জাপানে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছয় মাস ধরে চলেছে ওসাকা এক্সপো–২০২৫। ভবিষ্যতের নানা ধারণা নিয়ে এতে হাজির হয়েছিল বিভিন্ন দেশ, সংস্থা ও বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। আকর্ষণীয় সব প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে তারা তুলে ধরেছিল নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
কিছু দেশের বড় আকারের প্যাভিলিয়ন থাকলেও বাংলাদেশ বা আলজেরিয়ার মতো অনেক দেশের প্যাভিলিয়ন ছিল মাঝারি আকারের। এর বাইরে এমন কিছু দেশ ছিল; যাদের সে অর্থে প্যাভিলিয়ন না থাকলেও বৈশ্বিক এ আয়োজনে উপস্থিতি ছিল সরব।
‘কমনস’ শিরোনামে যৌথ স্থাপনায় এসব দেশের ছিল ছোট ছোট কক্ষ, যেমন ভুটান, পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, বুরকিনা ফাসো, দক্ষিণ সুদান কিংবা কিউবা। এর ফাঁকে এমন একটি নাম চোখে পড়ে, যা চলার গতি টেনে ধরে। একটি কক্ষের সম্মুখে জ্বলজ্বল করছিল একটি নাম—ফিলিস্তিন। কক্ষটিতে ছিল পোশাক, হস্তশিল্প, তৈজসপত্রের পাশাপাশি হারানো ভূমি বা স্থাপত্যের স্থিরচিত্র।
গত ১৩ এপ্রিল থেকে ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত এক্সপো চলাকালীন ফিলিস্তিন ছিল বিশ্ববাসীর উদ্বেগ ও আলোচনায়। গত দুবছর ধরেই গাজা ভূখণ্ড ইসরায়েলি দখলদারদের অমানবিক বর্বরতার শিকার হয়ে চলেছে। নারী-শিশুসহ ৬৫ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি প্রায় সব অবকাঠামো সেখানে ধ্বংস করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতায় গাজায় এখন যুদ্ধবিরতি চলছে।
এমন একটি সময়ে ওসাকা এক্সপোতে এক টুকরা ফিলিস্তিন এ বার্তা দেয় যে একটি স্বতন্ত্র সত্তা বা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির যে দাবি বছরের পর বছর ধরে তারা জানিয়ে আসছে, তার প্রতি বিশ্ববাসী তথা জাপানের জোরালো সমর্থন রয়েছে। এর মধ্যে ফিলিস্তিনের সমর্থনে জাপানে বিক্ষোভ থেকে শুরু করে প্রতিবাদী চলচ্চিত্রের প্রদর্শন যেমন হয়েছে, তেমন জাপানের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবাও কদিন আগে তাঁর জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
এক্সপোতে ফিলিস্তিনের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষটিতে ছিল মানুষের ভিড়, যা নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও সংহতিকেই তুলে ধরেছে। এক্সপোতে ইসরায়েলেরও অংশগ্রহণ ছিল। তবে তা কিছুটা দূরে, আলাদা প্যাভিলিয়নে অন্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে। প্রদর্শনীতে ফিলিস্তিনের স্বাধীন অস্তিত্বে নাক গলানোর সুযোগ ইসরায়েলের ছিল না।
এ প্রাথমিক বিস্ময় দ্বিগুণ হয় এক্সপোর গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘ প্যাভিলিয়নে গিয়ে। এক্সপোতে ১৫৮টি দেশ ও ভূখণ্ড অংশগ্রহণ করেছে। অর্থাৎ জাতিসংঘের বেশির ভাগ সদস্য রাষ্ট্রই এতে যোগ দিয়েছে। তবে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ ও সংঘাত অব্যাহত থাকায় এক্সপোতে পরিলক্ষিত সহাবস্থানের বাস্তবতা এর বাইরে যে দৃশ্যমান নয়, সেটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আর এ জন্য অনেকাংশেই দায়ী করা হয় জাতিসংঘের যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারার ব্যর্থতাকে।
এ রকম এক প্রেক্ষাপটে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে জাতিসংঘ প্যাভিলিয়নের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে একজন ফিলিস্তিনিকেই। নাম মাহের নাসের। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তিনি। বিশ্বে জাতিসংঘের ভূমিকা প্রচারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর আগে ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ–এর নিউইয়র্ক লিয়াজোঁ কার্যালয়ের প্রধান ছিলেন তিনি।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাপানের ওসাকার কৃত্রিম দ্বীপ ইউমেশিমায় এক্সপোর জাতিসংঘ প্যাভিলিয়নে মাহের নাসেরের সঙ্গে দেখা হয়। শুরুতেই তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, চলমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ প্যাভিলিয়ন কী বার্তা দিতে চাইছে।
মাহের নাসের বলেন, এক্সপোর মূল বিষয়বস্তু হলো, ‘আমাদের জীবনের জন্য ভবিষ্যৎ সমাজ গঠন’। জাতিসংঘের প্যাভিলিয়ন ও তাদের কার্যক্রম প্রধানত ভবিষ্যৎ সমাজ গঠনে জাতিসংঘের ভূমিকাকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছে। সেটি করতে গিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম এবং তা কীভাবে মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত রয়েছে—তা তুলে ধরাই ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য।
গত ৮০ বছরের ইতিহাসের প্রতিফলন জাতিসংঘের প্যাভিলিয়নে তুলে ধরা হয়। নাসেরের মতে, এটি শুধু জাতিসংঘের বিশেষ কিছু মুহূর্ত নয়; বরং বহুপাক্ষিকতা চর্চার ইতিহাসের বৃত্তান্ত। সাম্প্রতিক বিশ্বে সংরক্ষণবাদের উত্থানের প্রেক্ষাপটে এ যেন বিপরীত বার্তা।
এ প্যাভিলিয়নের প্রথম কক্ষে একটি টাইমলাইন তুলে ধরা হয়। সেখানে ছিল জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন, আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা বা ইক্যাও, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচওসহ ৩৫টি তহবিল ও কর্মসূচির পাশাপাশি ১৫টি বিভাগ ও কার্যালয়ের বিবরণ।
এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরন্তর কাজের মাধ্যমেই ২২০ কোটি মানুষ ও ৫১টি দেশ দিয়ে শুরু হওয়া জাতিসংঘ এখন ৮২০ কোটি জনগণ সংবলিত ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সংস্থায় উন্নীত হতে পেরেছে বলে উল্লেখ করেন নাসের। বিশ্বের জনসংখ্যা যে ২ দশমিক ২ থেকে ৮ দশমিক ২ বিলিয়নে উন্নীত হলো, তা দীর্ঘ আয়ু, কম শিশুমৃত্যু, কম মাতৃমৃত্যু এবং এমনকি গুটিবসন্তের মতো রোগের নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের কারণে হয়েছে। আর এসব সম্ভব হয়েছে জাতিসংঘভিত্তিক বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে—দাবি নাসেরের। অবশ্য তিনি এও স্বীকার করেন যে জাতিসংঘ যা অর্জন করতে চেয়েছিল, তার সবকিছু করা যায়নি। ইতিমধ্যে উল্লিখিত যুদ্ধ বা সংঘাতগুলোই এর জ্বলজ্বলে প্রমাণ।
গাজা যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে নাসের বলেন, লোকজন প্রশ্ন তুলছেন যে জাতিসংঘ কেন এখানে দ্বৈত অবস্থান নিচ্ছে। অর্থাৎ ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের তুলনায় ভিন্ন অবস্থান কেন। মূলত, গাজায় এত মৃত্যু ঠেকাতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অনেকেই জাতিসংঘকেই দায়ী করছেন। নাসেরের মতে, এ সবই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাঠামোর মধ্যে পড়ে; যার ওপর শান্তি ও নিরাপত্তার দায়িত্ব অর্পিত। জাতিসংঘ দিবসে ওসাকায় সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে আজকের বিশ্ব ১৯৪৫ সালের বিশ্ব নয়। এটি আলাদা এবং আমাদের এমন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন; যা আজকের বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’
জাতিসংঘের পুনর্গঠন কি তবে আবশ্যক কিংবা অবশ্যম্ভাবী? এমন প্রশ্নের জবাবে নাসের বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার ছিল ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত ‘সামিট অব দ্য ফিউচার’ বা ভবিষ্যতের জন্য শীর্ষ সম্মেলনের এজেন্ডার একটি। জাপান, ব্রাজিল ও ভারতসহ একাধিক দেশ বেশ কিছুদিন ধরেই এ দাবি তুলে আসছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলছেন বিশ্ব পরিবর্তিত হলেও জাতিসংঘ পরিবর্তিত হয়নি। কিন্তু ‘সামিট অব দ্য ফিউচার’-এ বিশ্বনেতাদের গৃহীত প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের বিষয়টি এসেছে।
প্যাভিলিয়নে চালানো জরিপ বলছে, জাতিসংঘ সম্পর্কে নিজেদের ধারণা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এর লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ৯০ শতাংশের বেশি দর্শনার্থী।
এদিকে প্যাভিলিয়নে রাখা ছিল শান্তির ঘণ্টার একটি ছোট সংস্করণ। এক্সপো চলাকালীন এটি বাজানোর জন্য দর্শনার্থীদের প্রতি আহ্বান জানানো হতো। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এটির প্রকৃত সংস্করণ রাখা আছে। একজন জাপানি বিশালাকার ওই ঘণ্টা জাতিসংঘকে দিয়েছিলেন। তবে সেই শান্তির ঘণ্টাধ্বনি কি সবার কানে যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে নাসের বলেন, ‘আমরা কোনো আদর্শিক বিশ্বে বাস করি না। তবে আশাচ্যুত হওয়া চলবে না।’
বিগত ৮০ বছরের মানবতার ইতিহাসে নানা অর্জন শুধু জাতিসংঘের কারণেই সম্ভবপর হয়েছে বলে জানান নাসের। এর মানে কি জাতিসংঘ প্রতিটি যুদ্ধ বন্ধ করতে পেরেছে? উত্তর নেতিবাচক স্বীকার করে নাসের বলেন, ‘আসলে জাতিসংঘের মধ্যস্থতার কারণে অনেক সম্ভাব্য যুদ্ধই এড়ানো গেছে বা দুর্ভিক্ষ রোধ করা গেছে; যা হয়তো খবরের শিরোনাম হয়নি। এক্সপোতে জাতিসংঘ প্যাভিলিয়নের মূল প্রতিপাদ্যই ছিল জাতিসংঘের অপ্রচারিত এসব সাফল্যের ওপর আলোকপাত করা।’
চলমান যুদ্ধগুলোও শিগগিরই শেষ হতে যাচ্ছে—আশা ব্যক্ত করে নাসের বলেন, ‘জাতিসংঘ এমন এক সংস্থা যেখানে আমরা সমাধান খুঁজি। সমাধানগুলো পেতে সময় লাগতে পারে, তবে এর বাইরে সর্বজনের গ্রহণযোগ্য আর কোনো প্ল্যাটফর্ম এখনো গড়ে ওঠেনি।’
তাহলে বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘই কি সর্বশেষ স্থল? প্রশ্নে ইতিবাচক জবাব দিয়ে নাসের বলেন, এর কারণ, কোনো দেশ, যত শক্তিশালী হোক, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা মহামারির মতো বৈশ্বিক পর্যায়ের কোনো কিছুর প্রভাব মোকাবিলা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু শুধু নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতাই জাতিসংঘের এসব অসাধারণ অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে; যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
পরিশেষে জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে নাসের বলেন, শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অবদান অনেক বড়। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষায় সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশের একটি; শুধু সামরিক বাহিনীই নয়, পুলিশও আছে এ অবদানে।
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পেছনে বাংলাদেশের ভূমিকাই মুখ্য, সেটি উল্লেখ করতে ভোলেননি নাসের। তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে নিয়মিত কাজ করি এবং ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরি, যার শুরু বাংলাদেশ থেকে।’