
উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত শেনঝেনের একটি পরীক্ষাগারে চীনের বিজ্ঞানীরা এমন একটি যন্ত্রের প্রতিলিপি বা প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন, যা বানানো ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর চেষ্টা করে আসছে। এই যন্ত্রটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্মার্টফোন এবং পশ্চিমা সামরিক আধিপত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রে ব্যবহৃত অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদনে সক্ষম।
চীনের বিজ্ঞানীরা ২০২৫ সালের শুরুর দিকে প্রোটোটাইপ যন্ত্রটি তৈরি করেছেন। বর্তমানে পরীক্ষাধীন যন্ত্রটি প্রায় পুরো একটি কারখানার মেঝেজুড়ে বিস্তৃত। প্রকল্পটির সঙ্গে পরিচিত দুই ব্যক্তির মতে, নেদারল্যান্ডসের সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এএসএমএলের সাবেক প্রকৌশলীদের একটি দল চীনের কোম্পানিটির এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট লিথোগ্রাফি (ইইউভি) মেশিনটি রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়া (একটি যন্ত্রের অভ্যন্তরীণ গঠন দেখে তা নতুন করে তৈরির প্রক্রিয়া) ব্যবহার করে তৈরি করেছে।
ইইউভি যন্ত্রগুলো প্রযুক্তিগত এক স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এগুলো এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট আলোর রশ্মি বা অতি বেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে সিলিকন ওয়েফারের ওপর মানুষের চুলের চেয়েও হাজার হাজার গুণ পাতলা সার্কিট খোদাই করে—যে সক্ষমতা বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে। সার্কিট যত ছোট হয়, চিপ তত বেশি শক্তিশালী হয়।
চীনের তৈরি যন্ত্রটি কার্যকর অবস্থায় রয়েছে এবং সফলভাবে এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট আলো উৎপন্ন করতে পারছে। তবে এখনো কার্যকর চিপ তৈরি করতে পারেনি বলে প্রকল্প সম্পর্কে জানা দুই ব্যক্তি জানিয়েছেন।
গত এপ্রিল মাসে এএসএমএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্রিস্টোফ ফুকে বলেছিলেন, এমন প্রযুক্তি উন্নয়নে চীনের অনেক অনেক বছর লাগবে। কিন্তু রয়টার্স প্রথমবারের মতো যে প্রোটোটাইপের অস্তিত্বের কথা জানাচ্ছে, তা ইঙ্গিত দিচ্ছে—বিশ্লেষকেরা যতটা ধারণা করেছিলেন, তার চেয়ে সেমিকন্ডাক্টর স্বনির্ভরতার অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছে চীন।
তবে চীন এখনো বড় ধরনের কারিগরি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমা সরবরাহকারীরা যে উচ্চ নির্ভুলতার অপটিক্যাল সিস্টেম তৈরি করে, তা অনুকরণ করার ক্ষেত্রে।
দুটি সূত্রের মতে, মূল বাজারের বাইরের কোনো দ্বিতীয় উৎস থেকে এএসএমএলের পুরোনো যন্ত্রাংশ পেয়ে চীন একটি দেশীয় প্রোটোটাইপ তৈরি করতে পেরেছে। দেশটির সরকার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে—২০২৮ সালের মধ্যে ওই প্রোটোটাইপে কার্যকর চিপ উৎপাদন করার।
তবে প্রকল্পটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ২০৩০ সালকে আরও বাস্তবসম্মত লক্ষ্য ধরা যায়। তবু এটি বিশ্লেষকদের ধারণা করা এক দশকের সময়সীমার তুলনায় কয়েক বছর আগেই তৈরি হয়ে যাবে। তাঁরা মনে করেছিলেন চীন পশ্চিমাদের সমকক্ষ হতে এত সময় লাগবে।এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে চীনা কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি।
এই সাফল্য সেমিকন্ডাক্টরে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে চীন সরকারের ছয় বছরব্যাপী উদ্যোগের সুফল। দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারগুলোর একটি এটি। যদিও চীনের সেমিকন্ডাক্টর লক্ষ্যগুলো প্রকাশ্য, তবে শেনঝেনের ইইউভি প্রকল্পটি গোপনে পরিচালিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান।
প্রকল্পটি চীনের সেমিকন্ডাক্টর কৌশলের আওতায় পড়ে। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের মতে, সির ঘনিষ্ঠ সহযোগী দিং শ্যুয়েশিয়াংয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে প্রকল্পটি। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিশনের প্রধান।
চীনের ইলেকট্রনিকস খাতের বড় প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে সারা দেশে বিস্তৃত বহু কোম্পানি ও রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যেখানে হাজার হাজার প্রকৌশলী যুক্ত আছেন—দুজন ব্যক্তি ও তৃতীয় একটি সূত্র এমনটাই জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধকালীন পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’-এর চীনা সংস্করণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি বলেন, ‘লক্ষ্য হলো, চীন যেন শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে চীনে তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করেই উন্নত চিপ তৈরি করতে পারে। চীন চায় তাদের সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে শতভাগ বাদ দিতে।’
হুয়াওয়ে, চীনের রাষ্ট্রপরিষদ, ওয়াশিংটনে চীনা দূতাবাস এবং চীনের শিল্প ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়—কেউই এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
এখন পর্যন্ত কেবল একটি প্রতিষ্ঠানই ইইউভি প্রযুক্তি পুরোপুরি আয়ত্ত করেছে। সেটি হলো নেদারল্যান্ডসের এএসএমএল। প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর ভেল্ডহোভেনে। প্রায় ২৫ কোটি ডলার দামের এসব যন্ত্র এনভিডিয়া ও এএমডির মতো প্রতিষ্ঠানের নকশা করা এবং টিএসএমসি, ইন্টেল ও স্যামসাংয়ের মতো চিপ নির্মাতাদের উৎপাদিত সবচেয়ে উন্নত চিপ তৈরিতে অপরিহার্য।
এএসএমএল ২০০১ সালে ইইউভি প্রযুক্তির প্রথম কার্যকর প্রোটোটাইপ তৈরি করে। প্রতিষ্ঠানটি রয়টার্সকে জানিয়েছে, ২০১৯ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চিপ উৎপাদন শুরু করে তারা। তবে এ পর্যায়ে পৌঁছাতে তাদের প্রায় দুই দশক সময় এবং গবেষণা ও উন্নয়নে শত শত কোটি ইউরো ব্যয় করতে হয়েছে।
এএসএমএল এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমাদের প্রযুক্তি অনুকরণ করতে চাওয়া কোম্পানিগুলোর বিষয়টি বোধগম্য। তবে এটি মোটেও সহজ কাজ নয়।’ এএসএমএলের ইইউভি সিস্টেমগুলো বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে পাওয়া যায়।
২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র নেদারল্যান্ডসের ওপর চাপ দিতে শুরু করে, যাতে এএসএমএল চীনের কাছে ইইউভি সিস্টেম বিক্রি না করে। ২০২২ সালে এই বিধিনিষেধ আরও বিস্তৃত হয়, যখন বাইডেন প্রশাসন উন্নত সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিতে চীনের প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে ব্যাপক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এএসএমএল রয়টার্সকে জানিয়েছে, চীনে কখনোই কোনো ইইউভি সিস্টেম বিক্রি করা হয়নি।
এই নিয়ন্ত্রণ শুধু ইইউভি সিস্টেম নয়, পুরোনো ডিপ আলট্রাভায়োলেট (ডিইউভি) লিথোগ্রাফি মেশিনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যেগুলো দিয়ে তুলনামূলক কম উন্নত চিপ যেমন হুয়াওয়ের চিপ তৈরি করা হয়। লক্ষ্য ছিল চিপ তৈরির সক্ষমতায় চীনকে অন্তত এক প্রজন্ম পিছিয়ে রাখা।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন উন্নত সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন সরঞ্জামের ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা আরও জোরদার করেছে এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ‘ফাঁকফোকর’ বন্ধ করতে অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে।
ডাচ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সংবেদনশীল প্রযুক্তিতে প্রবেশ ঠেকাতে নেদারল্যান্ডস এমন নীতি প্রণয়ন করছে, যার আওতায় জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মীদের নিরাপত্তা যাচাই করতে হবে, যাতে খারাপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন ব্যক্তি বা যাদের ওপর চাপ প্রয়োগের ঝুঁকি রয়েছে, তারা এসব প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার না পায়।
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা কয়েক বছর ধরে চীনের সেমিকন্ডাক্টর আত্মনির্ভরতার অগ্রযাত্রা ধীর করে দিয়েছে এবং হুয়াওয়ের উন্নত চিপ উৎপাদন সীমিত করেছে—এমনটাই বলেছেন সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি ও তৃতীয় আরেকটি সূত্র।
প্রকল্পটির গোপনীয়তার কারণে সূত্রগুলো নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া এএসএমএলের এক অভিজ্ঞ চীনা প্রকৌশলী অবাক হয়ে যান যখন দেখেন, তাঁর মোটা অঙ্কের সাইনিং বোনাসের সঙ্গে একটি ভুয়া নামে ইস্যু করা পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়েছে। এমনটাই জানিয়েছেন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তি।
ভেতরে প্রবেশের পর ওই প্রকৌশলী বুঝতে পারেন, তাঁর আরও কয়েকজন সাবেক এএসএমএল সহকর্মীও ছদ্মনামে কাজ করছেন এবং গোপনীয়তা বজায় রাখতে কর্মস্থলে তাঁদের ভুয়া নাম ব্যবহার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরেক ব্যক্তি আলাদাভাবে নিশ্চিত করেছেন, নিরাপত্তা-ঘেরা ওই স্থাপনার ভেতরে অন্য কর্মীদের কাছ থেকে পরিচয় গোপন রাখতে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভুয়া আইডি দেওয়া হয়েছিল।
দুজনের ভাষ্য অনুযায়ী, নির্দেশনা ছিল স্পষ্ট—জাতীয় নিরাপত্তার আওতায় শ্রেণিভুক্ত এই প্রকল্পে তাঁরা কী বানাচ্ছেন, কিংবা তাঁরা সেখানে আছেন, এ তথ্য স্থাপনার বাইরে কেউ জানতে পারবে না।
সূত্রগুলো জানায়, দলে রয়েছেন সদ্য অবসর নেওয়া, চীনা বংশোদ্ভূত এএসএমএলের সাবেক প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা। সংবেদনশীল কারিগরি জ্ঞান থাকার কারণে তাঁরা ছিলেন প্রধান নিয়োগের কেন্দ্রে, আর কোম্পানি ছাড়ার পর পেশাগত সীমাবদ্ধতাও তুলনামূলক কম ছিল।
নেদারল্যান্ডসে কর্মরত চীনা নাগরিকত্বধারী এএসএমএলের বর্তমান দুই কর্মী রয়টার্সকে জানান, ২০২০ সাল থেকে অন্তত হুয়াওয়ের নিয়োগকারীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। মন্তব্যের অনুরোধে হুয়াওয়ে কোনো সাড়া দেয়নি।
ইউরোপের গোপনীয়তা আইন এএসএমএলের পক্ষে সাবেক কর্মীদের ওপর নজরদারি করার সক্ষমতা সীমিত করে। কর্মীরা নন-ডিসক্লোজার চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও সীমান্ত পেরিয়ে সেগুলোর বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।
২০১৯ সালে বাণিজ্যিক গোপন তথ্য চুরির অভিযোগে এক সাবেক চীনা প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে এএসএমএল ৮৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের রায় পায়। তবে আদালতের নথি অনুযায়ী, অভিযুক্ত ব্যক্তি দেউলিয়া ঘোষণা করে পরে বেইজিংয়ে চীনা সরকারের সহায়তায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
রয়টার্সকে এএসএমএল জানিয়েছে, তারা বাণিজ্যিক গোপনীয় তথ্য সতর্কতার সঙ্গে সুরক্ষা দেয়। কোম্পানিটি বলেছে, সাবেক কর্মীরা কোথায় কাজ করবেন, তা এএসএমএল নিয়ন্ত্রণ বা সীমিত করতে পারে না, তবে সব কর্মীই তাঁদের চুক্তির গোপনীয়তা সংক্রান্ত ধারার অধীনে আবদ্ধ।
তারা আরও জানায়, বাণিজ্যিক গোপন তথ্য চুরির ঘটনায় তারা সফলভাবে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। রয়টার্স নিশ্চিত হতে পারেনি, চীনের লিথোগ্রাফি কর্মসূচিতে জড়িত সাবেক এএসএমএলের কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না।
কোম্পানিটি জানায়, ইইউভি–সংক্রান্ত জ্ঞান সুরক্ষায় তারা এমন ব্যবস্থা নিয়েছে, যাতে কোম্পানির ভেতরেও কেবল নির্বাচিত কিছু কর্মীই ওই তথ্যের প্রবেশাধিকার পান।
ডাচ গোয়েন্দা সংস্থা এপ্রিলের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে জানায়, চীন পশ্চিমা দেশগুলো থেকে উন্নত প্রযুক্তি ও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টায় ব্যাপক গুপ্তচরবৃত্তি কর্মসূচি ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা বিজ্ঞানী ও উচ্চপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের নিয়োগ।
প্রকল্পের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত এএসএমএলের সাবেক কর্মীদের কারণেই শেনঝেনে এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে। তাদের প্রযুক্তির অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া মেশিনগুলোকে রিভার্স-ইঞ্জিনিয়ার করা প্রায় অসম্ভব হতো।
চীনের সরকার ২০১৯ সালে বিদেশে থাকা সেমিকন্ডাক্টর বিশেষজ্ঞদের আকৃষ্ট করার জন্য একটি আগ্রাসী প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, ৩ থেকে ৫ মিলিয়ন ইউয়ান (৪ লাখ ২০ হাজার থেকে ৭ লাখ মার্কিন ডলার) সাইনিং বোনাস এবং বাড়ি ক্রয়ের সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন লিন নান, যিনি এএসএমএলের লাইট সোর্স টেকনোলজি সাবেক প্রধান ছিলেন। তাঁর দল চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেসের সাংহাই ইনস্টিটিউট অব অপটিক্সে ১৮ মাসে ইইউভি লাইট সোর্সে আটটি পেটেন্ট দাখিল করেছে।
কয়েকজন প্রযুক্তিবিদকে চীনা পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল এবং দ্বৈত নাগরিকত্ব বজায় রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যদিও চীন আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিষিদ্ধ। চীনা কর্তৃপক্ষ মন্তব্যের জন্য সাড়া দেয়নি।
নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এএসএমএলের সবচেয়ে উন্নত ইইউভি (এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট) লিথোগ্রাফি যন্ত্রগুলো আকারে প্রায় একটি স্কুল বাসের সমান এবং এগুলোর ওজন ১৮০ টন।
সংশ্লিষ্ট দুই সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শেনঝেনের গবেষণাগারে তৈরি করা চীনা প্রোটোটাইপ বা প্রাথমিক নমুনাটির আকার মূল যন্ত্রের মতো ছোট করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন গবেষকেরা। এরপর যন্ত্রটির সক্ষমতা বাড়াতে সেটির আকার কয়েক গুণ বড় করে তৈরি করা হয়েছে।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, এএসএমএলের যন্ত্রের তুলনায় চীনের এই প্রোটোটাইপটি যথেষ্ট দক্ষতাসম্পন্ন নয়, তবে এটি পরীক্ষামূলক কাজের জন্য যথেষ্ট কার্যকর।
দুই সূত্রের দাবি, চীনের এই প্রযুক্তি এএসএমএলের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হলো উন্নত অপটিক্যাল সিস্টেমের অভাব। এএসএমএলের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী জার্মানির কার্ল জেইস এজির মতো উন্নত অপটিক্যাল সিস্টেম সংগ্রহ করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে চীনা গবেষকদের। তবে বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি জেইস।
এই যন্ত্রগুলোতে গলিত টিনের ওপর প্রতি সেকেন্ডে ৫০ হাজার বার লেজার নিক্ষেপ করা হয়, যা ২ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্লাজমা তৈরি করে।
জেইসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই আলোকরশ্মিকে নির্দিষ্ট বিন্দুতে ফেলতে বিশেষ ধরনের আয়না ব্যবহার করা হয়, যা তৈরি করতে কয়েক মাস সময় লাগে। ওই দুই ব্যক্তি জানিয়েছেন, এসব প্রযুক্তির নিজস্ব বা দেশি বিকল্প তৈরিতে চীনের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের অধীন ‘চ্যাংচুন ইনস্টিটিউট অব অপটিকস, ফাইন মেকানিকস অ্যান্ড ফিজিকস’ (সিআইওএমপি) প্রোটোটাইপটির অপটিক্যাল সিস্টেমে অতি বেগুনি রশ্মি বা ইইউভি যুক্ত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। এর ফলে ২০২৫ সালের শুরুর দিকেই যন্ত্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা সম্ভব হতে পারে। তবে এর অপটিক্যাল ব্যবস্থায় এখনো অনেক পরিমার্জন ও উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান ওই ব্যক্তি।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলেও সিআইওএমপি কোনো সাড়া দেয়নি।
গত মার্চ মাসে নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক অনলাইন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, লিথোগ্রাফি নিয়ে কাজ করা পিএইচডিধারী গবেষকদের জন্য তারা ‘অবারিত’ বা সীমাহীন বেতনের প্রস্তাব দিচ্ছে।
এ ছাড়া গবেষকদের জন্য ৪০ লাখ ইউয়ান (প্রায় ৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার) পর্যন্ত গবেষণা অনুদান এবং অতিরিক্ত ১০ লাখ ইউয়ান (প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার) ব্যক্তিগত বিশেষ ভাতা দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেমি অ্যানালাইসিসের বিশ্লেষক ও এএসএমএলের সাবেক প্রকৌশলী জেফ কোচ বলেন, যদি ‘আলোর উৎসে পর্যাপ্ত শক্তি থাকে, এটি নির্ভরযোগ্য হয় এবং খুব বেশি দূষণ তৈরি না করে,’ তবেই চীন এই খাতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি’ অর্জন করতে পারবে।
জেফ কোচ আরও বলেন, প্রযুক্তিগতভাবে এটি যে সম্ভব, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন কেবল সময়ের। চীনের বড় সুবিধা হলো, বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ইইউভি প্রযুক্তির অস্তিত্ব রয়েছে। ফলে তাদের একদম শূন্য থেকে শুরু করতে হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ পেতে চীন এএসএমএলের পুরোনো যন্ত্র থেকে বিভিন্ন অংশ সংগ্রহ করছে। এ ছাড়া ‘সেকেন্ড-হ্যান্ড’ বা ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের বাজার থেকেও এএসএমএলের সরবরাহকারীদের কাছ থেকে পার্টস সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ওই সূত্রগুলো আরও জানায়, প্রকৃত ক্রেতার পরিচয় গোপন রাখতে অনেক সময় মধ্যস্থতাকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র ও আরেক ব্যক্তির বরাতে জানা গেছে, এই প্রোটোটাইপ বা প্রাথমিক সংস্করণ তৈরিতে জাপানের নিকন ও ক্যাননের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এমন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নিকন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে ক্যানন জানিয়েছে, এ ধরনের প্রতিবেদন সম্পর্কে তারা কিছু জানে না। ওয়াশিংটনে অবস্থিত জাপান দূতাবাসও এ নিয়ে মন্তব্যের অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি।
সূত্রগুলো জানায়, আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো নিয়মিত পুরোনো সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সরঞ্জাম নিলামে তোলে। আলিবাবার মালিকানাধীন প্ল্যাটফর্ম ‘আলিবাবা অকশন’-এর নিলাম তালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত চীনে এএসএমএলের পুরোনো লিথোগ্রাফি মেশিন বিক্রি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, প্রায় ১০০ জন সদ্য স্নাতক পাস করা প্রকৌশলীর একটি দল ইইউভি ও ডিইউভি লিথোগ্রাফি মেশিনের যন্ত্রাংশগুলোর ‘রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং’ নিয়ে কাজ করছে। সেখানে প্রত্যেক কর্মীর ডেস্ক আলাদা ক্যামেরায় ভিডিও করা হয়। যন্ত্রাংশগুলো খোলা এবং আবার জোড়া দেওয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নথিবদ্ধ করা হয়, যাকে চীনের লিথোগ্রাফি খাতের উন্নতির জন্য অন্যতম প্রধান কৌশল হিসেবে বর্ণনা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ওই ব্যক্তিরা আরও জানান, যেসব কর্মী সফলভাবে একটি যন্ত্রাংশ আবার জোড়া দিতে পারেন, তাঁদের বিশেষ বোনাস দেওয়া হয়।
হুয়াওয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত চার ব্যক্তি জানিয়েছেন, চীনের ইইউভি প্রকল্পটি সরকারিভাবে পরিচালিত হলেও এর সরবরাহ শৃঙ্খলের (সাপ্লাই চেইন) প্রতিটি ধাপে যুক্ত রয়েছে হুয়াওয়ে। চিপের নকশা তৈরি ও এর সরঞ্জাম উৎপাদন থেকে শুরু করে স্মার্টফোনের মতো পণ্যে সেই চিপের চূড়ান্ত সংযোজন—সব পর্যায়েই প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, হুয়াওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেন জেংফেই এই প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে চীনের শীর্ষ নেতাদের নিয়মিত অবহিত করেন।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র হুয়াওয়েকে তাদের ‘এনটিটি লিস্ট’ বা কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে লাইসেন্স ছাড়া মার্কিন কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সফল করতে হুয়াওয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অফিস, কারখানা ও গবেষণা কেন্দ্রে কর্মী মোতায়েন করেছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, সেমিকন্ডাক্টর টিমে কর্মরতদের প্রায়ই কর্মস্থলে রাত কাটাতে হয় এবং সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে তাদের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি নেই। এমনকি অত্যন্ত সংবেদনশীল কাজে যুক্ত দলগুলোর ফোন ব্যবহারের ওপরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
হুয়াওয়ের ভেতরেও খুব কমসংখ্যক কর্মী এই কাজের পরিধি সম্পর্কে জানেন। এক ব্যক্তি বলেন, ‘প্রকল্পের গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রতিটি দলকে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখা হয়েছে। এক দল জানেই না অন্য দল আসলে কী কাজ করছে।’