
নারী ও মেয়ে—এই দুটি শব্দের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ভারতের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ সব সময় পুরুষ। এ ছাড়া অন্য কোনো দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু নারীর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘নারী’ নয়, মেয়ে। ‘আরে ও তো মেয়ে মানুষ’—দৃষ্টিভঙ্গিটাই যেন এমন।
শিক্ষার অভাব, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা বা সম্মান দেখানোর অবস্থান থেকে নারী সচেতন বা অবচেতনভাবে ‘মেয়ে’ পরিচয়ে পরিচিত হন সমাজের কাছে। ভারতের সমাজে পুরুষ ও নারীর অবস্থান নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্লেষণধর্মী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি অনলাইন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের কোনো খবরের সাইট পড়লে বা টেলিভিশন চ্যানেল দেখলে একাধিক নারী নির্যাতন বা হয়রানির খবর পাওয়া যায় না, এমনটা হয় না। গত বছরের ডিসেম্বরে দিল্লিতে চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণের শিকার হয়ে মেডিকেলছাত্রী নিহতের ঘটনা দেশটিতে যৌন হয়রানির ব্যাপকতাকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘তেহেলকা’র প্রতিষ্ঠাতা তরুণ তেজপালের বিরুদ্ধে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে দুইবার যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের এক নারী সাংবাদিক। এর জের ধরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হচ্ছেন তরুণ তেজপাল। এ ছাড়া তাঁকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে ছয় মাসের সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই দুটি ক্ষেত্রেই হয়রানির শিকার নারীদের ‘নারী’ নয়; ‘মেয়ে’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে গণমাধ্যম। যদিও তাঁদের বয়স ১৮ বছরের বেশি। কিন্তু সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠার স্থান হিসেবে পরিচিত গণমাধ্যম তাঁদেরকে ‘অল্প বয়সী নারী’ বা ‘নারী’ হিসেবে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরে না।
নারীকে মেয়ে হিসেবে চিত্রিত করার পেছনে বহু যুগের সংস্কৃতি একটা ভূমিকা পালন করে বলে মন্তব্য করেছেন সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের সহায়তায় কাজ করা মৈত্রী চ্যারেটির উইন সিং।
বহু ধর্ষণ মামলার দিল্লিভিত্তিক আইনজীবী রেবেকা জন মনে করেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী ও তাঁদের ভূমিকাকে কীভাবে দেখা হয়, শব্দগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়। এই শব্দপ্রয়োগের মাধ্যমে নারীর অধস্তন ভূমিকাকে সামনে নিয়ে আসা হয়।
মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী ব্রিন্দা গ্রোভার বলেন, হয়রানির শিকার নারীকে ‘মেয়ে’ হিসেবে চিত্রিত করে এটা বোঝানো হয় যে তাঁর সুরক্ষা প্রয়োজন এবং তাঁরা নিজের হয়ে লড়তে পারেন না। এ ব্যাপারে উইনি সিংয়ের বক্তব্য, নারীকে ‘মেয়ে’ উল্লেখ করে দেখানো হয় তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হননি। তাঁর সাক্ষ্য ও বিচারিক ক্ষমতা পুরুষের মতো গুরুত্ব বহন করে না।
দিল্লিতে গণধর্ষণে মেডিকেলছাত্রী নিহতের ঘটনার পর ভারতের নারীরা এ ব্যাপারে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন। তাঁরা এখন হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হলে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। তেহেলকার প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে নারী সাংবাদিকদের অভিযোগ তোলার ঘটনা সেটারই প্রমাণ দেয়।
তবে আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন নারীদের সামলানোর ক্ষেত্রে ভারতকে আরও বহু দূর যেতে হবে বলে মনে করেন আইনজীবী রেবেকা। কারণ সমাজ এখনো নারীর ভূমিকা ঠিক করে উঠতে পারেনি। যদিও এ দেশের শাসন ক্ষমতায় নারী বসেছিলেন অন্য অনেক দেশের চেয়ে আগে, এমনকি এখনো ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন সোনিয়া গান্ধী, সুষমা স্বরাজ, মীরা কুমারের মতো নারীরা।