আধুনিক সমাজে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে, যৌথ পরিবারগুলো একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। এখন পরিবার বলতে আমরা শুধু মা-বাবা, ভাই-বোনকে বুঝি। একক পরিবারেও কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতা দেখা যাচ্ছে।
মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের বিচ্ছিন্নতা কি সম্ভব? এ বিষয়ে বৃহৎ পরিসরে তেমন কোনো গবেষণা এখনো হয়নি। তবে এখন পর্যন্ত যেসব গবেষণার তথ্য হাতে আছে, সে অনুযায়ী মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা আশ্চর্যজনকভাবে খুব সাধারণ ঘটনা।
নিজের ২১তম জন্মদিনের কয়েক দিন পর মায়ের সঙ্গে ফোনে তুমুল ঝগড়া হয় সারাহর। রাগে, ক্ষোভে প্রথমবারের মতো মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এই তরুণী। সারাহ (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার খুব রাগ হয়েছিল।’
সারাহর রাগের কারণ তাঁর জন্মদিন উদ্যাপনে মা-বাবার অংশ না নেওয়া। কারণ হিসেবে তাঁরা অতিরিক্ত ব্যস্ততার কথা বলেছিলেন, যা মেনে নিতে পারেননি সারাহ। তবে এটাই তাঁর ক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়।
সবকিছুর প্রতি মায়ের অনীহা, আত্মকেন্দ্রিকতা এবং মেয়ের জীবনের প্রতি চরম অনাগ্রহ প্রকাশের ফলে মায়ের ওপর ভীষণ বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন সারাহ। সারাহর মা তাঁর শিক্ষাগ্রহণকে অপ্রয়োজনীয় ও তুচ্ছ করে দেখাতেন এবং পারিবারিক খামারের কাজে সাহায্য করার জন্য সারাহকে নিয়মিত চাপ দিতেন।
সারাহর রাগের কারণ, অতিরিক্ত ব্যস্ততার কথা বলে তাঁর জন্মদিন উদ্যাপনে মা-বাবার অংশ না নেওয়া, যা মেনে নিতে পারেনি সারাহ। তবে এটাই তাঁর ক্ষোভের একমাত্র কারণ নয়।
তবে মায়ের যে বিষয়টি সারাহকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিত, তা হলো, কর্তৃত্ববাদী ও মাঝেমধ্যে নির্যাতনকারী হয়ে ওঠা বাবার হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করতে মায়ের ব্যর্থতা।
দুই থেকে তিন বছর সারাহ তাঁর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ রেখেছিলেন। সারাহর মা-ও তাঁর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রাখেননি। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সারাহ বলেন, ‘আমার মুক্তি পাওয়ার অনুভূতি হয়েছিল।’
তবে সারাহ যখন বিদেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সবকিছু তিক্ততার মধ্যে ফেলে যেতে চাননি। তাই তিনি মা-বাবার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করেন। কিন্তু এত দিন পর মেয়ের ফিরে আসা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাননি বলে জানান সারাহ।
সারাহ বলেন, তাঁদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা ছিল না, এমনকি তাঁদের আচরণে মনে হয়েছে যেন কিছুই ঘটেনি। পরের দুই–তিন দশকে আরও কয়েক দফা মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিলেন সারাহ।
সমাজে এখনো এটা একটি ট্যাবু। এটা বেশ ভয়জাগানিয়া একটি প্রসঙ্গ, যা নিয়ে মানুষ কথা বলতে চায় না। তাঁদের ধারণা, এটা কেবল অন্যদের সঙ্গেই ঘটে।লুসি ব্লেক, ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক
অনেকেই মনে করেন যে পরিবারে সদস্যদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। কিন্তু এটা প্রমাণ করার মতো তথ্য পাওয়া কঠিন।
তবে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেসব তথ্য অনুযায়ী বিষয়টি আশ্চর্যজনকভাবে সাধারণ ঘটনা। অথচ নিজের মা–বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত।
শেষ পর্যন্ত, আমাদের প্রতি মা-বাবার কী দায়িত্ব রয়েছে, আর আমাদেরই বা তাঁদের প্রতি কী দায়বদ্ধতা আছে?
মা-বাবার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক লুসি ব্লেক বলেন, ‘সমাজে এখনো এটি একটি ট্যাবু। এটা বেশ ভয়জাগানিয়া একটি প্রসঙ্গ, যা নিয়ে মানুষ কথা বলতে চায় না। তাঁদের ধারণা, এটা কেবল অন্যদের সঙ্গেই ঘটে।’
এটা কি আসলেই সম্ভব
মা-বাবার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা কখন সঠিক সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে? এমন সিদ্ধান্তে আমরা কি জীবনে সত্যিই সুখী হতে পারি?
কখনো কখনো প্রাপ্তবয়স্ক কোনো সন্তানের মানসিক সমস্যা বা মাদকাসক্তির সমস্যা থাকতে পারে এবং তাঁরা তাঁদের শৈশবের ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যেখানে সহানুভূতিশীল মা-বাবাকেও তাঁরা অন্যায়ভাবে নির্যাতনকারী খল চরিত্র হিসেবে দেখান।জোশুয়া কলম্যান, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।
যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে আট হাজারের বেশি মানুষের ওপর একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। ২০২২ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২৪ বছর সময়কালে অংশগ্রহণকারীদের ২৬ শতাংশ কোনো না কোনো সময়ে তাঁদের বাবার সঙ্গে এবং ৬ শতাংশ মায়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে ছিলেন।
এই গবেষণায় এমন কিছু মানুষও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যাঁরা এখনো কেবল কোনো উৎসব আয়োজনে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করেন।
জার্মানিতে ১০ হাজার ২০০ মানুষের ওপর অনুরূপ একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩ বছর সময়কালে ৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মায়ের সঙ্গে এবং ২০ শতাংশ বাবার সঙ্গে কোনো না কোনো সময় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিলেন।
কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে বিচ্ছিন্ন থাকা মানুষদের নিয়ে কোনো ধারাবাহিক তথ্য না থাকার কারণে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের বিচ্ছিন্ন থাকার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে বেড়ে চলছে কি না, তা বোঝা কঠিন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ববিদ কার্ল পিলেমারের মতো গবেষকেরা মনে করেন, এটি বাড়ছে।
পিলেমার বলেন, বেবি বুমারদের আগের প্রজন্মগুলোয় পারিবারিক একতা বা সংহতি একটি খুব শক্তিশালী সামাজিক নিয়ম ছিল। বলা হতো, রক্তের বন্ধন সবচেয়ে শক্তিশালী। সেসব নিয়ম এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে।
অনেক দম্পতি এখন ইচ্ছা করে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন না। এ সিদ্ধান্তে এখন সমাজে আগের তুলনায় কম বিতর্ক হয় বলেও জানান তিনি।
জোশুয়া কলম্যান একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের সঙ্গে কাজ করেন এবং এই বিষয় নিয়ে কয়েকটি বই লিখেছেন।
কলম্যান পিলেমারের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ বেড়ে যাওয়াও বিচ্ছিন্নতার একটি কারণ হতে পারে।
মা-বাবা সন্তানদের একটি নিখুঁত শৈশব দিতে বাধ্য নন। আবার সন্তানদেরও মা-বাবার প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকার দায় নেই। তবে সম্ভবত, একে অপরের প্রতি যা অবশ্যই থাকা উচিত তা হলো, সহানুভূতি দেখানো, আত্মপর্যালোচনা করা এবং পরস্পরের কথা শোনার ইচ্ছা।
কলম্যান আরও বলেন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সংস্কৃতি হলো নিজের আলাদা পরিচয়, নিজস্ব সুখ এবং নিজেকে কেন্দ্র করে চিন্তাভাবনার একটি অবস্থা। এখানে অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক দ্বিতীয় অবস্থানে থাকে।
মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা সব সময়ই খারাপ, এমনটা ভাবা উচিত নয় বলে মনে করেন সমাজতত্ত্ববিদ পিলেমার। বরং তিনি মনে করেন, অনেক মানুষের কাছে এর পেছনে যথার্থ কারণ থাকে। বিশেষ করে শৈশবে যাঁরা পরিবারের ভেতর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁদের কাছে।
এ বিষয়ে মনোরোগের চিকিৎসক কলম্যান বলেন, সামাজিকভাবে একে কলঙ্ক হিসেবে দেখা উচিত নয়।
সন্তানকে নিপীড়নের কারণে যদি মা-বাবা একেবারেই অনুশোচনা না দেখান বা সন্তানের কথা শোনার আগ্রহও যদি তাঁদের মধ্যে না থাকে, তবে সন্তানদের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য হতে পারে বলে মনে করেন জোশুয়া কলম্যান।
যুক্তরাজ্যে মা-বাবা অথবা অন্তত যেকোনো একজনের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করা প্রায় ৮০০ জনের ওপরে একটি জরিপ চালিয়েছেন ব্লেক। জরিপে তিনি দেখেছেন যে তাঁদের বেশির ভাগই মানসিক নিপীড়নের কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন।
মা-বাবা যদি সন্তানের ওপর বেশি কঠোর হন বা তাঁদের জীবন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তবে সেটা সন্তানের জন্য মানসিক নিপীড়নের কারণ হয়ে ওঠে বলে মনে করেন ব্লেক।
ব্লেক বলেন, ‘আমার মনে হয় না, কেউ এমন কোনো সম্পর্ক থাকতে চাইবেন যেখানে তিনি নিরাপদ বোধ করেন না। বেশির ভাগ সময়ই আমরা নিপীড়ন বলতে শারীরিক বা যৌন নিপীড়নকে বুঝে থাকি। তবে মানসিক নিপীড়নও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যা নিয়ে কথা বলা দরকার।’
কলম্যান ও পিলেমার মানসিক নিপীড়নকে একটি জটিল বিষয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে এর অপব্যবহার হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে সাড়ে আট হাজারের বেশি মানুষের ওপর একটি গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল। ২০২২ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২৪ বছর সময়কালে অংশগ্রহণকারীদের ২৬ শতাংশ কোনো না কোনো সময় তাঁদের বাবার সঙ্গে এবং ৬ শতাংশ মায়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ছিলেন।
কলম্যান বলেন, কখনো কখনো প্রাপ্তবয়স্ক কোনো সন্তানের মানসিক সমস্যা বা মাদকাসক্তির সমস্যা থাকতে পারে। তাঁরা তাঁদের শৈশবের ইতিহাসকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যেখানে সহানুভূতিশীল মা-বাবাকেও তাঁরা অন্যায়ভাবে নির্যাতনকারী খল চরিত্র হিসেবে দেখান।
তবে এটাও গুরুত্বপূর্ণ, যাঁরা সত্যিই মানসিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে গেছেন, তাঁদের যেন অবহেলা করা না হয়। শুধু অনেক বছর আগের ঘটনা বলে তাঁদের নিপীড়িত হওয়ার স্মৃতিকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না বলে মনে করেন কলম্যান।
সুস্থভাবে সন্তান লালনপালনের মানদণ্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। আজ যা মানসিকভাবে নির্যাতনমূলক বা অবহেলার মতো মনে হয়, তা অতীতে তেমন কোনো বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আজকাল মা-বাবারা সন্তানদের মানসিক অসুস্থতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন এবং এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সন্তানদের সাহায্য করার চেষ্টা করেন। ৪০ বছর আগে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা এতটা বেশি ছিল না।
মা-বাবার প্রতি সন্তানের দায় কতটা
মা-বাবার সঙ্গে আজীবন সম্পর্ক বজায় রাখতে সন্তানেরা কি দায়বদ্ধ? এমন প্রশ্নের জবাব দিতে দ্বিধায় পড়ে যান বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের দার্শনিক ক্রিস্টোফার কাউলি।
কাউলি বলেন, ‘এক অর্থে, আমি আমার মা-বাবার কাছে সবকিছুর জন্য ঋণী। সেটা আক্ষরিক, দার্শনিক বা অস্তিত্বমূলক, যে অর্থেই বিবেচনা করা হোক। তবে স্পষ্টতই, যদি আমি মা-বাবার ভয়াবহ নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বড় হই, তবে ধরেই নেওয়া যায় যে আমার আর কোনো অতিরিক্ত দায়িত্ব নেই।’
কাউলি মনে করেন যে মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে একটি আদর্শ সম্পর্ক।
কাউলি বলেন, শিশু বয়সে সম্পর্কের ক্ষমতা ও দায়িত্ব পুরোপুরি মা-বাবার ওপর থাকে। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই হিসাব পাল্টে যায়। কিশোর বয়সে সন্তানেরা প্রায়ই মা-বাবার দোষারোপ ও সমালোচনা করে। এটা প্রাকৃতিক কারণেই হয়। এভাবে মা-বাবার বলয় থেকে সন্তান আলাদা ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।
কিন্তু সন্তান পূর্ণবয়স্ক হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সব সমস্যার দায় মা-বাবার ওপর চাপানো উচিত নয়। কারণ, একসময় আমাদের মা-বাবারা অনেক বয়স্ক ও দুর্বল হয়ে পড়েন। তখন তাঁদের প্রতি আমাদের একটু বেশি ধৈর্য ও করুণা প্রদর্শন করতে হতে পারে।
এ ছাড়া আমরা যখন নিজেদের ব্যর্থতার হিসাব করতে বসি, সব সময় এর সব দায় নিজেদের ওপর চাপাই না। কখনো কখনো বাইরের কোনো কারণকেও আমরা আমাদের ব্যর্থতার জন্য দায়ী করি।
একইভাবে মা-বাবার অবস্থান যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে তাঁদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন ছিল, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। ভেবে দেখতে হবে যে শিক্ষার অভাব, মানসিক অসুস্থতা, অতীতের আতঙ্ক অথবা গরিব হওয়ার কারণে তাঁরা ভালো মা-বাবা হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন কি না!
এ প্রসঙ্গে পিলেমার বলেন, তিনি একবার এক মা ও তাঁর থেকে প্রায় ২৫ বছর বিচ্ছিন্ন থাকা ছেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।
ওই মা বলেছিলেন, গত শতাব্দীর ষাটের দশকে তাঁর স্বামী তাঁকে পরিত্যাগ করেন। সে সময় নারীদের জন্য সুযোগ খুব কম ছিল। তাই তিনি আবার বিয়ে করেন। তাঁর নতুন স্বামী মানুষ হিসেবে খুব একটা ভালো না হলেও নির্যাতনকারী ছিলেন না। বিয়ে করার কারণে ছেলে তাঁর ওপর বিরক্ত হন।
কিন্তু ওই নারীর মনে হয়েছিল যে নিজের পরিবারের সুরক্ষা প্রয়োজন। সে জন্য তাঁর নতুন করে বিয়ে করা প্রয়োজন। ছেলেও শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন।
পিলেমার মনে করেন, মা-বাবা কী কারণে এমন আচরণ করছেন, সেটা বোঝার চেষ্টা আমাদের মনকে হয়তো শান্ত করতে পারবে। এতে আমরা হয়তো বুঝতে পারব যে সবকিছুই খারাপ বা ইচ্ছাকৃত ছিল না। তাহলে কিছুটা হলেও কষ্টের উপশম হতে পারে।
তবে এমন নয় যে আমাদের অবশ্যই তাঁদের ক্ষমা করতে হবে বা তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই হবে। কিন্তু স্পষ্টভাবে সবকিছু বুঝে নিলে, আমরা অতীতের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ও অন্ধকার স্মৃতির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।
এভাবে ভাবতে পারলে ভবিষ্যতে আমরাও যদি মা-বাবা হই, তাহলে সেই চাপের কিছুটা হয়তো আমাদের কাঁধ থেকে নেমে যাবে।
মা-বাবার আচরণ নিয়ে বিচার-বিবেচনা করার আগে বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের শিখিয়ে দেওয়া একটি কৌশল আমরা অবলম্বন করতে পারি। কান্টে বলেছেন, অন্যদের কাছ থেকে যে ধরনের আচরণ আশা করেন, অন্যদের সঙ্গে সেই আচরণই করুন।
পিলেমার বলেন, নিজেকে ভবিষ্যৎ মা-বাবা হিসেবে কল্পনা করুন। হঠাৎ যদি আপনার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান আপনার দিকে ঘুরে তাঁদের বর্তমান জীবনের মানদণ্ডে আপনাকে বলে বসে যে আপনি ভালো মা বা বাবা ছিলেন না, তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে।
পিলেমার মনে করেন, আমাদের মা-বাবা যে ভুল করেছেন, আমরা কখনো সেই ভুল করব না, এটা বলা সহজ। কিন্তু বাস্তবে আমরা ঠিকই অন্য অনেক ভুল করব।
একা বাঁচা কি সহজ ও সুখের হয়
মা-বাবার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা কি সন্তানকে সত্যিই সুখী করতে পারে? বিচ্ছিন্নতার ক্ষেত্রে এটা হয়ে উঠতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কলম্যান বলেন, অনেকের ক্ষেত্রে পারে। নানা জরিপে দেখা গেছে যে মা-বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সন্তানেরা অধিক সুখী থাকেন এবং কম চাপ অনুভব করেন। লজ্জা বা অপরাধবোধ হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের মনে হয় যে তাঁরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও মা-বাবার বেলায় ঠিক উল্টো অনুভূতি হতে পারে। তাঁদের হৃদয় ভেঙে যেতে পারে এবং তাঁরা দুঃখী ও বিভ্রান্ত হতে পারেন।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মা-বাবার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার ফলে সন্তানদের জীবনে নিজস্ব কিছু সংকটের সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে ব্লেক বলেন, বিচ্ছিন্নতা একাকিত্বময় হতে পারে। বিশেষ করে উৎসব ও ছুটির দিনগুলোয়, যখন মানুষ সাধারণত পরিবারের সঙ্গে সময় কাটায়।
পিলেমারের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় এক–চতুর্থাংশ মানুষই বিচ্ছিন্নতার আগে এটা নিয়ে খুব একটা ভাবেননি। শুরুতে শুরুতে তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্ত নিয়ে সুখী হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু পরে তাঁরা স্বীকার করেন যে তাঁরা অসুখী এবং সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। কেউ কেউ তাঁদের সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপও করেন।
কাউলি বলেন, মা-বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর কারও কারও মনে হয়, যে ডালে তাঁরা বসে আছেন, সেই ডালই কাটছেন।
তাই কাউলি, পিলেমার ও কলম্যান তিনজনই পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেছেন, যদি আপনি মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়টি সত্যিই বুঝে উঠতে না পারেন, তাহলে আপনার উচিত কিছুদিনের জন্য মা-বাবার কাছ থেকে দূরে থাকা।
কলম্যান বলেন, ‘আমি প্রতিদিন এমন কিছু হৃদয়ভাঙা মা-বাবার সঙ্গে কাজ করি, যাঁরা বছরের পর বছর বিচ্ছিন্ন থেকেছেন এবং আত্মহত্যা করবেন বলে চিন্তা করছেন। তাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের বলেছেন, তাঁরা যেন বছরে একবার হলেও নিজেদের মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কখনো কখনো মা-বাবাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ওইটুকু সময়ই যথেষ্ট।’
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে ৮ হাজার ৫০০ জন জরিপে অংশ নিয়েছিলেন এবং অন্তত ১০ বছর বিচ্ছিন্ন ছিলেন, তাঁদের ৬৬ শতাংশ যাঁরা মায়ের সঙ্গে এবং ৪৪ শতাংশ যাঁরা বাবার সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিলেন, তাঁরা সম্পর্কে পুনর্মিলন ঘটিয়েছেন।
সারাহও একই কাজ করেছেন। তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে এখন অল্পস্বল্প যোগাযোগ রাখছেন।
সারাহ বলেন, ‘মায়ের বয়স হয়েছে এবং বেশ কঠিন জীবন পার করছেন, কিছু মানসিক অসুস্থতাও দেখা দিয়েছে। তাঁর জন্য আমার এখন একটু দুঃখই হয়।’
মা-বাবা সন্তানদের একটি নিখুঁত শৈশব দিতে বাধ্য নন। আবার সন্তানদেরও মা-বাবার প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকার দায় নেই। তবে সম্ভবত, একে অপরের প্রতি যা অবশ্যই থাকা উচিত তা হলো, সহানুভূতি দেখানো, আত্মপর্যালোচনা করা এবং পরস্পরের কথা শোনার ইচ্ছা।