ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর প্রায় এক মাস পর খবর পাওয়া গেল, প্রতাপ বাসনেত নামের এক নেপালি তরুণ ইউক্রেনের পক্ষে যুদ্ধ করছেন। বিষয়টি নেপালে জানাজানি হলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নেপাল সব সময় ‘কারও প্রতি পক্ষপাত নয়’—এমন নীতি অনুসরণ করে থাকে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইউক্রেনের মাটিতে রুশ বাহিনীর হামলার নিন্দাও জানিয়েছে।
সম্প্রতি তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, নেপালের তরুণেরা রুশ বাহিনীতেও যোগ দিচ্ছেন। গত ১৬ মে রুশ সরকার সে দেশে বিদেশিদের নাগরিকত্ব লাভের প্রক্রিয়া সহজ করেছে। কোনো বিদেশি রুশ বাহিনীতে এক বছর কাজ করলে তিনি রাশিয়ার নাগরিকত্ব পাবেন। তখন থেকে শত শত নেপালি তরুণ রুশ বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন, দিচ্ছেন। নেপালের সাবেক সেনাসদস্যরাও এই দলে রয়েছেন।
নেপালের সাবেক এক সেনাসদস্য বলেন, তিনি দুবাইয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে কাজ করছিলেন। সেখানে রাশিয়ার আকর্ষণীয় ঘোষণার কথা জানতে পেরে তিনি পর্যটক হিসেবে মস্কো যান। সেখানে তিনি রুশ নিয়োগ কেন্দ্রে গিয়ে সে দেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি দেখলেন, সেখানে সেনাবাহিনীতে যোগদান তাঁর জন্য খুব কঠিন কিছু ছিল না।
সাবেক ওই নেপালি সেনাসদস্য বলেন, ‘আগে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য রুশ ভাষায় দক্ষতা আছে কি না, দেখা হতো। এখন ইংরেজি জানলেও চলে।’
নেপালি ওই সাবেক সেনা এই প্রতিবেদককে টেলিগ্রামে এসব তথ্য জানিয়েছিলেন। পরে তিনি প্রতিবেদককে টেলিগ্রামে ব্লক করে দেন। মনে হচ্ছিল, তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে চাইছিলেন না।
নেপালের সাবেক এই সেনাসদস্য এখন রাশিয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি নেপালের সেনাবাহিনীতেও একই রকম প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সুতরাং এখানকার প্রশিক্ষণ আমার জন্য তেমন কঠিন নয়।’ তবে তিনি বলছিলেন, এখানকার অস্ত্রশস্ত্র নেপালের সেনাবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে কী পরিমাণ নেপালি তরুণ যোগ দিয়েছেন, তার কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে এটা এখন মোটামুটি জানা যে নেপালি তরুণেরা এখন ‘প্রাইভেট সিটিজেন’ হিসেবে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হচ্ছেন।
নেপালি তরুণদের আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে পাঠানোর দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। ১৮১৫ সাল থেকে নেপালের তরুণেরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ‘ব্রিটিশ গোর্খা’ হিসেবে কাজ করছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর ‘ইন্ডিয়ান গোর্খা’ হিসেবে একইভাবে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর পুলিশেও ১৯৪৯ সাল থেকে নেপাল গোর্খা কন্টিনজেন্ট কাজ করছে। ব্রিটিশদের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের পুলিশে যোগ দেন নেপালিরা।
অবশ্য বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে নেপালি তরুণদের পাঠানোর জন্য কোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নেই। তবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সৈন্য রয়েছে নেপালের। জাতিসংঘ মিশনের বাইরে দেশটি কোথাও সেনাসদস্য পাঠায় না।
নেপালের সাবেক সেনাপ্রধান পূর্ণচন্দ্র থাপা জাতিসংঘ মিশনের বাইরে কোথাও সৈন্য পাঠানোর ধারণা নাকচ করে দিয়ে বলেন, নেপালের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে এটা যায় না।
নেপাল নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিলেও নেপালের তরুণেরা কেবল আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বিদেশি সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন না, বরং তাঁরা ‘প্রাইভেট সিটিজেন’ হিসেবে বিদেশি বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। যেমন নেপালের হাজার হাজার তরুণ ফরেন লিঁও অব দ্য ফ্রেঞ্জ আর্মিতে কাজ করছেন। এসব তরুণকে এই বাহিনীতে পাঠাতে নেপাল ও ফ্রান্সের মধ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি নেই।
মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক অভিবাসী উৎসের ক্ষেত্রেও নেপাল মোটামুটি ওপরের দিকে রয়েছে। নাগরিকত্ব লাভের বিনিময়ে অভিবাসীদের মার্কিন বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও অভিবাসন সার্ভিসের (ইউএসসিআইএস) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে অভিবাসী উৎসের দিক থেকে নেপালের অবস্থান সপ্তম। শীর্ষ ছয়ে রয়েছে ফিলিপাইন, মেক্সিকো, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জ্যামাইকা ও নাইজেরিয়া।
এসব উদাহরণের দিকে তাকালে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে নেপালের তরুণদের যোগ দেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়; বরং বিদেশি বাহিনীতে তালিকাভুক্তির দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে তাঁদের। এর পেছনে তিনটি শক্তিশালী কারণ রয়েছে বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন।
প্রথমত, নেপালিদের লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তাদের রক্তে মিশে আছে সামরিক শৌর্যবীর্যের গৌরব। সামরিক বাহিনী কয়েক ডজন রাজ্য জয়ের পর আধুনিক নেপাল গঠিত হয়েছে। এ ছাড়া তাদের রয়েছে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। নেপালিরা ১৭৯১ সালে তিব্বত ও চীনা বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ করেছিল।
১৮১৫ সাল থেকে ব্রিটিশদের হয়ে নেপালি তরুণেরা অসংখ্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ভারতের স্বাধীনতার পর সে দেশের জন্যও একইভাবে লড়াই করছেন নেপালিরা। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে লড়াইয়ের জন্য বিদেশি বাহিনীতে তরুণদের পাঠানোর দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে নেপালের। বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের পাঠানোর ক্ষেত্রে তাদের এই ঐতিহ্য সবকিছু সহজ করে দিয়েছে।
আবার এসব তরুণ বিকল্প কোনো কিছু পেতেও বেশ বেপরোয়া। কারণ, নেপালে সে দেশের তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধা নেই। বেকারত্ব, নিম্ন মজুরি এবং নেপালের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ কম হওয়ায় তাঁরা বিদেশি বাহিনীতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
সার্বিক অবস্থা বিচারে মনে হচ্ছে, মর্যাদা ও ভালো সুযোগ-সুবিধা পেলে নেপালের তরুণেরা আদর্শের দিক বিবেচনা না করেই বিশ্বের যেকোনো সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে তাঁদের কোনো আপত্তি নেই। এ কারণেই আমরা দেখছি, নেপালের তরুণের রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন।