদি ওই জিনিসটা কেনার টাকা বের করতে পারো, তাহলে আমার আপত্তি নেই।’ সব দেখেশুনে শিশুটি বলল, ‘আমার ওটার আর দরকার নেই।’
উদ্দীপন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বললেন, ‘শিশুরা তো এক দিনে অপরাধপ্রবণ হয় না। ধাপে ধাপে হয়। আমি তো অভিভাবকদেরই দোষ দিই। শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিতে হয়, সেটা কি তাঁরা দেন? শিশুকে যদি বিশাল অঙ্কের হাতখরচ দেওয়া হয়, তাহলে সে ঠিক থাকবে কী করে? শিশুদের বন্ধু হতে হবে মা-বাবাকে। আমার মনে হয়, এখন শিশুদেরও কাউন্সেলিং করানো দরকার। নৈতিক আর বাস্তব জীবনের মধ্যে যদি বৈপরীত্য থাকে, তাহলে শিশু বিভ্রান্ত হতেই পারে। শিশুর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। ওকে বড় স্বপ্ন দেখাতে হবে।
আমাদের চারদিকটা আমরাই দূষিত করে রেখেছি। অপরাধী সন্তানের দিকে ঘৃণার আঙুল তুলে ধরার আগে নিজেকেই প্রশ্ন করুন, আপনি কি ওকে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন?
সব সন্তানের কাছেই মা-বাবা-শিক্ষক আদর্শ মানুষ। নিজের দেশ সব দেশের সেরা।
আপনার সন্তান কি এই সত্যের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে?
রাষ্ট্র, সমাজ, স্কুল, বাড়িতে ও যদি নিজেকে খুঁজে না পায়, তাহলে ওর জন্য আছে কে? ও কার কাছে নিরাপদ?