প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু (বায়ে)
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু (বায়ে)

পুতিনের রাজনৈতিক উত্তরসূরি কে?

আগামী ৭ অক্টোবর ৬৯ বছর পূর্ণ করবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০০০ সালে দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তিনি। এরপর চার মেয়াদে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু গত বছর গণভোটের মধ্য দিয়ে সংবিধান সংশোধন করে ২০২৪ ও ২০৩০ সালে দুই মেয়াদে আরও ছয় বছর করে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে নেন তিনি। তবে পুতিন এখনো ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেননি। অনেকেই তাঁর উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা করছেন।

ক্রেমলিনপন্থী বিশ্লেষকেরা পুতিনের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমান মন্ত্রিসভা থেকে কারও নাম প্রকাশ করতেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। মস্কোর একটি থিঙ্কট্যাংক সেন্টার অব পলিটিক্যাল ইনফরমেশনের প্রধান আলেক্সেই মুখিন বলেন, ‘আমি গোপন নথিতে এই বিষয়ে অনেকবার লিখেছি। কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের নাম উচ্চারণ করিনি, কারণ এতে মানুষ প্রভাবিত হতে পারে।’

আলেক্সেই বলেন, পুতিনের অবসর বা মৃত্যুর পর ক্রেমলিনে তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তাঁর মতে, এটি পুতিনের বিষয় না। এটি হলো জনগণের স্বার্থে তালিকাটি একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত গোপন রাখা।

প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করায় ২০১৯ সালে রাশিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন পুতিনবিরোধী অ্যাকটিভিস্ট সের্গেই বিজুইকিন। তিনি বলেন, পুতিন খুবই সন্দেহপ্রবণ ও চাপা স্বভাবের। এমনকি তিনি যদি কাউকে উত্তরসূরি হিসেবে মনে মনে চূড়ান্ত করেও থাকেন, উপযুক্ত সময়ের আগে তা প্রকাশ করবেন না। তিনি আরও বলেন, ‘অবশ্য বেঁচে থাকতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি পুতিন ভাবছেন না বলেই আমার ধারণা। কারণ, স্বৈরশাসকেরা ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা নিয়ে ভাবেন না।’

বিরোধীদের দমন

পুতিনের শাসনের অধীনে তাঁর সব ক্যারিশম্যাটিক সমালোচক যাঁরা জনমনে ইতিবাচক ছাপ ফেলতে পারেন, তাঁদের আগাছা নিড়ানোর মতো করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্যই পুতিনবিরোধী সাবেক দাবা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে ২০১৩ সালে দেশ ছাড়তে হয়েছিল।

নিষিদ্ধ ন্যাশনাল বলশেভিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা নানা কারণে সমালোচিত ঔপন্যাসিক এডওয়ার্ড লিমনভ ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর ক্রেমলিনের অনুগত হিসেবে বিবেচিত হন।

পুতিনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মিখাইল কাসানভ উদার গণতান্ত্রিক বরিস নেমতসভের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালে বরিসকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে হত্যা করা হলে মিখাইল রাজনীতিকে বিদায় জানান।

ইরিনা হাকামাদা তিনবারের পার্লামেন্ট সদস্য, তিনি ২০০৪ সালে পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন। তিনি এখন মানুষকে উজ্জীবিত করার এক বক্তা ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।

এ ছাড়া এখন ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদেরই উত্তরসূরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাঁদের গুরুত্বহীন জায়গায় নিচের পদে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ দিমিত্রি মেদভেদেভ।

২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের দ্বিতীয় মেয়াদ যখন শেষ হলো, তখন তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের অধীন দিমিত্রি মেদভেদেভকে সাময়িক উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেন।

অবশ্য বেঁচে থাকতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি পুতিন ভাবছেন না বলেই আমার ধারণা। কারণ, স্বৈরশাসকেরা ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা নিয়ে ভাবেন না।
পুতিনবিরোধী অ্যাকটিভিস্ট সের্গেই বিজুইকিন

মেদভেদেভ এ সময় খুব সতর্কতার সঙ্গে সংস্কারকাজ করতেন। কারণ, তখন প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন পুতিন। মূল কলকাঠি নাড়তেন পুতিন। ২০১২ সালে তৃতীয় দফায় পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত এভাবেই চলে। গত বছর মেদভেদেভকে সিকিউরিটি কাউন্সিলের উপপ্রধান পদে নিযুক্ত করেন পুতিন। এর মধ্য দিয়ে তাঁকে ঠেলে দেওয়া হয় লোকচক্ষুর আড়ালে।

এ ছাড়া রাশিয়ার পার্লামেন্ট দুমাতে থাকা তিন দলের জোট ‘নিয়মের বিরোধী দলের’ নেতারাও নামেই আছেন বলে সমালোচকেরা মনে করেন। তাঁদের বেশির ভাগই প্রবীণ। রাজনৈতিকভাবে তাঁদের দন্তবিহীন বলেই মনে করা হয়।

কমিউনিস্ট জেনেনিদ জুগানভ ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিয়েছেন। এখন ৭৭ বছরের এই ব্যক্তির গণমানুষের ওপর কোনো প্রভাবই নেই।
৭৫ বছর বয়সী ভ্লাদমির জিরিনভস্কির অতি জাতীয়তাবাদী ধরনের উদ্ভট কথাবার্তার কারণে তাঁকে অনেকটাই মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মনে করা হয়। তিনি এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ভাঁড়ের মতো। তিনি প্রায়ই ডানপন্থীদের প্রলুব্ধ করে কাছে টানার চেষ্টা করেন এবং পশ্চিমাদের হুমকি দেন।

আর সবচেয়ে ছোট ‘নিয়মতান্ত্রিক বিরোধী’ দল আ জাস্ট রাশিয়ার নেতা সার্গে মিরোনভ। ৬৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ে প্রতিবারই সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন।

উত্তরসূরি হতে পারেন সের্গেই শোইগু

পুতিনের পর সের্গেই শোইগুকে দ্বিতীয় জনপ্রিয় ব্যক্তি বলে মনে করা হয়

এরপরও কয়েকজন পর্যবেক্ষক পুতিনের সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে বিবেচনা করছেন। তিনি রুশ মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। পুতিনের পর তাঁকেই দ্বিতীয় জনপ্রিয় ব্যক্তি বলে মনে করা হয়।

শোইগুর নামের প্রথম অংশটি রুশ হলেও তিনি তুর্কি ভাষাভাষী দরিদ্র প্রদেশ তুবার একজন বৌদ্ধ। এই প্রদেশটি চীন সীমান্তের সঙ্গে। রাশিয়ার মধ্যে এ অঞ্চলটিতে খুন ও আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ।

তুবার অনেক বুদ্ধিজীবী তাঁকে মঙ্গোলীয় জেনারেল সুবেদেইর নতুন আবির্ভাব বলে মনে করে থাকেন। আট শতাব্দী আগে সুবেদেইর সেনাবাহিনী বর্তমান রাশিয়া ও ইউক্রেনের কাছে ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছিল।

১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে শোইগু জরুরি পরিস্থিতিবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। মন্ত্রণালয়টিকে কার্যকর, সামরিক কাঠামোতে রূপ দেন। পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি সব রাজনৈতিক তালিকায় শীর্ষে ছিলেন।

২০১২ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত শোইগুকে উদার গণতন্ত্রপন্থী হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু তাঁর হাত ধরেই ক্রেমলিনের সব সাফল্য। ক্রিমিয়া দখল ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার সাফল্য তাঁর হাত ধরেই আসে।

৬৬ বছরের শোইগুকে প্রায়ই পুতিনের সঙ্গে মাছ ধরতে ও শিকারে যেতে দেখা যায়। এটিকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রতীকী কর্মকাণ্ড হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

জার্মানির ব্রেমেন ইউনিভার্সিটির গবেষক নিকোলাই মিত্রোখিন বলেন, এখনকার জন্য অন্য যে কারও তুলনায় শোইগুরের সম্ভাবনা অনেকে বেশি।

আল–জাজিরা অবলম্বনে লিপি রানী সাহা