চোখের রেটিনায় চিপ বসিয়ে বই বা পত্রিকা পড়তে পারছেন ৮৭ বছর বয়সী ফ্রান্সের এক নারী
চোখের রেটিনায় চিপ বসিয়ে বই বা পত্রিকা পড়তে পারছেন ৮৭ বছর বয়সী ফ্রান্সের এক নারী

চোখের রেটিনায় চিপ বসিয়ে হারানো দৃষ্টিশক্তি কি পুরোপুরি ফিরে পাওয়া যাবে

ফ্রান্সের প্যারিসের উপকণ্ঠে বসবাস করেন ৮৭ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষিকা অ্যালিস শার্তোন। পাঁচ বছর আগে তাঁর দৃষ্টিক্ষেত্রের মাঝখানের অংশ ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। শুরুতে সেটি ছিল একটি ছোট অস্পষ্ট বিন্দু। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিন্দু বড় হয়ে দাগে পরিণত হয়। একসময় সেই দাগই তার দৃষ্টির কেন্দ্র দখল করে নেওয়ায় মানুষের চেহারা স্পষ্ট করে দেখতে পারেন না। ফলে তিনি বুঝতে পারেন না তাঁর চারপাশে কে দাঁড়িয়ে আছেন। চিকিৎসকদের তথ্যমতে, তিনি বয়সজনিত ম্যাকুলা অবক্ষয়ে আক্রান্ত। এটি এমন একটি রোগ, যেখানে চোখের রেটিনার ম্যাকুলা নামের অংশের কোষ ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এই ম্যাকুলাই মানুষের কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এতে সাধারণত সম্পূর্ণ অন্ধ হয় না, তবে দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে। এই রোগের কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক স্নায়ুবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান সায়েন্স করপোরেশনের উদ্ভাবিত ‘প্রাইমা’ নামের একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে চিকিৎসকেরা অ্যালিসের চোখের রেটিনায় একটি ক্ষুদ্র কম্পিউটার চিপ স্থাপনের পর তিনি কারও চেহারা ভালোভাবে দেখতে না পারলেও বই বা পত্রিকা পড়তে পারছেন।

সায়েন্স করপোরেশনের তথ্যমতে, অ্যালিসের চোখের রেটিনায় বসানো মাত্র দুই মিলিমিটার আকারের চিপটিতে রয়েছে ৪০০টি সূক্ষ্ম ইলেকট্রোড। রেটিনার যেখানে ম্যাকুলা অবক্ষয়ের কারণে কোষ নষ্ট হয়ে গেছে, সেখানে বসানো হয়েছে চিপটি। চিপ স্থাপনের পর ক্যামেরাযুক্ত বিশেষ ধরনের চশমা পরতে হয়। ক্যামেরাটি চারপাশের দৃশ্যধারণ করে ইনফ্রারেড সংকেতের মাধ্যমে সরাসরি চিপে পাঠায়। এই সংকেত চোখের স্নায়ু হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। এতে রোগী স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে না পেলেও বই পড়া ও কিছুটা দৃশ্য চেনার সক্ষমতা ফিরে পান। ভবিষ্যতে আরও উন্নত চিপ তৈরি করা সম্ভব হবে, যেখানে ইলেকট্রোডের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছাতে পারে। এতে দৃষ্টিশক্তির মান আরও বাড়বে।

হারানো দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি ফিরে না পেলেও চিপটি বসানোর পর প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা বই বা পত্রিকা পড়তে পারেন অ্যালিস। এই সামান্য ফিরে পাওয়া দৃষ্টিই তাঁর জীবনে এনে দিয়েছে নতুন আশা। এ বিষয়ে অ্যালিস বলেন, ‘আমি সারা জীবন শিশুদের পড়াতে কাজ করেছি। তাদের পড়তে শেখানোই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ। তাই নিজে আর পড়তে না পারাটা ছিল ভীষণ কষ্টের।’

চিপটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সায়েন্স করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ম্যাক্স হোডাক জানান, স্বাভাবিক মানুষ চার মিটার দূর থেকে চোখের চার্টের ছোট অক্ষর পড়তে পারেন; কিন্তু চিকিৎসার আগে রোগীরা এক মিটার দূর থেকেও সবচেয়ে বড় অক্ষর পড়তে পারতেন না। প্রাইমা ব্যবহারের পর রোগীরা চার্টের পঞ্চম লাইনের লেখা পড়তে সক্ষম হয়েছেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রায় ৮০ শতাংশ রোগীর দৃষ্টিশক্তিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা গেছে। বেশির ভাগ রোগীই বাড়িতে বসে অক্ষর, সংখ্যা ও শব্দ পড়তে পেরেছেন।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬৮০টি প্রতিষ্ঠান মস্তিষ্ক ও কম্পিউটার সংযোগ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। প্রযুক্তিটি ঘিরে যেমন আগ্রহ আছে, তেমনি আছে ভয় ও বিভ্রান্তি। অনেকেই মনে করেন, মস্তিষ্কে চিপ মানেই মানুষের চিন্তায় নজরদারি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব ধারণার সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুব কম।

সূত্র: টাইম ডটকম