
ভার্জিন আটলান্টিক ২৯ নভেম্বর প্রথম বিমান হিসেবে শতভাগ জৈব জ্বালানি ব্যবহার করেছে। জৈব জ্বালানির মাধ্যমে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক বিমান হিসেবে খেতাব জিতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবতরণ করে ভার্জিন আটলান্টিকের বোয়িং ৭৮৭ বিমানটি। বিমানটি শুধু জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে চালানো হয়নি, উদ্ভিদ শর্করা ও বর্জ্য চর্বির মাধ্যমে তৈরি টেকসই বিমান জ্বালানি বা এসএএফ দিয়ে চালানো হয়। ফ্লাইটটি পরিচালনার আংশিক ব্যয় যুক্তরাজ্য সরকার বহন করেছে।
সারা পৃথিবীতে টেকসই জ্বালানি ব্যবহারের প্রচেষ্টা চলছে। সেই প্রচেষ্টা বিমান উড্ডয়নের দুনিয়াতে কিছুটা দুর্বল বলা যায়। বিকল্প জৈব জ্বালানি নিয়ে চলছে গবেষণা। জ্বালানি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় বায়োম্যাস উৎসের প্রয়োজন হবে। উদ্ভিদ উপাদান, খাদ্য বর্জ্য বা শেওলার মাধ্যমে জৈব জ্বালানি তৈরির সুযোগ আছে। জৈব জ্বালানি পোড়ালে কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গত হয়, তা আবার জৈব উৎসে ফেরত যায়। এ কারণে টেকসই বিকল্প জৈব জ্বালানিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। জৈব জ্বালানি পুনর্নবায়নযোগ্য ও বায়োম্যাস তৈরির মাধ্যমে কার্বন ডাই–অক্সাইড কমানোর সুযোগ থাকে।
যদিও বিমানের মতো জ্বালানিনির্ভর শিল্পে জ্বালানির জন্য জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি প্রয়োজন হয়। আগস্টে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র থেকে এই বিষয়ে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। আখ চাষের মাধ্যমে বাণিজ্যিক জেটগুলোর জৈব জ্বালানি তৈরি করার সুযোগ আছে। এ জন্য সাড়ে ১২ কোটি হেক্টর বা ৪ লাখ ৮২ হাজার বর্গমাইল জমির প্রয়োজন। বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে সাড়ে তিন গুণ আয়তনের বেশি জায়গার প্রয়োজন হবে। আপনি যদি একা বায়োম্যাসের বর্জ্যের মাধ্যমে চেষ্টা করেন, তাহলে কোনোভাবেই আপনার সাফল্যের সুযোগ নেই। পৃথিবীর সব বিমানের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে জৈব জ্বালানি তৈরি করতে পারবেন না আপনি।
বিমানশিল্প বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী। একই পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে পুরো জাপান। জাপান বিশ্বের সর্বোচ্চ নির্গমনকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি। চিনি ও চর্বির মাধ্যমে তৈরি জ্বালানির সমর্থক গবেষকেরা জানাচ্ছেন, নতুন জ্বালানি বর্তমানের তুলনায় অনেক বেশি সবুজায়নে ভূমিকা রাখতে পারে। যদিও এ ধরনের জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানো একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটান ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডেভিড লি বলেন, বিমানযাত্রায় চিনি ও চর্বির জৈব জ্বালানির ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জৈব জ্বালানিতে পরিচালিত ফ্লাইটটি পুরোপুরি নিরাপদে অবতরণ করে আর জ্বালানি নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে জৈব জ্বালানির ব্যবহারে প্রায় ৭০ ভাগ কার্বন সাশ্রয় করা যাবে।
অবশ্য বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনে ৫০ শতাংশের বেশি জৈব জ্বালানি ব্যবহারের অনুমতি দেয় না। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, বিমান পরিবহনশিল্পের জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে ৪৫ হাজার কোটি লিটার জৈব জ্বালানির প্রয়োজন হবে। যদিও ২০২২ সালে মাত্র ৩০ কোটি লিটার উত্পাদন করা হয়। আজ পর্যন্ত জৈব জ্বালানিতে চালানো কয়েক হাজার ফ্লাইটে জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে বিশেষ মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০৩০ সালে জৈব জ্বালানি উৎপাদিত হবে বার্ষিক ২১০ কোটি গ্যালন। যদিও মার্কিন সরকার বার্ষিক ৩০০ কোটি গ্যালন জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এমন জৈব জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানো কঠিন। চলতি বছরের শুরুর দিকে রয়্যাল সোসাইটির প্রতিবেদনে জৈব জ্বালানির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফ্লাইটের সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বিজ্ঞানী লি ও তাঁর সহকর্মীরা জানান, জৈব জ্বালানি তৈরির জন্য পর্যাপ্ত জমি নেই। বিশ্বজুড়ে জমির জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ৭ থেকে ৮ কোটি হেক্টর ফসলি জমির প্রয়োজন হবে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকিঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি অনুমান করে অনেক বেশি জমি প্রয়োজন হবে। ফসলি জমির সিংহভাগ পশুখাদ্যের ফসল ফলানোর জন্য প্রয়োজন হবে। ম্যাকিঞ্জির হিসাবে মাত্র ১০ শতাংশ জমি জৈব জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।
আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্কের গবেষক হান্না ডালি বলেন, আসলে বাস্তবে খুব কম বর্জ্য পাওয়া যায়। আপনি আয়ারল্যান্ডের সব জৈববস্তু বর্জ্য সংগ্রহ করলে গ্রিস যে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে, তার প্রায় ৪ শতাংশ প্রতিস্থাপন করবে। বাস্তবে আসলে জৈব জ্বালানিসহ হাইড্রোজেন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিকল্প উৎস হিসেবে বড় আকারের বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য কার্যকর নয়। ইউরোপীয় আকাশ নিরাপত্তা সংস্থা ইউরোকন্ট্রোলের হিসেবে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মোট ফ্লাইটের সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছাবে।
ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন ক্লিন ট্রান্সপোর্টেশনের সিনিয়র গবেষক চেলসি বাল্ডিনো বলেন, জেট ফুয়েল ডিকার্বনাইজ বা কার্বনশূন্য করা অনেক কঠিন কাজ। যুক্তরাজ্যের লিডস বেকেট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ জোশ মুস বলেন, ভার্জিন আটলান্টিকের শতভাগ জৈব জ্বালানির ফ্লাইট আসলে গ্রিনওয়াশিং। বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, টেকসই বিমান চালনার মতো কোনো জিনিস নেই। বিশ্বব্যাপী ফ্লাইটের চাহিদা কমানোর চেষ্টা করতে হবে। কার্বন উৎপাদনের শূন্য লক্ষ্য পূরণ করতে এ ধরনের পদক্ষেপগুলো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জই বটে।
সূত্র: বিবিসি