
রাসেলকে তাঁর বাবা সেদিন বললেন, ‘সারা রাত ফেসবুক, দুপুরে ঘুম থেকে উঠিস, কোনো দিন ভোরের সূর্য দেখেছিস?’ রাসেলের ঝটপট জবাব, ‘রোজ দেখি। ভোরের সূর্য দেখেই তো রোজ ঘুমাতে যাই!’
রহমান সাহেব ভাবলেন, রাত করে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাসটা বদলে ফেলবেন, কিন্তু রোজ রাতেই টেলিভিশনে টক শো দেখতে দেখতে পেরিয়ে যায় মাঝরাত। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় প্রায়ই মনে হয় ঘুমটা পুরো হলো না। আর সারা রাত পড়াশোনা করে, টেবিলেই খানিকটা ঘুমিয়ে পরদিন সকালে পরীক্ষার হলে গিয়ে মাথা ঘুরে যাওয়া—এমন ঘটনা ঘটছে হরহামেশা।
গ্রিক পুরাণে হিপনোস হলেন ঘুমের দেবতা। তাই ঘুম হলো হিপনোসের উপাসনা। হিপনোসের ছেলে মরফিয়াস আবার স্বপ্নের দেবতা। ঘুম আর স্বপ্ন তাই জড়িয়ে আছে একসঙ্গে। কল্পগাথা যা-ই থাকুক না কেন, ঘুম ছাড়া যে শরীর চলে না। আবার প্রয়োজনের বেশি ঘুমও ভালো নয়। প্রাচীনকালে ঘুম নিয়ে তাই মানুষের ছিল বিস্ময় আর এখন চলছে বিস্তর গবেষণা। ব্যবসায়ী শুভ্রজিৎ হালদারের নাকি কম ঘুমানোটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। বললেন, অনেক রাত জেগে ফেসবুকে থাকি, সিনেমা দেখি। সকালে উঠেই আবার কাজে ছুটতে হয়। অফিসের চেয়ার-টেবিলে বসেও সারা দিন ঘুম ঘুম ভাব। কিন্তু রাতে চাইলেও আগে ঘুমিয়ে পড়তে পারি না।’
শুভ্রজিতের মতো এমন সমস্যা অনেকেরই। ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের স্লিপ ল্যাবের ইনচার্জ ও জেষ্ঠ্য পরামর্শক মো. জাকির হোসেন সরকার বললেন, ‘বয়সভেদে ঘুমের পরিমাণ ভিন্ন হয়, শিশুদের জন্য ঘুম দরকার কমবেশি ১৮ ঘণ্টা, কিশোরদের জন্য নয় ঘণ্টা আবার পরিণত মানুষের জন্য ছয় থেকে আট েঘণ্টা ঘুমানোটা জরুরি। এর কম ঘুমালে শরীরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।’
ঘুম কেন জরুরি
দিনরাত ২৪ ঘণ্টার বড় একটা সময়জুড়ে মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। এই দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমানো সত্যিই কি জরুরি—জানতে চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহর কাছে। তিনি বললেন, ‘সারা দিনের কর্মব্যস্ততায় মস্তিষ্কে-শরীরে যে চাপ পড়ে, একটি সুন্দর ঘুমে মস্তিষ্ক পূর্ণোদ্যমে কাজ করার ক্ষমতা অর্জন করে। দ্রুত কেটে যায় শরীরের অবসাদ। তাই শরীরের জন্য, শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য ঘুম খুব দরকারি।’
ঘুম তো আসে না
ঘুম কম হলে শরীরে এর প্রভাব পড়ে, মানুষের কর্মদক্ষতা কমে যায়, ধীরে ধীরে কাজে মনোযোগ কমতে থাকে, কারণে-অকারণে মেজাজ বিগড়ে যায়, শরীরের তাপমাত্রার তারতম্য দেখা দিতে পারে। শিশু-কিশোরদের বেলায় তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হয় না ঠিকমতো। মস্তিষ্ক গঠনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় কম ঘুম। ত্বকের রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। স্মরণশক্তি কমে যায়। রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতাও কমতে থাকে কম ঘুমের জন্য।
ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি
ভালো ঘুমের জন্য ঘুমানোর জায়গাটা যথাসম্ভব আরামদায়ক হতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে, আবার নির্দিষ্ট সময়ে জাগার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিদিন সকালে হালকা ব্যায়াম রাতে ঘুমের সহায়ক, তাই ব্যায়ামে মন দিন। ঘুমানোর আগে হালকা গরম পানিতে গোসল করে নিতে পারেন। ম্যাসাজ নিলেও ভালো ঘুম হবে। বিছানায় যাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে এক গ্লাস দুধ খেতে পারেন, এটি ঘুমের জন্য সহায়ক। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। সন্ধ্যার পরে চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। ঘুমাতে যাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে সামান্য হাঁটাহাঁটি, মেডিটেশন কিংবা বই পড়া ভালো ঘুমের জন্য উপকারী। ঘুমানোর ঠিক আগে ইন্টারনেট, টেলিভিশনে সময় কাটানো যাবে না। ঘুম না এলে অযথা বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ না করাই ভালো। চোখে ঘুম নামলেই বিছানায় যান।
ডাক্তারবাড়িতে যখন
যাদের ঘুমের পরিমাণ পাঁচ ঘণ্টার কম, তাদের সময় হয়েছে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার। এ ছাড়া যাদের ঘুমের মধ্যে নাক ডাকার বদভ্যাস আছে, কিংবা ঘুমের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আবার অতিরিক্ত দিবানিদ্রা হয় যাদের, তাদেরও পরামর্শ নিতে হবে। দীর্ঘক্ষণ ঘুমানোর পরও যাদের তৃপ্তিকর ঘুম হয় না, তাদের জন্যও একই কথা। আবার যাদের তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায়, কিংবা ছাড়া ছাড়া ঘুম হয়, তাদেরও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।