যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যেসব ডাকাতি ও চুরির ঘটনা হইচই ফেলে দিয়েছিল

যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ বরাবরই দুর্ধর্ষ অপরাধীদের প্রলুব্ধ করেছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে নিউইয়র্ক নগর। বড় বড় চুরি-ডাকাতির ঘটনার কারণে এ শহরটি অনেকবার আলোচনায় এসেছে। বিমানবন্দর থেকে হোটেল, আর্মার্ড ডিপো থেকে জাদুঘর—সব জায়গাতেই ঘটেছে অভাবনীয় সব চুরি-ডাকাতি।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এসব ডাকাতির পরিকল্পনা ছিল নিখুঁত। এর সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ কালেভদ্রে ধরা পড়লেও লুট হওয়া জিনিসপত্রের বেশির ভাগই আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ওয়ার্ল্ড এটলাসের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ১০টি চুরি-ডাকাতির ঘটনা তুলে ধরা হলো।

ইসাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার জাদুঘরে চুরি

বোস্টনে ইসাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার জাদুঘর

১৯৯০ সালের ১৮ মার্চ ভোরের আগে ম্যাসাচুসেটসের বোস্টনে ইসাবেলা স্টুয়ার্ট গার্ডনার জাদুঘরে পুলিশ সেজে ঢুকে পড়েন দুই ব্যক্তি। ৮১ মিনিট ধরে তাঁরা ১৩টি শিল্পকর্ম চুরি করেন। এগুলোর আর্থিক মূল্য ৫০ কোটি ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার অপরাধ। এসব চিত্রকর্মের কোনোটি আজও উদ্ধার করা যায়নি। এর সঙ্গে জড়িত কেউ গ্রেপ্তারও হয়নি।

চোরের দল ফ্রেম থেকে চিত্রকর্মগুলো কেটে নিয়ে পালিয়ে যায়। স্টুয়ার্ট গার্ডনারের ইচ্ছায়, এখনো খালি ফ্রেমগুলো জাদুঘরে ঝুলছে। এফবিআই এখনো চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তথ্য খুঁজছে। তাঁদের ধরিয়ে দিতে পারলে ১ কোটি ডলার পর্যন্ত পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

ডানবার আর্মার্ড ডিপো ডাকাতি

১৯৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস নগরের ডানবার আর্মার্ড ডিপোতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নগদ অর্থ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ছয় ডাকাত ১ কোটি ৮৯ লাখ ডলার লুট করে নিয়ে যায়।

ওই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন অ্যালেন পেস তৃতীয়। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক নিরাপত্তা পরিদর্শক। তিনি তাঁর শৈশবের বন্ধুদের নিয়ে এ ডাকাতি করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, শুক্রবার মাঝরাতে নিয়ম অনুযায়ী যখন প্রতিষ্ঠানটির নগদ অর্থের ভল্ট খোলা রাখা হয়, তখনই হানা দেয় ওত পেতে থাকা ডাকাতদল। তারা নিরাপত্তারক্ষীদের বেঁধে ফেলে ৩০ মিনিট ধরে নগদ অর্থ লুট করে।

পরে অবশ্য ডাকাত দলের সবাই ধরা পড়েছিলেন। তবে উদ্ধার হয় মাত্র ৫০ লাখ ডলার। ১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার এখনো নিখোঁজ।

লুমিস ফার্গো ভল্টে চুরি

১৯৯৭ সালের ৪ অক্টোবর নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লটে লুমিস ফার্গো কোম্পানির ভল্ট থেকে ১ কোটি ৭৩ লাখ ডলার চুরি করেন ভল্টের সুপারভাইজার ডেভিড স্কট গ্যান্ট। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেন সাবেক সহকর্মী কেলি ক্যাম্পবেল ও স্টিভ-মিশেল চেম্বার্স দম্পতি।

গ্যান্ট ৫০ হাজার ডলার নিয়ে মেক্সিকো পালিয়ে যান। লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বাকি অর্থ তাঁর কাছে পাঠাতে থাকে চেম্বার্স দম্পতি। তবে অতিরিক্ত ব্যয়, ব্যাংকে জমা ও ফোন কলের সূত্র ধরে এফবিআই তাঁদের সবাইকে ধরে ফেলে। চুরি হওয়া মোট অর্থের ৮৮ শতাংশ উদ্ধার হলেও প্রায় ২০ লাখ ডলার আজও নিখোঁজ।

পিয়েরে হোটেলে ডাকাতি

নিউইয়র্কের অভিজাত হোটেল পিয়েরে

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে নিউইয়র্কের অভিজাত হোটেল পিয়েরেতে ঢুকে পড়ে আটজন অস্ত্রধারী ডাকাত। তারা অতিথিদের সেফ-ডিপোজিট বক্স থেকে লুট করে প্রায় ৩০ লাখ ডলারের গয়না ও নগদ প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ ডলার (বর্তমান মূল্যে)। এ সময় ডাকাতেরা সবার সঙ্গে ভদ্র আচরণ করে। এমনকি হোটেলের কয়েকজন কর্মীকে ২০ ডলার করে বকশিশও দেয়।

এ ঘটনায় লুচেসে মাফিয়া পরিবারও জড়িত ছিল। তবে মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন স্যামুয়েল নালো ও ববি কমফোর্ট। পরবর্তী সময়ে তাঁরা ধরা পড়েন। তবে লুট হওয়া অর্থ-গয়নার বেশির ভাগই উদ্ধার হয়নি।

সেন্ট্রি আর্মার্ড কার কোম্পানিতে ডাকাতি

১৯৮২ সালের ১২ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসে সেন্ট্রি আর্মার্ড কার কোম্পানির ডিপো থেকে চুরি হয় ১ কোটি ১০ লাখ ডলার। অভিযোগ ছিল, কোম্পানির কর্মী ক্রিস পোটামিটিস ডাকাতদের ভেতরে ঢুকতে সহায়তা করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত ক্রিস ও এক সহযোগী ধরা পড়েন। তাঁদের ১৫ বছরের সাজা হয়। তবে পুরো চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে উদ্ধার হয়েছিল মাত্র ৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার। বহু বছর পর ২০১৩ সালে এ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় সিনেমা এমপেরর স্টেট।

ইউনাইটেড ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংক ডাকাতি

ইউনাইটেড ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংক

অ্যামিল দিনসিও ও তাঁর দল ১৯৭২ সালের ২৪ মার্চে ডিনামাইট দিয়ে ইউনাইটেড ক্যালিফোর্নিয়া ব্যাংকের ছাদ উড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েন। তাঁরা সেফ-ডিপোজিট বক্স থেকে লুট করে নেন প্রায় ৯০ লাখ ডলার। পরে ওহাইওতে একই ধরনের আরেকটি ডাকাতির সূত্র ধরে এফবিআই তাঁদের গ্রেপ্তার করে।

লুট হওয়া অল্প কিছু অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই ঘটনাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বই, ডকুমেন্টারি ও চলচ্চিত্র।

ওয়েলস ফার্গো ডিপোতে ডাকাতি

১৯৮৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পুয়ের্তো রিকোর জাতীয়তাবাদী সংগঠন লস মাচেটেরস যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যের ওয়েলস ফার্গো ডিপোতে ডাকাতি করে ৭০ লাখ ১০ হাজার ডলার নিয়ে যায়। ভল্টের প্রহরী ভিক্টর ম্যানুয়েল গেরেনা ডাকাত দলকে সহায়তা করেন।

ডাকাত দলের দাবি, ডিপো থেকে লুট করা অর্থ তাঁরা গরিবদের জন্য ব্যয় করেছেন। তবে তদন্তে উঠে এসেছে, অর্থের বড় অংশ কিউবায় পাঠানো হয় বা সংগঠনের কাজে ব্যবহার করা হয়।

ডাকাতির সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল হোতা গেরেনা আজও পলাতক। লুট হওয়া অধিকাংশ অর্থ আজও উদ্ধার হয়নি।

লুফথানসা কার্গো ডাকাতি

নিউইয়র্কে জেএফকে বিমানবন্দর

১৯৭৮ সালের ১১ ডিসেম্বরে নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরের লুফথানসা টার্মিনাল থেকে চুরি হয় ৫০ লাখ ডলার নগদ অর্থ এবং সাড়ে আট লাখ ডলার মূল্যের গয়না। এই চুরির মূল হোতা ছিলেন লুচেসে ক্রাইম ফ্যামিলির জেমস বার্ক।

এই কাজে চোরের দলকে সহায়তা করেছেন বিমানবন্দরের এক কর্মী। এ ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র একজন দোষী সাব্যস্ত হন। বাকিরা খালাস পান। সম্পূর্ণ অর্থ আজও উদ্ধার হয়নি।

দ্য গ্রেট ব্রিঙ্কস ডাকাতি

১৯৫০ সালের ১৭ জানুয়ারি সাতজন মুখোশধারী ডাকাত বোস্টনে আন্তর্জাতিক নগদ অর্থ পরিবহন ও নিরাপত্তা কোম্পানি ব্রিঙ্কসের ভবনে হানা দিয়ে প্রায় ২৭ লাখ ৭৫ হাজার ডলার লুট করে। এটি ছিল তখনকার সময়ে সবচেয়ে বড় ডাকাতি।

অপরাধীরা এই ডাকাতির জন্য বহুদিন ধরে প্রস্তুতি নেয় এবং নকল চাবির সাহায্যে ওই ভবনে প্রবেশ করে। ছয় বছর তদন্ত চলার পর ডাকাত দলের এক সদস্য ডাকাতির সব তথ্য ফাঁস করে দেন। এতে সবাই ধরা পড়েন এবং তাঁদের যাবজ্জীবন সাজা হয়। তবে উদ্ধার হয় মাত্র ৬০ হাজার ডলার।

ডাক বিভাগের ট্রাক ডাকাতি

১৯৬২ সালের ১৪ আগস্টে ম্যাসাচুসেটসে দুই ব্যক্তি পুলিশ সেজে ডাকাতি করে যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগের একটি ট্রাক। ডাকাতেরা চালক ও প্রহরীকে বেঁধে ফেলে নগদ অর্থ ও সিলভার সার্টিফিকেটসহ মোট ১৫ লাখ ডলার লুট করে। দীর্ঘ তদন্ত সত্ত্বেও এ ঘটনায় জড়িতদের আটক করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার হয়নি লুট হওয়া অর্থও।