
ষোলোই ডিসেম্বর, দুপুর একটা ৩৫ মিনিট। পুরো প্যারেড গ্রাউন্ড ছেয়ে গেল লাল আর সবুজে। খণ্ড খণ্ড লাল-সবুজ এক করে একই পতাকার সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে হাজারো বাঙালি। লাল-সবুজে বাঙালি ঐক্যকে তুলে ধরে এভাবেই কেটে গেল গৌরবময় ছয় মিনিট ১৬ সেকেন্ড, লেখা হয়ে গেল এক ইতিহাস। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানব পতাকা তৈরির বিশ্ব রেকর্ড গড়ল বাংলাদেশ।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় এই আয়োজন করে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রবি। ২৭ হাজার ১১৭ জন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী, তরুণ, সাধারণ মানুষ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মিলে তৈরি করেন এই মানব পতাকা।
সেদিন সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন প্যারেড গ্রাউন্ডে। আগে থেকে নিবন্ধনকারীরাই শুধু এখানে নিতে পেরেছেন। এই রেকর্ডের অংশীদার কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আড্ডায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইইআরের মঞ্জিল হোসেন, বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির তন্ময় সাহা, আইবিএর শিক্ষার্থী লুবজানা আফরিন, সংস্কৃত ও পালি বিভাগের মুন্নি দাস, অর্থনীতি বিভাগের ইসরাত জাহান ও হোটেল টুরিজম বিভাগের তানজিবা সুলতানা। এ আড্ডায় সঙ্গী হন ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী অয়ন হাসান এবং এআইইউবির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের আবিদ হাসান ও মার্কেটিং বিভাগের দিলরুবা মুন হোসেন।
উচ্ছ্বসিত মঞ্জিল হোসেন শুরু করেন, ‘আমি এই রেকর্ডে অংশ নিতে পেরে গর্বিত। আরও বেশি গর্বিত পাকিস্তানকে এই ১৬ ডিসেম্বরে আবারও হারাতে পেরে।’
দিনটিকে নিজের জীবনের স্মরণীয় দিনগুলোর একটি বলে জানান তন্ময় সাহা, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। বিজয় দেখিনি। কিন্তু আজ এই বিজয় ও বিশ্ব রেকর্ডের সাক্ষী হতে পেরে ঠিক সে রকম অনুভূতি হচ্ছে। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়াটা আজ সার্থক রূপ পেল।’
লুবজানা আফরিন বলেন, ‘এখানে সব ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে এক কাতারে দাঁড়াতে দেখলাম, মনে হলো সবার ঐক্যে এভাবেই এগিয়ে যেতে পারে পুরো দেশ।’ মুন্নি দাস, ইসরাত জাহান ও তানজিবা সুলতানা এমন এক বিশ্ব রেকর্ডের অংশ হতে পেরে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত ও আনন্দিত। এ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় পা রাখা শাব্বির রহমান বলেন, ‘পুরো সময়টা ভয়ে ছিলাম, যেন অল্প কোনো ভুলে পুরো ব্যাপারটা না গোলমেলে হয়ে যায়। অবশেষে আমরা জয়ী হয়েছি। এ সাফল্যের দাবিদার আপনি, আমি ও ১৬ কোটি মানুষের সবাই।’
এআইইউবির আবিদ হাসান বলেন, ‘উপস্থাপকের নির্দেশনা পাওয়ামাত্রই যখন সবাই যার যার প্ল্যাকার্ডটি ওপরে তুলে ধরি, মনে হচ্ছিল সবার মধ্যে আবারও একাত্তরের মতো একতা ফিরে এসেছে।’
এআইইউবি থেকে সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী দিলরুবা মুন হোসেন বলেন, ‘এটি বিজয় দিবসের আরেকটি বিজয়, লাল-সবুজের বিশ্বজয়।’ মুনের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঢাকা সিটি কলেজের অয়ন হাসান বলেন, ‘সেই ছয় মিনিট ১৬ সেকেন্ড কখনো ভোলার নয়।’
গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের ১৮ জনের অডিট দল উপস্থিত ছিল প্যারেড গ্রাউন্ডে। পতাকা তৈরি শেষে তারা ঘোষণা করে, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় মানব পতাকা তৈরির রেকর্ড করেছে। গিনেস রেকর্ড বুকের তথ্যমতে, এর আগে সবচেয়ে বড় পতাকা তৈরির নজির স্থাপন করেছিল পাকিস্তানের ২৪ হাজার ২০০ স্বেচ্ছাসেবী। এরপর রেকর্ড গড়ার জন্য ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ২৬ হাজার ৯০৪ জনের মানব পতাকা তৈরি করেন রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তকের বাসিন্দারা। রাশিয়া রেকর্ড গড়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের নাম রেকর্ড বইয়ে প্রকাশের আগেই বাংলাদেশ তৈরি করে ফেলল নতুন এই বিশ্ব রেকর্ড।
(এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সামিউল আজিজ, জাহিদ হোসাইন খান ও সজীব মিয়া)