
মিয়ানমারের রাখাইনে প্রায় চার বছর আগে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছিল দেশটির সেনাবাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে তখন পালিয়ে বাংলাদেশে আসে সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সেনাসদস্য ও তাদের দোসরদের বর্বরতায় সারা বিশ্বের বিবেক নড়ে উঠেছিল; কিন্তু নড়েনি সু চির। শান্তিতে নোবেল পদকজয়ী ‘গণতন্ত্রকামী’ এই নেত্রীকেই কি না এবার চার বছরের কারাদণ্ড দিলেন রোহিঙ্গাবিরোধী নিষ্ঠুরতায় তাঁর মৌন সমর্থন পাওয়া সেনাশাসকেরা।
এদিকে রায় ঘোষণার পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, সু চিকে আংশিক ক্ষমা করেছেন সেনাপ্রধান। তাঁর সাজা দুই বছর কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। খবর বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্সের।
মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নির্বাচিত সরকারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে সোমবার দুই মামলায় ওই কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির এক আদালত। তাঁর বিরুদ্ধে করোনাসংক্রান্ত বিধিনিষেধ ভঙ্গ ও অভ্যুত্থানকারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় এই দুই মামলায়। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন ভঙ্গসহ তাঁর বিরুদ্ধে আরও ৯টি মামলা করেছে জান্তা। সব কটিতে দোষী সাব্যস্ত হলে ১০০ বছরের বেশি কারাদণ্ড হতে পারে তাঁর।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চি সরকারকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী। পরে তাঁর বিরুদ্ধে বিগত নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনে জান্তা। গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে ও তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) শীর্ষ নেতাদের। সেনা হেফাজতে নেওয়ার চার মাস পর গত জুনে তাঁর বিচার শুরু হয়।
সু চির বিরুদ্ধে করা এসব মামলার সমালোচনা করেছেন দেশি-বিদেশি মানবাধিকারকর্মীরা। তিনিও সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই অজ্ঞাত স্থানে বন্দী হয়ে আছেন তিনি। এখন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর তাঁকে ঠিক কখন বা আদৌ কারাগারে পাঠানো হবে কি না, তা পরিষ্কার নয়।
সু চির এ রায় নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির সঙ্গে কথা বলেছেন জান্তা সরকারের মুখপাত্র জ মিন তুন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ভিন্নমতাবলম্বীদের উসকে দেওয়া ও করোনাবিধি ভঙ্গ করায় সু চিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁকে দুই বছর করে মোট চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকেও চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
দুজনের কাউকে এখনই কারাগারে নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন মিন তুন।
বলেছেন, রাজধানী নেপিডোর যেখানে তাঁরা এখন আছেন, আপাতত সেখানে রেখেই অপর মামলাগুলোর বিচারকাজ শুরু হবে। সু চি ও উইন মিন্টকে কোথায় রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে তথ্য জানাননি তুন। অবৈধভাবে ওয়াকিটকি রাখার অভিযোগে করা মামলায় ১৪ ডিসেম্বর তাঁর বিচার শুরু হবে।
রায় হওয়া দুই মামলায় নেপিডোর বিশেষ সেনা আদালতে সু চির বিচারকাজ চলে। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি নেই। এমনকি সু চির আইনজীবীরাও সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে পারেননি। রায় ঘোষণার সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয় জান্তা সরকার। এর একটি রাজধানীর ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন করা। এর মাধ্যমে দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা।
সু চির কারাদণ্ডাদেশের নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ও জাতিসংঘসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার প্রধান মিশেল ব্যাসেলেট রায়ের নিন্দা জানিয়ে এটিকে ‘লজ্জাজনক বিচার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষস্থানীয় একজন কূটনীতিক। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের সব রাজনৈতিক বন্দীকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
রায়ের প্রতিক্রিয়ার ওই একই দাবি জানিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রুস বলেছেন, নির্বাচিত রাজনীতিবিদদের দমনপীড়ন ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।
রায়ের নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির আঞ্চলিক পরিচালক মিং ইয়ু হাহ বলেন, ভুয়া অভিযোগে অং সান সু চিকে কঠোর সাজা দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশের ভেতর যে বিরোধী মত দমন ও স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা চালাচ্ছে—এ সাজা ঘোষণার ঘটনা তারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত।
মিয়ানমারে নিয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা রিচার্ড হরসি এএফপিকে বলেন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এ সাজা ঘোষণা করা হয়েছে।
সু চিকে কারাগারের পাঠানো হবে না বলে মনে করেন তিনি। হরসি বলেন, তাঁকে কারাগারে পাঠানো হলে তা হবে বিস্ময়ের ব্যাপার। খুব সম্ভবত এবারের সাজা এবং পরে যেসব সাজা ঘোষণা করা হবে, তার সবই তিনি বাড়িতে বা সরকারের অতিথিশালায় ভোগ করবেন।
সু চির পাশাপাশি এনএলডির গ্রেপ্তার অন্য নেতাদেরও বিচার চলছে। গত মাসের শুরুতে সাবেক একজন মন্ত্রীকে ৭৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর সু চির এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে দেওয়া হয়েছে ২০ বছরের কারাদণ্ড।