নেপালের পার্লামেন্ট ভবনের দেয়ালে লিখছেন এক ব্যক্তি। এ সময় বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন এক বিক্ষোভকারী। কাঠমান্ডু, ৯ সেপ্টেম্বর
নেপালের পার্লামেন্ট ভবনের দেয়ালে লিখছেন এক ব্যক্তি। এ সময় বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন এক বিক্ষোভকারী। কাঠমান্ডু, ৯ সেপ্টেম্বর

নেপালে অলি সরকারের পতনের মূলে থাকা ‘নেপো কিডস’ কারা

তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি সরকারের পতন হয়েছে। আজ মঙ্গলবার পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। সরকার জনপ্রিয় প্রায় সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দিলে দেশটিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

পদত্যাগের ঘোষণার আগেই সকালে বিক্ষোভকারীরা ভক্তপুরের বালকোট এলাকায় অলির ব্যক্তিগত বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেন। শুধু অলির বাড়িতে নয়, এদিন বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেপালি কংগ্রেস পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ কয়েকজন মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের বাড়িতে হামলা চালান। আগুন দেওয়া হয়েছে পার্লামেন্ট ভবনেও।

সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘নেপো কিডস’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে আন্দোলনের ডাক দেন বিক্ষোভকারীরা। এই হ্যাশট্যাগ দ্রুতই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শীর্ষ ট্রেন্ডে পরিণত হয়। গতকাল সোমবার নেপালের হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ জানাতে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ সারা দেশে রাজপথে নেমে আসেন। বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ, যাঁরা ‘জেন-জি’ প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত।

এ বিক্ষোভ দমনে কঠোর হয় সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হন। আহত হন আরও কয়েক শ বিক্ষোভকারী। এ অবস্থায় দেশের পরিস্থিতি দ্রুতই সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ সরকারের পতন হয়।

‘নেপো কিডস’ বা ‘নেপো বেবি’ কারা

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খ্যাতনামা সাময়িকী ‘টাইম’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নেপো কিডস’ শব্দটি হলিউডে জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘নেপো বেবি’ থেকে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তারকাদের সন্তানদের পারিবারিক সম্পর্কের কারণে হলিউডে সুযোগ পাওয়ার স্বজনপ্রীতির চর্চাকে বোঝাতে এই পরিভাষা ব্যবহার করা হয়।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, নেপালের জেন–জি বিক্ষোভের মূলে ছিল ‘নেপো কিডস’–এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ। ধনী রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তানেরা, যাঁরা স্বজনপ্রীতির স্পষ্ট সুবিধাভোগী, তাঁরা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা তাঁদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিলাসবহুল জিনিসপত্র, ব্যয়বহুল ছুটি কাটানো এবং সামগ্রিকভাবে তাঁদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপনের অভিযোগ আনেন।

অনেকের মতে, সম্পদ ও বিশেষ সুবিধার এই নির্লজ্জ প্রদর্শন নেপালের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যকেই সামনে এনেছে। একই সঙ্গে এটি দেশটির কাঠামোগত দুর্নীতিকেও নির্দেশ করে। বিক্ষোভকারীদের দাবি অনুযায়ী, অনেক নেপো কিডসের এ ধরনের জীবনযাপনের অর্থের উৎস দুর্নীতি।

পুলিশি দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে গলায় জাতীয় পতাকা জড়িয়ে বিক্ষোভ করছেন এক তরুণ

ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে একজন টিকটক ব্যবহারকারী বলেন, ‘নেপো কিডসরা ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে তাদের জীবনযাত্রা প্রদর্শন করে, কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসে, তা কখনো ব্যাখ্যা করে না।’

এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অপব্যবহার রোধে’ নতুন নিয়মের অধীনে বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে নিবন্ধন নিতে ব্যর্থ হওয়ায় নেপাল সরকার গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়। সরকারে অভিযোগ, এসব প্ল্যাটফর্মে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে কিছু ব্যবহারকারী ‘ভুয়া খবর’ ছড়াচ্ছে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, সরকার ২৬টি অনিবন্ধিত প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়ার পর গত শুক্রবার থেকে নেপালে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব ও স্ন্যাপচ্যাটের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রবেশ করতে পারছিলেন না ব্যবহারকারীরা। অবশ্য টিকটক, ভাইবার ও উইটকের মতো কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নেয় বলে একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান।

টিকটক সচল থাকায় সাধারণ নেপালি জনগণের বেঁচে থাকার সংগ্রাম আর রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জিনিসপত্র ও ব্যয়বহুল ছুটি কাটানোর দৃশ্যের তুলনা করে তৈরি করা ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়। একটি পোস্টে লেখা হয়, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বাবা-মায়েরা করদাতাদের যে কষ্টার্জিত অর্থ চুরি করেন, সেই টাকায় তাঁদের “নেপো বেবি”রা বিলাসী জীবনযাপন করছেন। এই অর্থ মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টের বিনিময়ে দেশে পাঠানো অর্থ।’

‘নেপো কিডস’, ‘নেপো বেবিজ’, ‘পলিটিশিয়ানস নেপো বেবি নেপাল’-এর মতো হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে ভিডিওগুলো মানুষ শেয়ার করছেন। এসব ভিডিওতে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, রাজনীতিবিদদের সন্তানদের সাফল্য ব্যক্তিগত পরিশ্রমের ফল নাকি বিশেষ সুবিধার কারণে। এর প্রতিবাদে কেউ কেউ রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান।

২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী যুজান রাজভান্ডারী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের বিষয়টি আমাদের ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু শুধু এই কারণেই আমরা এখানে জড়ো হইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নেপালে দুর্নীতি যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, আমরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি।’

২০ বছর বয়সী আরেক শিক্ষার্থী আইক্সামা তুমরোক বলেন, তিনি সরকারের ‘স্বৈরাচারী মনোভাবের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পরিবর্তন দেখতে চাই। অন্যরা হয়তো এটা সহ্য করে এসেছে, কিন্তু আমাদের প্রজন্মেই এর অবসান ঘটাতে হবে।’