যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান

ফিরে দেখা

হলিউডের রুপালি পর্দা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট

সবে দুই মাস হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ওয়াশিংটন ডিসির হিলটন হোটেলে একটি অনুষ্ঠান শেষে কর্মকর্তাদের নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান। হঠাৎই শোনা যায় গুলির শব্দ। পরপর ছয়টি গুলি ছোড়ে আততায়ী। গুলিবিদ্ধ হলেও সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান রিগ্যান। টানা দুই মেয়াদ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। নিজের শাসনামলে সরকার পরিচালনার খোলনলচে বদলে দিয়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আজ ৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের জন্মদিন।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান। যোগাযোগ দক্ষতা, ভবিষ্যৎ নিয়ে সব সময় আশাবাদী থাকা এবং আমেরিকার সম্ভাবনার ওপর অবিচল বিশ্বাসের কারণেও তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

১৯১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে জন্ম হয় রোনাল্ড উইলসন রিগ্যানের। বাবা জন এডওয়ার্ড রিগ্যান ও মা নেলি উইলসন রিগ্যান। কয়েকবার আবাস বদলের পর ১৯২০ সালে অঙ্গরাজ্যের ডিক্সনে থিতু হয় রিগ্যান পরিবার।

স্কুল ও কলেজজীবনে দারুণ অ্যাথলেট ছিলেন রোনাল্ড রিগ্যান। ভালো ফুটবল খেলতেন, ছিলেন দৌড়বিদ ও সাঁতারু। ১৯৩২ সালে খেলাধুলার ধারাভাষ্যকার হিসেবে একটি রেডিওতে যোগ দেন।

১৯৩৭ সালে অভিনয়জগতে নাম লেখান রিগ্যান। তিনি ৫০টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। টেলিভিশনেও কাজ করেছেন।

সিনেমাজগৎ থেকে হোয়াইট হাউসে যাত্রা

১৯৩৭ সালে হলিউডে অভিনয়জগতে নাম লেখান রিগ্যান। পরের তিন দশকে তিনি ৫০টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করেন। কাজ করেছেন টেলিভিশনেও।
রিগ্যানের অভিনয় করা জনপ্রিয় সিনেমাগুলোর অন্যতম ‘ন্যুট রকেন অল আমেরিকান’। ১৯৪০ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি একটি বায়োপিক। আমেরিকার একজন ফুটবলারের জীবনের ওপর তৈরি করা।

১৯৪২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কিংস রো’–তে রিগ্যানের অভিনয়ও দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তিনি ওই সিনেমায় দুর্ঘটনায় পা হারানো এক ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেন।

১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রিগ্যান স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি টেলিভিশন সিরিজেও কাজ করেছেন।

১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া বিতর্কিত সিনেমা ‘দ্য কিলার্স’–এ অভিনয় করেছিলেন তিনি। এটি ছিল রিগ্যানের অভিনয়জীবনের শেষ সিনেমা।

১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হন রিগ্যান। তখন থেকেই হোয়াইট হাউসে যাওয়ার স্বপ্ন তাঁর চোখে। ১৯৬৮ ও ১৯৭৬ সালে তিনি দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দল থেকে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুবারই ব্যর্থ হন। তবে ১৯৮০ সালে দল তাঁকে আর খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি।

সেবার ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জিমি কার্টারকে বড় ব্যবধানে হারান রিগ্যান। তিনি ৪৮৯টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট জেতেন। কার্টার জেতেন মাত্র ৪৯ ভোট। ৬৯ বছর বয়সে ১৯৮১ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বয়স্ক (ওই সময় পর্যন্ত) প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি।

নিজের অভিষেক ভাষণেই রিগ্যান বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সরকার গতানুগতিক পথে চলবে না। অভিষেক ভাষণে রিগ্যান বলেছিলেন, ‘আমাদের সমস্যার সমাধান সরকার নয়; সরকারই সমস্যা।’

২০০৩ সালে ওয়াশিংটনে একটি আদালতে হাজিরা দিতে এসেছেন জন হিঙ্কলি জুনিয়র। তিনি রোনাল্ড রিগ্যানকে গুলি করেছিলেন

গুপ্তহত্যার চেষ্টা

শপথ গ্রহণের মাত্র দুই মাসের মাথায় হলিউড অভিনেত্রী জোডি ফস্টারের এক পাগল ভক্তের গুলিতে প্রাণ যেতে বসেছিল রিগ্যানের। ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ জন হিঙ্কলি জুনিয়র নামের এক তরুণ রিগ্যানকে লক্ষ্য করে ছয়টি গুলি ছোড়েন। সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্টরা রিগ্যানকে ঘিরে ধরে দ্রুত গাড়িতে তুলে ফেলেন। প্রথমে ভাবা হয়েছিল, প্রেসিডেন্টকে গুলিবিদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করা গেছে। গাড়ি হোয়াইট হাউসের পথে ছুটতে শুরু করে। কিন্তু গাড়িতে ওঠার পর রিগ্যান রক্তবমি করলে দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

চিকিৎসকেরা দেখতে পান, গুলি রিগ্যানের ফুসফুস ছিদ্র করে দিয়েছে। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে হৃদ্‌যন্ত্র। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গুলি বের করা হয়। আদালত হিঙ্কলিকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা করেন। হলিউড অভিনেত্রী জোডি ফস্টারের জন্য পাগল ছিলেন এই তরুণ। ফস্টারের মনোযোগ কাড়তে দেশের প্রেসিডেন্টকে গুলি করে বসেন তিনি। আরও তিনজনের গায়ে গুলি লেগেছিল। তিনজনই অবশ্য প্রাণে রক্ষা পান। কয়েক সপ্তাহ চিকিৎসা ও বিশ্রামের পর কাজে ফেরেন রিগ্যান।

রিগ্যান বিপ্লব ‘রিগ্যানোমিক্স’

মরতে মরতে বেঁচে ফেরা রিগ্যান দায়িত্বে ফিরেই পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করেন। দেশ ও দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিচালনা নীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আনেন তিনি। দেশের অর্থনীতি পরিচালনায় গতানুগতিক নীতির বাইরে গিয়ে নতুন এক কৌশল অবলম্বন করেন। অর্থনীতি পরিচালনায় তাঁর ওই নীতি ‘রিগ্যানোমিক্স’ নামের পরিচিতি পায়।

নতুন কৌশলে রিগ্যান কর কর্তন, নজরদারি কমানো এবং সরকার পরিচালনার ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত খাতকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের অর্থনীতিকে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর এই কৌশল সে সময়ে দারুণ কার্যকর হয় এবং নিজের উদ্দেশ্যে তিনি সফল হয়েছিলেন। যদিও সমালোচকদের যুক্তি ছিল, এই নীতির ফলে আয়বৈষম্য আরও বাড়বে, জাতীয় ঋণের পরিমাণও বেড়ে যাবে।

কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান

কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেছিলেন রিগ্যান। তিনি প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি করেন এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে তিনি ‘শয়তানের সাম্রাজ্য’ (এভিল এম্পায়ার) বলেছিলেন। রিগ্যানের প্রশাসন স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ (এসডিআই) চালু করেছিল। এটি একটি ক্ষেপণাস্ত্র সুরক্ষাব্যবস্থা। এটি চালু করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্কে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠেছিল।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। ছবিটি ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসে তোলা

স্নায়ুযুদ্ধ অবসানে ভূমিকা

রিগ্যান যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন স্নায়ুযুদ্ধ পরিস্থিতি বেশ জটিল। তার মধ্যেই কমিউনিস্ট শাসন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কঠোর বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন রিগ্যান। তাঁর সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য ১৯৮০-এর দশকের প্রথম ভাগে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। তবে মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আসার পর রিগ্যান তাঁর কঠোর বৈদেশিক নীতি থেকে সরে গিয়ে কূটনৈতিক অবস্থান নেন।

ফলে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েকটি অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি হয়। ঐতিহাসিক ওই চুক্তিগুলোর মধ্যে ১৯৮৭ সালে হওয়া ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস (আইএনএফ) চুক্তিও অন্তর্ভুক্ত। বলা হয়, রিগ্যানের কূটনীতির সঙ্গে কঠোরতার মিশেল করার এই দক্ষতা স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং সারা বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে গর্বাচেভের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সে সময়ের দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা হ্রাসে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি

১৯৮৪ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রিগ্যান। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৪৯টিতেই জেতেন তিন। এ মেয়াদে দৃঢ় ভূমিকা রেখে স্নায়ুযুদ্ধ শেষের শুরু করতে পারার জন্য রিগ্যান যেমন প্রশংসিত হন, তেমনি নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছে তাঁর নাম।

বিশেষ করে ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি। নিজেদের আইন লঙ্ঘন করে ১৯৮৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি শুরু করে। অস্ত্র বিক্রির টাকা ব্যয় হতে থাকে নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের পেছনে। বিদ্রোহীরা তখন দেশটির কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাতে লড়ছে। ১৯৮৬ সালে বিষয়টি জানাজানি হলে তা ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি হিসেবে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়। এই কেলেঙ্কারি প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে বেশ চাপের মধ্যে ফেলে।

যদিও রিগ্যান সরাসরি ইরান-কন্ট্রা চুক্তির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু এ কেলেঙ্কারি তাঁর প্রশাসনের ভাবমূর্তির বেশ ক্ষতি করেছিল।

ক্ষমতা ছাড়ার পর স্ত্রী ন্যান্সি রিগ্যানকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস শুরু করেন রোনাল্ড রিগ্যান।

আলঝেইমার

কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ালেও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পারার কারণে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসেবেই ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন রিগ্যান। ওয়াশিংটন থেকে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় ফিরে যান এবং স্ত্রী ন্যান্সি রিগ্যানকে নিয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার জনগণের প্রতি হাতে লেখা এক চিঠিতে রিগ্যান নিজেই জানান, তিনি আলঝেইমারে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর মায়ের একই রোগ ছিল।

এর পর থেকে অন্তরালে চলে যান সাবেক এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মৃত্যুর আগে তাঁকে জনসমক্ষে আর খুব বেশি দেখা যায়নি। ২০০৪ সালের ৫ জুন নিজ বাড়িতে মারা যান রিগ্যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।