নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকি
নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কারকি

নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেন সুশীলা কারকি

নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি। গতকাল শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে নেপালে চলমান রাজনৈতিক সংকটের আপাত সমাধান হলো বলে আশা করা হচ্ছে।

সুশীলা কারকি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। তাঁর সঙ্গে তিন সদস্যের একটি মন্ত্রিপরিষদ দায়িত্ব পালন করবে বলে নেপালভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য হিমালয়ান টাইমস জানিয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারা নতুন সরকারের মন্ত্রী হবেন, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণের আগপর্যন্ত সুশীলাই সব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার কিছুক্ষণ পর পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেছেন সুশীলা কারকি।

তরুণদের বিক্ষোভের মুখে গত মঙ্গলবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করার পর দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট চলছিল। সংকট সমাধানে বিক্ষোভকারী তরুণদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেন নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল ও সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল। গতকাল আলোচনায় মতৈক্য হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কারকির নাম ঘোষণা করে প্রেসিডেন্টের দপ্তর। বলা হয়, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবিধান সমুন্নত রাখতে এবং জাতীয় ঐক্য এগিয়ে নিতে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে সুশীলা কারকিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পাওদেল।  

এরপর গতকাল স্থানীয় সময় রাত নয়টার পরে নেপালের রাষ্ট্রপতির বাসভবন শীতল নিবাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুশীলা। প্রেসিডেন্ট পাওদেল তাঁকে শপথ পড়ান। ওই অনুষ্ঠানে নেপালের ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধান বিচারপতি, সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা ও বিদেশি কূটনীতিকেরা অংশ নেন।

৭৩ বছর বয়সী সুশীলা হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন। দেশটির প্রথম প্রধান নারী বিচারপতিও ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত প্রায় এক বছর তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহিষ্ণু’ অবস্থান নিয়ে আলোচিত ছিলেন তিনি। ওই অবস্থানের কারণেই এখন সরকার প্রধান হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন বিক্ষোভকারী তরুণেরা।

গত মঙ্গলবার কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল ‘হামি নেপাল’ নামের একটি সংগঠন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে সুশীলা শপথ নেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে সংগঠনটি এক পোস্টে লিখেছে, ‘আমরা এটা করে দেখিয়েছি।’ একই সঙ্গে তারা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছে। তারা আরও বলেছে, ‘যাঁরা এই মুহূর্তের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের জীবনকে সম্মান জানাও।’ সুশীলার শপথ গ্রহণের পর জেন-জি বিক্ষোভকারী অমৃতা বান বলেন, ‘এটি বিজয়ের মুহূর্ত…অবশেষে ক্ষমতার শূন্যতা শেষ হয়েছে।’

দীপক কাফলে নামে নেপালের প্রেসিডেন্টের দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সুশীলা কারকিকে একটি অন্তর্বর্তী সরকার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’ এর অর্থ হলো ২০২৬ সালের মার্চ মাসের শুরুর দিকে দেশটিতে পরবর্তী পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

গতকাল শপথ অনুষ্ঠানে লাল শাড়ি পরে উপস্থিত হয়েছিলেন সুশীলা। শপথ নেওয়ার পর তিনি কোনো বক্তৃতা দেননি। তবে তিনি হাসিমুখে ছিলেন। প্রথাগত ঐতিহ্য মেনে দুহাত জোড় করে মাথা নত করে উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশে তাঁকে বারবার প্রমাণ করতে দেখা গেছে।

হিন্দুস্তান টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুশীলা ভারতের বারানসির বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়াশোনা করেন। এ সময়ই তিনি দুর্গা প্রসাদ সুবেন্দির সঙ্গে পরিচিত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি তাঁকেই বিয়ে করেন। সুবেন্দি ১৯৭৩ সালের ১০ জুন অন্য দুজনের সঙ্গে মিলে নেপালের একটি উড়োজাহজ ছিনতাই করেছিলেন। তখন তিনি দেশটির অন্যতম পুরোনো রাজনৈতিক দল নেপাল কংগ্রেসের তরুণ নেতা ছিলেন। তৎকালীন রাজা মহেন্দ্রের বিরুদ্ধে ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেই তাঁরা এই উড়োজাহাজ ছিনতাই করেছিলেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করতেই তাঁরা লড়াই করছিলেন।

কে পি শর্মা অলির অবস্থান জানা যায়নি

কে পি শর্মা অলি সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী যথাসময়ে নিবন্ধন না করায় ৪ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত থেকে নেপালে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ শুরু হলেও জনগণের মধ্যে অসন্তোষের আরও অনেক কারণ ছিল। এসবের মধ্যে বেকারত্ব, দুর্নীতি, শাসকশ্রেণির সন্তানদের বিলাসী জীবন এবং ক্ষমতায় তরুণদের জায়গা না হওয়া অন্যতম।

ভারত আর চীনের মধ্যে নেপালের অবস্থান। দেশটিতে ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র শেষ হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব। তাই লাখ লাখ মানুষ বিদেশে গিয়ে চাকরি করছেন এবং দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন।
মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয়। কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান ব্যবহারের একপর্যায়ে গুলি চালায় পুলিশ। প্রথম দিনের সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী অলি পদত্যাগ করেন।

তবে এরপরও দেশটিতে সহিংসতা চলতে থাকে। ২০০৮ সালে গৃহযুদ্ধ ও রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালে এই কয়েক দিনে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটে, যাতে গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৫১ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা গেছে।

পদত্যাগ করার পর কে পি শর্মা অলিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে তিনি ঠিক কোথায় আছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পালিয়েছেন কয়েদিরা

প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার পরও পার্লামেন্ট ভবনসহ বিভিন্ন জায়গায় আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী ও নেতাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে নেন। এর মধ্যে কারাগারেও বিদ্রোহ শুরু হয়। কারাগার থেকে পালিয়ে যান বহু বন্দী। কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, এই কয়েক দিনে নেপালের বিভিন্ন কারাগার থেকে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ জন কয়েদি পালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে কিছু কয়েদিকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখনো ১২ হাজার ৫৩৩ জন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সহিংসতায় অন্তত ৫১ জন নিহতের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে নেপাল পুলিশের মুখপাত্র বিনোদ ঘিমিরে গতকাল জানিয়েছেন। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, নিহতদের মধ্যে বিক্ষোভকারী ২১ জন, কয়েদি ৯ জন, পুলিশের সদস্য ৩ জন এবং অন্যান্য ১৮ জন। অন্যান্য বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। বিক্ষোভে অন্তত ১ হাজার ৩০০ জন আহত হয়েছেন।

পরিস্থিতি সামাল দিতে গত বুধবার থেকে নিরাপত্তা রক্ষার সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করে সেনাবাহিনী। পুলিশের সঙ্গে মিলে তারা বেহাত হয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার করছে। গতকাল পর্যন্ত অন্তত ২৬৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে দ্য হিমালয়ান টাইমস–এর প্রতিবেদনে।

আজ কাঠমান্ডুর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিছু কিছু দোকান খুলেছে, রাস্তায় গাড়ি চলাচল করছে। পুলিশ সদস্যদের হাতে এখন আগের মতো বন্দুক নেই। তাঁরা লাঠি হাতে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে কিছু রাস্তা এখনো বন্ধ আছে।সেনাসদস্যরা রাস্তায় টহল দিচ্ছেন। তবে তাঁদের সংখ্যা আগের চেয়ে কম।