বিশ্ব তথ্য সমাজ শীর্ষ সম্মেলন বা ডব্লিউএসআইএস (ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি) হলো জাতিসংঘের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ, যার লক্ষ্য ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাস, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল সবার জন্য নিশ্চিতকরণ এবং একযোগে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক তথ্য সমাজ গঠন। এই সম্মেলন দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়—প্রথমটি ২০০৩ সালে জেনেভায় এবং দ্বিতীয়টি ২০০৫ সালে তিউনিসে।
ডব্লিউএসআইএস সম্মেলনের অন্যতম দুটি মূল অর্জন হচ্ছে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম (আইজিএফ) এবং ডব্লিউএসআইএস ফোরাম। আইজিএফ গঠিত হয় ডব্লিউএসআইএস ২০০৫-এর তিউনিস এজেন্ডার ভিত্তিতে। অন্যদিকে ডব্লিউএসআইএস ফোরাম ২০০৬ থেকে ২০২৫ সালের প্রতিবছর ডব্লিউএসআইএস অ্যাকশন লাইনের অগ্রগতি পর্যালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে জেনেভাতে অনুষ্ঠিত হয়।
ডব্লিউএসআইএসের অন্যতম প্রধান অর্জন ছিল ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স বিষয়ে বৈশ্বিক আলোচনা শুরু করা এবং এর ভিত্তিতে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম (আইজিএফ) প্রতিষ্ঠা। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অনুরোধে গঠিত আইজিএফ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও গ্রহণযোগ্য বহুপক্ষীয় সংলাপভিত্তিক মঞ্চ। এখানে রাষ্ট্র, ব্যবসায়িক খাত, নাগরিক সমাজ, প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদ ও তরুণ প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল নীতিমালা নিয়ে মুক্ত আলোচনা করে থাকেন।
ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফের মূল ভিত্তি বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণ, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চেয়ে আলোচনা, সমঝোতা ও নীতির প্রভাব তৈরির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আইজিএফে কোনো বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত হয় না, তবে এর আলোচনা ও প্রস্তাবনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখে।
২০ বছর পেরিয়ে ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ আজ একটি বৈশ্বিক ডিজিটাল সহযোগিতা ও ন্যায্যতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু অগ্রগতি হলো—
* ডব্লিউএসআইএসের বহুপক্ষীয় মডেল এখন জাতিসংঘের অন্যান্য ডিজিটাল কাঠামোতেও প্রতিফলিত হচ্ছে।
* আইজিএফ বর্তমানে ১৭০টির বেশি জাতীয়, আঞ্চলিক ও তরুণ নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ পরিচালনায় সহায়ক।
* নেটমুনডায়াল (২০১৪) ও নেটমুনডায়াল+১০ (২০২৪) সম্মেলন নীতিনির্ধারণে স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার রূপরেখা প্রদান করেছে।
* সাও পাওলো মাল্টিস্টেকহোল্ডার গাইডলাইনস নীতিগত সহনশীলতা ও সহযোগিতার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তৈরি করেছে।
* নারীদের অংশগ্রহণ, তরুণ নেতৃত্ব ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে।
বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট যাতে সঠিকভাবে ও সুশৃঙ্খলভাবে চলে, তার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারিগরি দায়িত্ব থাকে। এই দায়িত্বগুলোর তদারকি করে ইন্টারনেট অ্যাসাইন্ড নাম্বারস অথরিটি (আইএএনএ)। আইএএনএর কাজগুলো না হলে ইন্টারনেটে যোগাযোগে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো। এটি ইন্টারনেটের ‘ব্যাকঅ্যান্ড’ বা মূল কাঠামোর নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। আইএএনএ কাজ হচ্ছে আইপি ঠিকানা বরাদ্দ, ডোমেইন নেম সিস্টেম ব্যবস্থাপনা এবং ইন্টারনেট প্রটোকল নম্বর সমন্বয় করা।
ইন্টারনেট পরিচালনার ক্ষেত্রে আইএএনএ কার্যক্রমের স্থানান্তর ২০১৬ সালে ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপকে বলা হয় আইএএনএ ট্রানজিশন। এই ট্রানজিশন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণমূলক মডেলের অধীন। এটি ইন্টারনেট গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ এবং গ্লোবাল অংশীদারত্ব নিশ্চিত করেছে।
আইএনএ স্থানান্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ইস্যুগুলো নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা, পরামর্শ ও কনসেনসাস গঠনে আইজিএফ বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে আইএএনএ ট্রানজিশন সরাসরি আইজিএফের ‘আউটকাম’ না হলেও, এটি আইজিএফ প্রক্রিয়ায় বিকশিত বহুপক্ষীয় মডেলের সাফল্যের একটি বাস্তব উদাহরণ।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছে, তবুও বেশ কিছু বিষয়ে এখনো চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফের অপূর্ণতা ও চ্যালেঞ্জগুলো নিম্নরূপ
* আজও অনেক দেশে শহর ও গ্রামের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন বিদ্যমান। ইন্টারনেট সুবিধা, ডিভাইস ও ডিজিটাল স্বাক্ষরতায় সমতা নেই।
* কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাবে নতুন নীতিগত জটিলতা তৈরি হয়েছে, যার জন্য এখনো উপযুক্ত আন্তর্জাতিক কাঠামো অনুপস্থিত।
* মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ফেক নিউজ বৈশ্বিক আস্থা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
* আইজিএফের আলোচনার ফলাফল অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয় না, যা এর কার্যকারিতা সীমিত করে।
২০২৫ সাল ডব্লিউএসআইএসের ২০ বছর পূর্তি, যার আলোকে ডব্লিউএসআইএস+২০ পর্যালোচনা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আগামী ১৬ থেকে ১৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তসরকার বৈঠক আয়োজন করা হবে। এর আগে ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধীন প্রস্তুতিমূলক সভা ও পরামর্শ কার্যক্রম চলছে।
এই প্রক্রিয়ায় আইজিএফ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ডব্লিউএসআইএস+২০ পর্যালোচনায় বাস্তব অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তাবনা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বহু দেশ আইজিএফের ম্যান্ডেট স্থায়ী করার পক্ষে মত দিয়েছে।
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম (বিআইজিএফ), ইউএন আইজিএফের সঙ্গে সংযুক্ত একটি নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় প্ল্যাটফর্ম। এর লক্ষ্য বাংলাদেশে ডিজিটাল নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করা এবং সরকারের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স কাঠামো গড়ে তোলা।
* ডট বাংলা (.বাংলা) টপ লেভেল ডোমেইনের স্বীকৃতির জন্য ইন্টারনেট করপোরেশন ফর অ্যাসাইনড নেমস অ্যান্ড নাম্বারসে (আইক্যান) পলিসি অ্যাডভোকেসি।
* বাংলা লেবেল জেনারেশন রুলস (এলজিআর) গঠনে সরকার ও নিও-ব্রাহমি জেনারেশন প্যানেলের (এনবিজিপি) মধ্যে সমন্বয়।
* বিটিআরসির আইক্যান-গভর্মেন্টাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (জিএসি) সদস্যপদ ও আন্তর্জাতিক আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণে সহায়তা।
* ইউনিভার্সাল অ্যাকসেপট্যান্স প্রমোট করে বাংলা ভাষার ই–মেইল ও ডোমেইন অন্তর্ভুক্তি।
* বাংলাদেশ স্কুল অব ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ও ইয়ুথ আইজিএফ, ওমেন আইজিএফ, কিডস আইজিএফ আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ, নারী ও শিশুদের যুক্তকরণ।
* জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ডব্লিউএসআইএস ও জাতিসংঘের বৈশ্বিক ডিজিটাল চুক্তি বিষয়ে কার্যকর সংলাপ ও পরামর্শ দেওয়া।
* বিআইজিএফ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, এটুআই এবং ইন্টারনেট সোসাইটি-বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এটি জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে নীতিগত অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফের ২০ বছর আমাদের দেখিয়েছে, একটি অংশগ্রহণমূলক, মানবকেন্দ্রিক ও অধিকতর ন্যায্য ডিজিটাল সমাজ কীভাবে গড়ে তোলা যায়। তবে চ্যালেঞ্জ এখনো আছে, ডিজিটাল বিভাজন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিগত সংকট এবং তথ্যের অপব্যবহার। ডব্লিউএসআইএস+২০ পর্যালোচনা ও জাতিসংঘের ডিসেম্বর ২০২৫ বৈঠক আমাদের সামনে একটি নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে, যেখানে এই ফোরামগুলোর কার্যকারিতা, অংশগ্রহণ এবং নীতিগত প্রতিফলন আরও দৃঢ় করা যেতে পারে। আমরা আশা করি, ডব্লিউএসআইএস ও আইজিএফ ভবিষ্যতেও ডিজিটাল ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তি ও মানবাধিকারের পক্ষে একটি শক্তিশালী বিশ্বমঞ্চ হিসেবে কাজ করবে। আর বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক অগ্রযাত্রায় তার ভূমিকা আরও জোরদার করবে।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম।