সাপ্পোরোর ইশিকারি উপকূলের অদূরে বায়ুবিদ্যুতের টারবাইন
সাপ্পোরোর ইশিকারি উপকূলের অদূরে বায়ুবিদ্যুতের টারবাইন

হোক্কাইদো হয়ে উঠছে জাপান তথা এশিয়ার কার্বনমুক্তকরণ প্রকল্প ও অর্থায়নের কেন্দ্রবিন্দু

বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিসহ গুটিকয় গোষ্ঠীর অস্বীকার করার প্রবণতা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তন যে একটি বাস্তব ঘটনা, সেটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলা কিংবা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি যার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৮৫০ সালের পর সর্বোচ্চ। শিল্পোন্নত দেশগুলো এর প্রধান কারণ হলেও এর ভুক্তভোগী বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশও। জলবায়ু পরিবর্তনের এই অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তাই নড়েচড়ে বসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে বছর প্যারিস চুক্তিতেও বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক্‌-শিল্পযুগ স্তরের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ রাখার একটি বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক দেশ ও অঞ্চল সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কার্বননিরপেক্ষতা অর্জনের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জাপানও এর বাইরে নয়। এ ক্ষেত্রে জাপানের সাম্প্রতিক অগ্রগতি কতটা হয়েছে, তা স্বচক্ষে দেখে আসার জন্য হোক্কাইদোর স্থানীয় সরকার, হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি খাতের কয়েকটি কোম্পানির যৌথ ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত প্রেস ট্যুরে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা হয়েছে এই প্রতিবেদন। প্রথম আলোর প্রতিনিধি ছাড়াও জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধিত অন্য কয়েকটি দেশের সংবাদমাধ্যমের কর্মীরাও এই সফরে যোগ দিয়েছিলেন।

জাপানে জিএক্সের প্রসার

শিল্পোন্নত দেশ জাপান বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ। বৈশ্বিক উদ্যোগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০২১ সালে দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত নিজেদের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ঘোষণা করে। ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বননিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য ২০৩০ সালে (২০১৩ সালের তুলনায়) গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ৪৬ শতাংশ কমানোর একটি মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে দ্বীপরাষ্ট্র জাপানে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব। ২০২২ সালে রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের পরিণতিতে জ্বালানির মূল্যে ঘটে তীব্র উল্লম্ফন। এ ঘটনায় দেশটির জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতার দিকটি উন্মোচিত হয় প্রকটভাবে। আবার বড় দেশগুলোর তুলনায় জাপানের নবায়নযোগ্য জ্বালানির অনুপাতও কম। সবকিছু মিলিয়ে ২০২৩ সালে জাপান সরকার ‘কার্বনমুক্তকরণ এবং বর্ধনশীল অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য কাঠামোগত রূপান্তর (জিএক্স প্রসার কৌশল)’ অনুমোদন করে।

সেই লক্ষ্যে জিএক্স (গ্রিন ট্রান্সফরমেশন) বা কার্বনমুক্ত সমাজে উত্তরণের জন্য আগামী এক দশকে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ১৫০ ট্রিলিয়ন ইয়েন বা ১ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। উদ্ভাবনী উপায়ে টেকসই রূপান্তরসংক্রান্ত অর্থায়ন এগিয়ে নেওয়া এই উদ্যোগের লক্ষ্য। এ ধারণার আলোকে শিল্পগত প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিএক্স–সংক্রান্ত ব্যবসা প্রবর্তন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির বাস্তবায়ন, কার্বনমুক্তকরণ এগিয়ে নেওয়ার জন্য আর্থিক পদক্ষেপ এবং জিএক্স শিল্পহাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে জাপান সরকার। এর জন্য ২০২৪ সালে জিএক্স (গ্রিন ট্রান্সফরম্যাশন) অ্যাক্সিলারেশন এজেন্সি বা কার্বনমুক্ত সমাজ ত্বরান্বিতকরণ এজেন্সি চালু করেছে সরকার। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্বের প্রথম সার্বভৌম ট্রানজিশন বন্ড ‘জাপান ক্লাইমেট ট্রানজিশন বন্ড’ বাজারে ছেড়ে ইতিমধ্যেই ২০ ট্রিলিয়ন ইয়েন প্রাথমিক বিনিয়োগ জোগাড় করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন জাপানের জিএক্স এক্সিলারেশন এজেন্সির পরিচালক হিদেকি তাকাদা

প্রথম আলোর প্রতিবেদকসহ অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপে জিএক্স অ্যাক্সিলারেশন এজেন্সির পরিচালক হিদেকি তাকাদা জানিয়েছেন, গবেষণা, অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয়, নীতিগত আলোচনা এবং জিএক্স ও টেকসইকরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য জিএক্স হাব হিসেবে ভূমিকা রাখছে এই এজেন্সি। জিএক্স অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ নিশ্চয়তা দেওয়া এবং ইকুইটি বিনিয়োগের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য তাদের রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৬ সালে এমিশন ট্রেডিং সিস্টেম বা নিঃসরণ লেনদেনব্যবস্থা এবং কার্বন প্রাইসিং বা কার্বন দর চালু করা হবে।

এদিকে জাপানজুড়ে সবুজ রূপান্তরের জন্য এজেন্সি যে ১৫০ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগের লক্ষ্যে কাজ করছে, তার বেশির ভাগ বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে জাপানের হোক্কাইদো জেলায়।

জিএক্স অর্থায়নের কেন্দ্র হোক্কাইদো-সাপ্পোরো

হোক্কাইদো হচ্ছে জাপানের সর্ব-উত্তরের জেলা। আইনু জাতিগোষ্ঠীর আদি নিবাস এই দ্বীপ রাশিয়ার অদূরে অবস্থিত। চমৎকার আবহাওয়া ও অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে জাপানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জেলার মধ্যে হোক্কাইদোর অবস্থান শীর্ষে। হোক্কাইদোর রাজধানী সাপ্পোরো হচ্ছে ব্যবসা এবং পর্যটনের ক্ষেত্রে প্রধান আঞ্চলিক কেন্দ্রবিন্দু। শীতকালীন তুষারপাতসহ নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলির জন্য সাপ্পোরো বিখ্যাত। ধান চাষ, দুগ্ধ খামার ও মৎস্যশিল্পের সমৃদ্ধির কারণে হোক্কাইদো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং জাপানের মূল ভূখণ্ডে খাবারের এক বড় সরবরাহকারী।

সাংবাদিকদের ব্যাখ্যা করছেন স্টার্টআপ হোক্কাইদোর নির্বাহী পরিচালক কিয়োহেই ফুজিমা

ঐতিহ্যগতভাবে শক্তিশালী পর্যটন ও খাদ্যশিল্পের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জৈবপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রগুলোকেও কৌশলগত অগ্রাধিকার হিসেবে মনোনীত করেছে সাপ্পোরো। বায়ু ও সৌরশক্তির মতো বৈচিত্র্যময় শক্তির উৎসে সমৃদ্ধ হওয়ায় এখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা জাপানের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাই অঞ্চলটিকে জাপানের জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের একটি ভিত্তি এবং এশিয়া ও বিশ্বের একটি আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি জাতীয় প্রকল্প চলমান রয়েছে। সেই লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জুন মাসে হোক্কাইদোকে একটি ‘জাতীয় কৌশলগত বিশেষ অঞ্চল’ হিসেবে মনোনীত করা হয়। এর পাশাপাশি হোক্কাইদো ও সাপ্পোরোকে ‘আর্থিক ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা ব্যবসার জন্য একটি বিশেষ অঞ্চল’ হিসেবেও নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাপ্পোরোকে কেন্দ্রে রেখে হোক্কাইদো হতে যাচ্ছে জাপানের শিল্পগত রূপান্তরের মূল হাব (কেন্দ্র)। শীতল আবহাওয়া, কম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকি, কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা ও তুলনামূলক স্বল্প বাণিজ্যিক ব্যয়ের মতো জেলাটির অনন্য দিকগুলো তাতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। জিএক্স শিল্পে বিনিয়োগের প্রসার ঘটাতে সারা বিশ্ব থেকে অর্থায়ন আকর্ষণ করছে সাপ্পোরো। অন্যদিকে বৃহত্তর হোক্কাইদো জিএক্স শিল্পের জন্য গড়ে তুলবে সরবরাহ চেইন এবং জাপানের পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে হবে একটি সরবরাহ ঘাঁটি। এ উপলক্ষে গত মাসের শেষ সপ্তাহে সাপ্পোরোতে জাপানের বিখ্যাত গণমাধ্যম নিক্কেইর উদ্যোগে ‘বৈশ্বিক জিএক্স/ফিন্যান্স সম্মেলন সাপ্পোরো ২০২৫’ অনুষ্ঠিত হয়। নিক্কেইর এই ফোরামে জাপানসহ বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞরা পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি এবং একটি টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক ভবিষ্যতের জন্য জিএক্স অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা করেন। এতে উপস্থিত ছিলেন মিজুহো, সুমিতোমো মিতসুই, এমইউএফজেসহ জাপানের বৃহৎ ব্যাংকগুলোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। আরও যোগ দেন জাপানে নিযুক্ত মার্কিন উপরাষ্ট্রদূত এরন ডি স্নাইপ, ফ্রান্সের বিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সোশিতে জেনেরালের টোকিও শাখার প্রধান ব্রুনো গুসর্গ, ক্লাইমেট বন্ড ইনিশিয়েটিভের সিইও শন কিডনিসহ আরও অনেকে। সম্মেলন শেষে সাপ্পোরোর মেয়র কাৎসুহিরো আকিমোতো জিএক্স অর্থায়নসংক্রান্ত বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, যার মধ্যে রয়েছে বিধিবিধান শিথিলকরণ, ভর্তুকি ও প্রণোদনা এবং বিদেশি প্রকৌশলীদের জন্য বিশেষ ভিসার প্রবর্তন। বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের জন্য যেটি একটি আকর্ষণীয় সুযোগ হতে পারে।

২২ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি সাপ্পোরোতে অনুষ্ঠিত হবে ‘শেইক-এইচ’ নামের উদ্যোক্তা কোম্পানিগুলোর বৈশ্বিক সম্মেলন

এ নিয়ে কথা হয় সাপ্পোরো শহরের জিএক্স প্রকল্পের মহাপরিচালক কাওরি নিশিয়ামার সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ কার্বনমুক্তকরণের কেন্দ্রীয় লক্ষ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগামী ১০ বছরে হোক্কাইদোতে জিএক্স বা কার্বনমুক্ত অবকাঠামোসংক্রান্ত ব্যবসায় প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগ করা হবে। সংশ্লিষ্ট খাত হিসেবে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প, সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন, ডেটা সেন্টার নির্মাণ, হাইড্রোজেন জ্বালানিনির্ভর একটি পরিবহনব্যবস্থাসহ অন্যান্য পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

আকর্ষণীয় প্রকল্পগুলো

পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিকে শক্তিমত্তা হিসেবে ব্যবহার করে এশিয়াসহ সারা বিশ্বের কার্বনমুক্তকরণের কেন্দ্র হয়ে ওঠার লক্ষ্যে সাপ্পোরো ও হোক্কাইদো একগুচ্ছ প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

বায়ুবিদ্যুৎ: অফশোর বা উপকূলের অদূরে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে দেশের মোট এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুতের জোগান দিতে চায় জাপান। জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২০৪০ সাল নাগাদ সর্বোচ্চ ৪৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট। ২০৫০ সাল নাগাদ যার বাজার মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ইয়েন। হোক্কাইদোর অফশোর বায়ুবিদ্যুৎকে বিবেচনা করা হচ্ছে মূল এক সমাধান হিসেবে। এই লক্ষ্যে সাপ্পোরোর অদূরে ইশিকারি বে নিউ পোর্ট উপকূলের অদূরে গড়ে তোলা হয়েছে জাপানের সর্ববৃহৎ বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২৪ সাল থেকে এতে উৎপাদিত হচ্ছে ১ লাখ ১২ হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ, যা ৮৩ হাজার বাড়িঘরের চাহিদা পূরণে সক্ষম। উল্লেখ্য, জাপানে বায়ুবিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ, ছোট ও মাঝারি আকারের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে হোক্কাইদোর অবস্থান এক নম্বরে।

সেমিকন্ডাক্টর: ২০৩০ সালের মধ্যে জাপানে নতুন প্রজন্মের সেমিকন্ডাক্টরে বিনিয়োগ হবে ১০০ ট্রিলিয়ন ইয়েন। সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা র‍্যাপিডাস একাই ৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যার বড় অংশ যাবে হোক্কাইদোতে। এমইউএফজে ব্যাংক, সুমিতোমো মিতসুই ব্যাংকিং করপোরেশন ও মিজুহো ব্যাংক র‍্যাপিডাসকে গত সপ্তাহে ২ ট্রিলিয়ন ইয়েন বা প্রায় ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ঋণ প্রদানে সম্মত হওয়ার বার্তা দিয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে পরবর্তী প্রজন্মের সেমিকন্ডাক্টর–শিল্পের বিকাশসংক্রান্ত গবেষণা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ফ্রন্টিয়ার এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ অন সেমিকন্ডাক্টরস (আইএফএআরএস)।

ডেটা সেন্টার: এআই যুগে ডিজিটাল উপাত্তের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে বিশ্বজুড়ে ডেটা সেন্টারের চাহিদা বাড়ছে দ্রুত। জাপানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত শ্বেতপত্র অনুযায়ী ২০২৬ সালে দেশের ডেটা সেন্টারের বাজার হবে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ইয়েন। তবে ডেটা সেন্টারের রয়েছে বিদ্যুতের উচ্চ চাহিদা এবং এতে উৎপাদিত হয় অত্যধিক তাপ। দুটো ক্ষেত্রেই এটি পরিবেশদূষণের অন্যতম উৎস। শীতল আবহাওয়ার কারণে তাই হোক্কাইদোই হতে যাচ্ছে জাপানের ডেটা সেন্টার নির্মাণের মূল কেন্দ্র। শুধু তা–ই নয়, এতে ব্যবহৃত হবে কার্বনমুক্ত জ্বালানি। ইতিমধ্যে ইশিকারিতে নির্মিত হয়েছে জাপানের সর্বপ্রথম কার্বনমুক্ত ডেটা সেন্টার ‘জেড’। এদিকে জাপানের বৃহৎ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি সফটব্যাংক করপোরেশনও তাদের সর্ববৃহৎ ডেটা সেন্টারের স্থান নির্বাচন করেছে হোক্কাইদোতে, যেখানে ব্যবহৃত হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি।

ফুয়েল সেলচালিত টয়োটা মিরাই গাড়ি

হাইড্রোজেন জ্বালানি: প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে হাইড্রোজেন জ্বালানিভিত্তিক একটি সমন্বিত পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে জাপানে। গাড়ি নির্মাতারাও এখন হাইড্রোজেন–নির্ভর গাড়ি উৎপাদন করতে শুরু করেছে। এই খাতে আগামী ১৫ বছর সরকারি-বেসরকারিভাবে ১৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগের কথা রয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সাপ্পোরো শহরের ওদোরি হিগাশি এলাকায় ‘এয়ার ওয়াটার’ কোম্পানি চলতি বছরের ১ এপ্রিল চালু করেছে প্রথম বড় মাপের বাণিজ্যিক হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন। সাপ্পোরোতে এখন এমন স্টেশন দুটি। এখানে টয়োটা মিরাইয়ের মতো সর্বাধুনিক একটি গাড়িতে হাইড্রোজেন ভর্তি করতে সময় লাগে ৩ মিনিট। আর এর খরচও প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানি–নির্ভর গাড়ির সমান।

এর বাইরে এসএএফ বা টেকসই বিমান জ্বালানি, আন্তজাপান সাবমেরিন কেবল নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করে রাখার বিশেষ স্টোরেজ ব্যাটারি উৎপাদনেও ব্যাপক বিনিয়োগ করা হবে।

এদিকে হোক্কাইদোতে ব্যবসা স্থাপনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে দেওয়া হচ্ছে বিশাল ভর্তুকি, প্রণোদনা ও অন্যান্য সমর্থন, যার সুযোগ নিতে পারেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও।

ব্যাপক সমর্থনব্যবস্থা

সাপ্পোরোকে জাপানের সহজতম ব্যবসা পরিচালনার স্থানে পরিণত করার জন্য নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করছে নগর কর্তৃপক্ষ। চালু করা হয়েছে ওয়ান–স্টপ ডেস্ক। একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক অংশীদারত্ব ‘টিএসএইচ’ (সাপ্পোরো-হোক্কাইদো টিম) এবং একটি বিশেষায়িত কাঠামো ‘স্টেপ’ (সাপ্পোরো ট্রান্সন্যাশনাল এক্সপানশন অ্যান্ড পার্টনারশিপ) নামক দুটি কাঠামো এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

নিক্কেই ফোরামে প্যানেল আলোচক হিদেকি তাকাদা, ব্রুনো গুসর্গ এবং শন কিডনি (বাঁ দিক থেকে)

টিএসএইচ

২১টি শিল্প, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ২০২৩ সালে গঠিত হয় ‘টিএসএইচ’। এই কনসোর্টিয়ামের লক্ষ্য হচ্ছে, জাপানের সর্বোচ্চ নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে হোক্কাইদো ও সাপ্পোরোকে জাপানের নবায়নযোগ্য জ্বালানির সরবরাহ ঘাঁটিতে পরিণত করা।

স্টেপ

‘স্টেপ’ হচ্ছে নগর সরকারের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানসম্পন্ন ও পেশাদার ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষ কাঠামো। এর লক্ষ্য বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সাপ্পোরো এলাকায় প্রাথমিক প্রবেশ থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক উন্নয়নে সহায়তা প্রদান। সাপ্পোরো শহরে অবস্থিত স্টেপ কার্যালয়ে এ বিষয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক সেইকো মিউরার সঙ্গে। তিনি জানান, বিনা মূল্যে ইংরেজিতে প্রদান করা তাঁদের সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দেশীয় প্রতিষ্ঠান এবং হোক্কাইদো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ইনোভেশন সেন্টারসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো, জটিল প্রশাসনিক বিষয়াদি, শুল্ক ও আইনি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান এবং বিভিন্ন ইভেন্টের মাধ্যমে ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক তৈরির সুযোগ। এ ছাড়া রয়েছে ভিসা পরামর্শ, কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনাসংক্রান্ত তথ্য অবহিতকরণ।

স্টেপ সাপ্পোরোর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপরত মহাব্যবস্থাপক সেইকো মিউরা

বিদেশি কোম্পানির জন্য ভর্তুকি ও প্রণোদনা

সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত করপোরেট বাণিজ্য কর, স্থায়ী সম্পদ করসহ অন্যান্য কর মওকুফ সুবিধার পাশাপাশি সাপ্পোরোয় করপোরেট স্থাপনার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ভর্তুকি। যেমন কোনো কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ের কর্মকাণ্ড ও প্রশাসনিক কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ রয়েছে সর্বোচ্চ ২০০ মিলিয়ন ইয়েন ভর্তুকি। আইটি, কনটেন্ট ও জৈবপ্রযুক্তি শিল্পগুলোর ক্ষেত্রে ভাড়া বাবদ সর্বোচ্চ ১০০ মিলিয়ন ইয়েন। উৎপাদন কারখানা, সরবরাহ এবং গবেষণা ও উন্নয়ন স্থাপনায় পাবে সর্বোচ্চ ১ বিলিয়ন ইয়েন। এ ছাড়া উদ্যোক্তা কোম্পানিগুলোকে সাপ্পোরোয় ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রাথমিক পরিদর্শনসংক্রান্ত খরচ বাবদ দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ ইয়েন। বাংলাদেশ থেকে এবং জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশি উদ্যোক্তারাও এর সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন।

এর বাইরে উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য রয়েছে আরেকটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান ‘স্টার্টআপ হোক্কাইদো’।

এয়ার ওয়াটার হাইড্রোজেন রিফুয়েলিং স্টেশন

স্টার্টআপ হোক্কাইদো

এই অঞ্চলের উদ্যোক্তা পরিবেশের উন্নয়নে তিনটি প্রধান প্রশাসনিক সংস্থাকে যুক্ত করে ২০২৩ সালে চালু হয় ‘স্টার্টআপ হোক্কাইদো’ কাঠামোটি। সংস্থাগুলো হচ্ছে সাপ্পোরো নগর কর্তৃপক্ষ, হোক্কাইদো জেলা প্রশাসন এবং হোক্কাইদো অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প ব্যুরো। সাপ্পোরোর নগর ভবনে রেট্রো স্টাইলে সাজানো এর কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী কমিটির নির্বাহী পরিচালক কিয়োহেই ফুজিমার সঙ্গে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা সহায়তার ক্ষেত্রে মূলত তিনটি ক্ষেত্রের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কৃষি ও খাদ্যশিল্প, মহাকাশশিল্প এবং পরিবেশ ও জ্বালানিশিল্প। এর মধ্যে মহাকাশশিল্পে রকেটের জন্য বায়োফুয়েল উৎপাদন এবং মহাকাশের আবর্জনা পরিষ্কার বড় খাত। অন্যদিকে পরিবেশ ও জ্বালানিশিল্প খাতে, বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র ও ডেটা সেন্টারের বাইরে স্যাটেলাইট উপাত্ত বিশ্লেষণ কোম্পানি, বন ও নগর বিশ্লেষণ কোম্পানিগুলোও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ গবেষণাকে যুক্ত করে হোক্কাইদোর উপযোগী উদ্যোক্তা কোম্পানির সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে তারা। এই উদ্যোক্তা সহায়তা কেবল জাপানের অভ্যন্তরীণ নয়, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতেও আগ্রহী ‘স্টার্টআপ হোক্কাইদো’। তাদের এই কর্মকাণ্ডকে আরও গতিশীল করতে আগামী ২২ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি সাপ্পোরোতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘শেইক-এইচ’ নামের স্টার্টআপ বা উদ্যোক্তা কোম্পানিগুলোর বৈশ্বিক সম্মেলন। বাংলাদেশের নবীন উদ্যোক্তারা এর সুযোগ নিতে পারেন অনায়াসেই।

মানবজাতির অভিন্ন চ্যালেঞ্জ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বনমুক্ত বা পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনে নতুন উদ্ভাবনী প্রযুক্তির বিকল্প নেই। কিছুটা দেরিতে হলেও জাপান যে এতে মনোযোগ দিয়েছে, সেটি আশার বিষয়। অন্যদিকে এত দিন ব্যয়বহুল বলা হলেও এখন এই খাতই হয়ে উঠেছে বিনিয়োগের একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি উদ্যোক্তা কোম্পানিগুলোর জন্য এটি এখন নতুন সুযোগ। হোক্কাইদো-সাপ্পোরোর মডেল এ ক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যা নিশ্চিতভাবেই ২০৫০ সালে জাপানকে কার্বনমুক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাতে বিশ্বও হবে জলবায়ুগতভাবে আরও নিরাপদ, এমনকি বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলও পাবে যার পরোক্ষ সুফল।