‘জলবায়ু বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত জর্জর’ এই সময়ে বিশ্বকে উন্নয়নের গতি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। আজ সোমবার স্পেনের সেভিয়ায় শুরু হওয়া চতুর্থ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিল সম্মেলনে (এফএফডি৪) তিনি এ আহ্বান জানান। জাতিসংঘের চার দিনব্যাপী এ সম্মেলনে বিশ্বের অনেক নেতা ও চার হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন।
তবে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ সম্মেলনে অংশ নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে বৈশ্বিক সহযোগিতায় যে ভাঙন শুরু হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি তা আরও স্পষ্ট করে।
গুতেরেস উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, এসডিজির দুই-তৃতীয়াংশই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে আছে। এ লক্ষ্য পূরণে প্রতিবছর ৪ লাখ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ দরকার।
গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির বাজেট ব্যাপকভাবে কাটছাঁট করেছেন। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ালেও জার্মানি, ব্রিটেন ও ফ্রান্সও উন্নয়ন সহায়তা কমাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের মতে, ১৯৬০ সালের পর এবারই উন্নয়ন সহায়তা সবচেয়ে বড় সংকোচনের মুখে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে ৮০ কোটির বেশি মানুষকে দৈনিক ৩ ডলারের কম আয়ে জীবন ধারণ করতে হয়। বিশেষত, সাব-সাহারা আফ্রিকায় চরম দারিদ্র্য বাড়ছে।
বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের আমলে আরোপিত শুল্কনীতি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন যুদ্ধ—সব মিলিয়ে দরিদ্র দেশগুলোর সহায়তা পাওয়ার পথ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। গুতেরেস বলেন, এসব সংকটের কারণে লাখ লাখ শিশু টিকাদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, স্কুল ছাড়ছে কন্যাশিশুরা, ক্ষুধার্ত থাকছে বহু পরিবার।
জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘অসমতা, জলবায়ু বিশৃঙ্খলা আর সংঘাতে টালমাটাল বিশ্বে আমাদের উন্নয়নের ইঞ্জিন ঠিক করতে হবে, চালু রাখতে হবে।’
সেভিয়াতে এমন এক সময়ে এফএফডি৪ শুরু হচ্ছে, যখন দক্ষিণ ইউরোপ চরম তাপপ্রবাহে পুড়ছে। বিজ্ঞানীদের মতে, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপপ্রবাহের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনা বেড়েছে।
ঋণ বেড়ে তিন গুণ
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী উন্নয়নশীল বিশ্ব বা গ্লোবাল সাউথের সুপরিচিত নেতাদের মধ্যে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো, সেনেগালের বাসিরু দিয়োমায় ফায়ে, ইকুয়েডরের দানিয়েল নোবোয়া, অ্যাঙ্গোলার জোয়াও লরেন্সো এবং সুদানের সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান অন্যতম।
প্রথম দিন আলোচনার মূল বিষয় ছিল: কীভাবে গরিব দেশগুলোকে বহির্বিশ্বের ঋণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় অগ্রগতির সুযোগ করে দেওয়া যায়।
জাতিসংঘের হিসাব বলছে, বিগত ১৫ বছরে সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর বৈদেশিক ঋণ তিন গুণ বেড়েছে।
অনেকেই মনে করেন, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ আর্থিক ব্যবস্থায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব সঠিকভাবে প্রতিফলিত করতেই এ সংস্কার দরকার।
নিউইয়র্কে দীর্ঘ আলোচনা শেষে একটি ঘোষণা গৃহীত হয়, যা সেভিয়ায় উপস্থাপন করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি জানিয়ে ওই আলোচনাই বর্জন করে।
জুন মাসে নিউইয়র্কে দীর্ঘ ও জটিল আলোচনা শেষে একটি যৌথ ঘোষণা তৈরি করা হয়, যা সেভিয়ায় গৃহীত হওয়ার কথা। নিউইয়র্কে এ যৌথ ঘোষণা তৈরি করার সময়ে আলোচনার মাঝপথে যুক্তরাষ্ট্র বের হয়ে যাওয়ার পরই তা গৃহীত হয়েছিল।
এ ঘোষণায় দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূরীকরণ, লিঙ্গ সমতা, করব্যবস্থার সংস্কার, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নসহ বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে উন্নয়ন ব্যাংকগুলোকে ঋণক্ষমতা তিন গুণ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। সামাজিক খাতে নিশ্চিত অর্থায়ন এবং কর ফাঁকির বিরুদ্ধে আরও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর ঋণদানের ক্ষমতা তিন গুণ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সামাজিক খাতে যেন নিয়মিত অর্থ পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। আর কর ফাঁকির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
‘ঔপনিবেশিক ঋণের বেড়াজাল’
ঘোষণাটি বাধ্যতামূলক নয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেভিয়া প্রতিশ্রুতি’। কিছু দেশ এতে নিজেদের উদ্যোগও যুক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তবে অধিকারকর্মীরা এ ঘোষণাপত্রকে যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী নয় বলে সমালোচনা করেছেন এবং বৈশ্বিক বৈষম্য বাড়তে থাকার বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
সম্মেলনের আগের দিন গতকাল রোববার সেভিয়ার প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা আন্তর্জাতিক কর, ঋণ ও সহায়তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়েছেন।
২৮ বছর বয়সী বিক্ষোভকারী ইলান হেঞ্জলার এএফপিকে বলেন, ‘যদি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো নতুন ঔপনিবেশিক ঋণের বেড়াজালে আটকে থাকে, তবে তারা কীভাবে উন্নয়ন করতে চায়, তা কখনোই নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারবে না।’