কেনিয়ার বর্ষীয়ান বিরোধী নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাইলা ওডিঙ্গা ভারতে মারা গেছেন। সেখানে তিনি চিকিৎসাীন ছিলেন। আজ বুধবার তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছে, তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
একদলীয় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাইলা কারাবরণ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে পাঁচবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও জয়ী হতে পারেননি।
রাইলার পরিবারিক সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে, ভারতের কোচি শহরের যে হাসপাতালে তিনি মারা যান, সেখানকার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
রাইলা কয়েক দশক ধরে কেনিয়ার রাজনীতির কেন্দ্রে ছিলেন। তিনি সাবেক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে জোট গঠন করেছেন, এক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং আজীবন তাঁর সমর্থকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়েছেন। বিশেষ করে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের লুও সম্প্রদায়ের ও রাজধানী নাইরোবির মানুষ তাঁকে গভীরভাবে সমর্থন করত।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে কাজ করার ক্ষমতার জন্য রাইলা ওডিঙ্গাকে তাঁর মাতৃভাষা লুও-তে ‘আগওয়াম্বো’ (যার অর্থ ‘রহস্যময় ব্যক্তি’) নামে ডাকা হতো।
আজ কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো নাইরোবির অভিজাত কারেন শহরতলিতে রাইলার পরিবারের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
রাইলা ওডিঙ্গার সমর্থকেরা তাঁকে কেবল ‘বাবা’ (সোয়াহিলি ভাষায় যার অর্থ ‘পিতা’) বলে ডাকতেন। রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য জাতিগত বিভেদকে ব্যবহার করার বা ক্ষমতা দখলের জন্য বিরোধীদের সঙ্গে চুক্তি করার অভিযোগ উঠলেও সমর্থকেরা তাঁকে ছেড়ে যাননি।
রাইলার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাইরোবির কিবেরা বস্তির শত শত সমর্থক মিছিল করে তাঁর বাড়ির দিকে রওনা হন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই কাঁদছিলেন এবং অশুভ লক্ষণ দূর করতে গাছের ডাল নাড়ছিলেন।
গণতন্ত্রের কর্মী হিসেবে রাইলার দীর্ঘদিনের কর্মকাণ্ড দেশের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনতে সাহায্য করেছিল। প্রথমটি ১৯৯১ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং ২০১০ সালে নতুন সংবিধান।
২০০৭ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাইলা বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যাতে স্বাধীনতার পর কেনিয়ায় সবচেয়ে মারাত্মক রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দিয়েছিল। সেই সংঘর্ষে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন নিহত হন এবং কয়েক লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন।
এই সহিংসতার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পশ্চিমাঞ্চলের লুও উপজাতি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোয়াই কিবাকির জাতিগোষ্ঠী কিকুয়ুদের লক্ষ্যবস্তু করেছিল। কিকুয়ুরা কেনিয়ার বৃহত্তম এবং অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী উপজাতি।
২০১৭ সালের নির্বাচনের পরেও সহিংসতা হয়েছিল।
২০১৭ সালে রাইলা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন, প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষ বিশ্বাস করেন, তাঁদের নিজেদের লোক ক্ষমতার শীর্ষে না থাকলে তাঁরা নিরাপদ নন।
রাইলা ছিলেন কেনিয়ার স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা জোমো কেনিয়াত্তার অধীন প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ওগিঙ্গা ওডিঙ্গার ছেলে। বয়োজ্যেষ্ঠ কেনিয়াত্তা এবং ওডিঙ্গার মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাঁদের ছেলেদের মধ্যেও চলে এসেছিল।
রাইলার পরিবারের ব্যাপক ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে একজন বামপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিউবার কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সম্মানে তিনি তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন ফিদেল।
১৯৮২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল আরাপ মইয়ের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থানচেষ্টার অভিযোগ ওঠার পর রাইলাকে প্রথম কারারুদ্ধ করা হয়। মইয়ের সরকার বিরোধীদের কারাগারে বন্দী, নির্যাতন ও হত্যা করত। তিনি মোট ৯ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন, যার মধ্যে ৬ বছরই ছিলেন নির্জন কারাবাসে।
২০০৭ সালে রাইলা রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘বন্দিদশা হচ্ছে ভালো স্কুল। আপনি এখানে গভীরভাবে চিন্তা করতে শেখেন। আপনি সহনশীলতা ও ক্ষমা করতে শেখেন, বিশেষ করে আপনার প্রতিপক্ষকে।’
রাইলা ১৯৯২ সালে কিবেরাসহ তাঁর সংসদীয় আসনে প্রথম জয়ী হন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি আসনটি ধরে রেখেছিলেন। তাঁর উজ্জ্বল কমলা রঙের হামার গাড়িটি যখনই এলাকার কর্দমাক্ত গলিতে ঢুকত, তখন তাঁকে ঘিরে ভিড় জমে যেত।
১৯৯৭ সালে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী প্রতিদ্বন্দ্বী মইয়ের বিপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে হেরে যান। চার বছর পর রাইলা একটি জোট সরকার গঠন করেন। কেউ কেউ সেটিকে সুবিধাবাদী পদক্ষেপ বললেও তিনি এটিকে বাস্তবসম্মত বলে দাবি করেছিলেন।