গাদ্দাফি হত্যার এক দশক, ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন লিবিয়াবাসীর

লিবিয়ায় টানা ৪২ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায় টানা ৪২ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। আরব বসন্তের জেরে নড়ে ওঠে তাঁর ক্ষমতার মসনদ। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সমর্থনপুষ্ট বিরোধী একটি গোষ্ঠীর হাতে আটকের পর ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর হত্যা করা হয় তাঁকে। গাদ্দাফির প্রয়াণের পর গত এক দশকে লিবিয়ায় কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও গণতন্ত্র ফেরেনি, বরং অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভক্তি জোরালো হয়েছে। একসময়ের সমৃদ্ধ অর্থনীতির লিবিয়া এখন রীতিমতো ধুঁকছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছেন লিবিয়াবাসী।

বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে আজ মঙ্গলবার বলা হয়েছে, আরব বিশ্ব ও আফ্রিকায় জনপ্রিয় হলেও পশ্চিমাদের চোখে ‘একনায়ক’ ছিলেন গাদ্দাফি। ১৯৬৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে লিবিয়ায় ক্ষমতায় বসেন তিনি। একনায়ক গাদ্দাফিকে উৎখাত করে লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট।

জাতিসংঘের উদ্যোগে গত মার্চে লিবিয়ায় গঠন করা হয় ঐক্যের সরকার। সব ঠিক থাকলে আগামী ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

গাদ্দাফিবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে তারা। অবশেষে এমন একটি গোষ্ঠীর হাতেই নিজের শহর সিরতে নিহত হন উন্নত লিবিয়া গড়ার কারিগর গাদ্দাফি। একসময়ের লৌহমানব গাদ্দাফির মরদেহ সেখানকার একটি বিপণিবিতানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

উত্থান ও জীবনযাপন যতটা রাজসিক ছিল, পতনটা ততটা সুখের হয়নি গাদ্দাফির। তাঁর প্রয়াণের পর লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা জোটের। সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। গত এক দশকে ক্রমেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে দেশটির রাজনীতি।

গাদ্দাফি–পরবর্তী দশকে ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। কেন্দ্রীয় সরকারকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে বহুধাবিভক্ত মিলিশিয়ারা, যা দেশটিতে সহিংসতা বাড়িয়ে তুলেছে। ধ্বংস করেছে অবকাঠামো। এমন পরিস্থিতি জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে পতনের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

গাদ্দাফি আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন। আমরা সব সময় তাঁর দেখানো পথেই চলব।–
মোহাম্মদ দাইরি, লিবিয়ার বনি ওয়ালিদ শহরের বাসিন্দা

পশ্চিমাদের মোহভঙ্গের পর লিবিয়ায় শান্তি ফেরাতে উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ। অবশেষে গত বছরের অক্টোবরে সফলতা মেলে। অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে দেশটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত থামে, খুলে যায় শান্তি আলোচনার পথ। জাতিসংঘের উদ্যোগে গত মার্চে লিবিয়ায় গঠন করা হয় ঐক্যের সরকার। সব ঠিক থাকলে আগামী ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এক দশকের বিভক্ত লিবিয়ায় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ফিরবে? এটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলেক্রফটের বিশ্লেষক হামিশ কিন্নের বলেন, লিবিয়া এখন তুলনামূলক শান্ত রয়েছে। অস্ত্রবিরতি কার্যকরের পর দেশটিতে একক সরকার কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যা কার্যকর রাজনৈতিক সমাধানের পথে দেশটিকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। তবে আগামী ছয় মাসের পরিস্থিতি অনেক কিছু নির্ধারণ করে দেবে।

তবে লিবিয়ায় শান্তি ফেরাতে শুধু নির্বাচন আয়োজন যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন দেশটির শিক্ষাবিদ মাহৌদ খালফাল্লাহ। এ জন্য অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ দূর করা, ভোটারদের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচনের পরিপক্বতা এবং সম্প্রদায়বাদ ও আঞ্চলিকতাবাদ উপেক্ষা করার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে বলেও মত খালফাল্লাহর। তিনি এএফপিকে বলেন, তা না হলে নির্বাচনের সুফল মিলবে না।
এদিকে এক দশক পর এসেও লিবিয়ার অনেক মানুষ গাদ্দাফি ও তাঁর শাসনামলের কথা মনে রেখেছেন। দেশটির বনি ওয়ালিদ শহরের প্রবেশমুখে এখনো তাঁর একটি বিশাল প্রতিকৃতি রয়েছে। সেখানকার ওয়ারফারা সম্প্রদায় গাদ্দাফির শক্ত সমর্থক হিসেবে পরিচিত। এখনো এই সম্প্রদায়ের মানুষ গাদ্দাফি ও তাঁর পরিবারকে মনে রেখেছেন। বনি ওয়ালিদের বাসিন্দা মোহাম্মদ দাইরি এএফপিকে বলেন, ‘গাদ্দাফি আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন। আমরা সব সময় তাঁর দেখানো পথেই চলব।’

গত এক দশকের অস্থিতিশীলতার কথা উল্লেখ করে স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আবি হামরা এএফপিকে বলেন, ‘২০১১ সালের আগে লিবিয়ার মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়েছে। পরের এক দশকের স্মৃতি অসাম্য, বোমা, হত্যা আর অপহরণের।

পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে বিপ্লব আসে। কিন্তু ২০১১ সালের পর প্রকৃত বিপ্লবের দেখা মেলেনি, বরং লিবিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র দেখেছি আমরা।’