উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নোবেল ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে গত বুধবার একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেছেন। ভেনেজুয়েলার বিরোধী নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি সুইডেনে এই অভিযোগ করেন।
অ্যাসাঞ্জ বলেন, মাচাদোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া সুইডিশ আইনের আওতায় তহবিলের ‘গুরুতর অপব্যবহার’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধে সহায়তা’ করার শামিল। তাই পুরস্কারের অর্থ হিসেবে ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা (প্রায় ১১ লাখ ৮০ হাজার ডলার) মাচাদোর কাছে হস্তান্তর ঠেকাতে তিনি আইনি ব্যবস্থা নিতে চান।
নোবেল কমিটি গত অক্টোবরে মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয়। নোবেল কমিটির ভাষ্যমতে, গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত এবং স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের লক্ষ্যে সংগ্রামের জন্য তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়।
অ্যাসাঞ্জের করা ফৌজদারি অভিযোগে নোবেল ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যুক্ত ৩০ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সংস্থাটির শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, তাঁরা তহবিলের অপব্যবহার, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সহায়তা এবং আগ্রাসনমূলক অপরাধের অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত।
অভিযোগে অ্যাসাঞ্জ আরও বলেন, মাচাদোকে পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে ‘শান্তির একটি উপকরণ’–কে ‘যুদ্ধের উপকরণে’ রূপান্তর করা হয়েছে।
মারিয়া কোরিনা মাচাদোর বিরুদ্ধে অ্যাসাঞ্জের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে সামরিক চাপ প্রয়োগ করছে। এমন প্রেক্ষাপটে মাচাদো যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ করতে উসকানি ও সমর্থন’ দিয়েছেন।
মাচাদোকে নোবেল দেওয়া নিয়ে বিতর্ক
মারিয়া কোরিনা মাচাদোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া নিয়ে শুরু থেকে বিতর্ক রয়েছে। গাজায় চলমান ইসরায়েলের গণহত্যাকে তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
অক্টোবরে মাচাদোর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘোষণা আসার পরপরই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর একটি ফোনালাপও হয়েছিল। ক্ষমতায় এলে ইসরায়েলে অবস্থিত ভেনেজুয়েলার দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের অঙ্গীকার করেছেন মাচাদো।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কয়েক মাস ধরে ভেনেজুয়েলার নৌযানে হামলা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এসব নৌযান মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তা প্রমাণ করা যায়নি। মাচাদো যুক্তরাষ্ট্রের এসব হামলাকে সমর্থন দিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের চরম ডানপন্থীদের সঙ্গে তিনি নিজেকে এক কাতারে রেখেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দাবি, মাদুরোর সঙ্গে অপরাধী মাদক চক্রের যোগসূত্র রয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। কিন্তু ওয়াশিংটনের গোয়েন্দা মহলের ভেতরই এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকিও দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবীয় সাগর এবং লাতিন আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে তথাকথিত মাদক পাচারকারী নৌযান লক্ষ্য করে ২০টির বেশি সামরিক হামলার নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। এসব হামলায় এখন পর্যন্ত ১০৪ জন নিহত হয়েছেন।
তা ছাড়া লাতিন আমেরিকায় বিপুল সংখ্যার নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্য এবং সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে উৎখাত করতে দেশটিতে আগ্রাসন চালাতে পারে—এমন আশঙ্কাও ক্রমেই বাড়ছে।
অ্যাসাঞ্জের দাবি, ট্রাম্পের সামরিক অভিযানকে সমর্থন দিয়ে মাচাদোর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ‘সম্পূর্ণ অযোগ্য’ হয়ে পড়েছেন। তাঁর মতে, এটি সুইডিশ উদ্ভাবক ও শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেলের উইলে নির্ধারিত নোবেল পুরস্কারের মানদণ্ডের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অ্যাসাঞ্জ ২০০৬ সালে উইকিলিকস নামের তথ্য ফাঁসকারী একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১০ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিংয়ের অনেক তথ্য ধারাবাহিকভাবে ফাঁস করে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন।
সুইডেনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এড়াতে ২০১২ সালে ইকুয়েডরের লন্ডন দূতাবাসে আশ্রয় নেন অ্যাসাঞ্জ। সেখানে তিনি সাত বছর অবস্থান করেন। সুইডেনে তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল, যা পরে প্রত্যাহার করা হয়।
এরপর অ্যাসাঞ্জ ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের বেলমার্শ কারাগারে বন্দী ছিলেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায়। তাঁর বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের অভিযোগ, তিনি মার্কিন সামরিক তথ্যভান্ডার হ্যাক করার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন এবং সংবেদনশীল গোপন তথ্য হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের সঙ্গে করা একটি দোষ স্বীকার চুক্তির অংশ হিসেবে ২০২৪ সালে অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে মুক্তি পান। তিনি গুপ্তচরবৃত্তি আইন লঙ্ঘনের একটি অপারাধের দোষ স্বীকার করেছিলেন। মুক্তির পর তিনি নিজের জন্মভূমি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যান।