হরদীপ হত্যা: ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে বোমা হামলা কেন আবার আলোচনায়

এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইট
 ছবি: এয়ার ইন্ডিয়ার ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে বোমা হামলা হয়েছিল। শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডার মধ্যকার সম্পর্ক তলানিতে যাওয়ার জেরে ৩৮ বছর আগের ঘটনাটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।

গত সপ্তাহে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর দেশের পার্লামেন্টে ভারতের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ তোলেন।

ট্রুডো বলেন, গত জুন মাসে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় কানাডীয় শিখ নেতা হরদীপকে হত্যায় ভারতের হাত থাকার বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ তাঁর দেশের কাছে আছে।

ভারত এই অভিযোগ অস্বীকার করে। ট্রুডোর অভিযোগকে ‘অযৌক্তিক’ হিসেবে অভিহিত করে নয়াদিল্লি।

ঘটনার জেরে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বহিষ্কারের ধারাবাহিকতায় অটোয়া-নয়াদিল্লির মধ্যকার সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের বেশ কয়েকজন ভাষ্যকার-বিশ্লেষক ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে বোমা হামলার প্রসঙ্গটি সামনে এনেছেন।

ঘটনাটি ‘কণিষ্ক বোমা হামলা’ নামেও পরিচিত। কারণ, বোমা হামলার শিকার এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৪৭ ফ্লাইটটির নাম কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের নামানুসারে রাখা হয়েছিল। ‘কণিষ্ক বোমা হামলার’ জেরেও নয়াদিল্লি-অটোয়া সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল।

কী ঘটেছিল

১৯৮৫ সালের ২৩ জুন এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজটি (ফ্লাইট ১৮২) কানাডা থেকে লন্ডন হয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য যাত্রা করেছিল। কিন্তু আইরিশ উপকূলের আকাশে ফ্লাইটটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ফ্লাইটের ৩২৯ আরোহী নিহত হন।

উড়োজাহাজটিতে রাখা স্যুটকেসবোমার বিস্ফোরণে ফ্লাইট ১৮২ উড়ে গিয়েছিল। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৬৮ জন ছিলেন কানাডার নাগরিক। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ফ্লাইটে ভারতীয় নাগরিক ছিলেন ২৪ জন। বিস্ফোরণের পর সমুদ্র থেকে ১৩১টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।

ফ্লাইটটি আকাশে থাকা অবস্থায় জাপানের টোকিওর নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দুই জাপানি লাগেজ হ্যান্ডলার নিহত হন।

তদন্তকারীরা পরে বলেন, নারিতা বিমানবন্দরে বিস্ফোরণের সঙ্গে ফ্লাইট ১৮২–তে বোমা হামলার যোগসূত্র ছিল। এ ক্ষেত্রে (নারিতা বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ) উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংককগামী এয়ার ইন্ডিয়ার অপর একটি ফ্লাইটে বোমা হামলা চালানো। কিন্তু বোমা আগেই বিস্ফোরিত হয়ে যায়।

ফ্লাইট ১৮২–তে বিস্ফোরণের পর সমুদ্র থেকে ১৩১টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল

হামলার পেছনে কারা

কানাডীয় তদন্তকারীরা অভিযোগ করেন, ফ্লাইট ১৮২–তে বোমা হামলার পরিকল্পনার পেছনে ছিলেন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। তাঁরা ভারতের পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো রক্তক্ষয়ী অভিযানের (১৯৮৪) প্রতিশোধ নিতেই এ কাজ করেছিলেন।

হামলার কয়েক মাস পর রয়্যাল কানাডীয় মাউন্টেড পুলিশ (আরসিএমপি) তালভিন্দর সিং পারমার ও ইন্দ্রজিৎ সিং রেয়াত নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। অস্ত্র, বিস্ফোরক ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

তালভিন্দর ‘বাব্বর খালসা’ নামের একটি চরমপন্থী শিখ গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন। কানাডা ও ভারত উভয় দেশে এখন এই গোষ্ঠি নিষিদ্ধ। ইন্দ্রজিৎ ছিলেন একজন বিদ্যুৎমিস্ত্রি (ইলেকট্রিশিয়ান)।

গত শতকের আশির দশকে তালভিন্দরকে কানাডা থেকে ভারতে প্রত্যর্পণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল নয়াদিল্লি। তাঁর বিরুদ্ধে কানাডায় হওয়া মামলাটি ছিল দুর্বল। পরে তিনি মুক্তি পেয়ে যান।

তালভিন্দর ১৯৯২ সালে ভারতে পুলিশের হাতে নিহত হন। তদন্তকারীরা এখন মনে করছেন, তিনি ছিলেন এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী।

২০০০ সালে কানাডার পুলিশ রিপুদমন সিং মালিক ও আজেইব সিং বাগরি নামের দুই ব্যক্তিকে গণহত্যা, ষড়যন্ত্রসহ একাধিক অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।

প্রায় দুই বছর ধরে বিচারের পর ২০০৫ সালে উভয় ব্যক্তিকে সব অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। বিচারক তাঁর রায়ে তথ্যগত ত্রুটি ও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন।

কানাডীয় আদালতের এই রায় ভুক্তভোগীদের হতাশ করে। রায়ের পর ভুক্তভোগীদের স্বজনেরা আদালতকক্ষে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।

বিশ্বে উড়োজাহাজে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার একটি ছিল ফ্লাইট ১৮২-এর ঘটনা। এ হামলার জন্য শুধু ইন্দ্রজিৎকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।

জাপানের বিমানবন্দরে বোমা হামলায় জড়িত থাকার দায়ে ১৯৯১ সালে ইন্দ্রজিৎকে যুক্তরাজ্যে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ফ্লাইট ১৮২-তে বোমা হামলার মামলায় ২০০৩ সালে কানাডার একটি আদালতে দোষ স্বীকার করেন ইন্দ্রজিৎ। কানাডায় তাঁকে আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

রিপুদমন ও আজেইবের বিরুদ্ধে মামলার বিচারে মিথ্যাচারের জন্যও ইন্দ্রজিৎকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এ জন্য তাঁকে অতিরিক্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো

তদন্ত নিয়ে সমালোচনা

হামলা প্রতিরোধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়াসহ তদন্তে বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কানাডার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

রিপুদমন ও আজেইবের খালাসের রায় নিয়ে ভুক্তভোগীদের পরিবারের ক্ষোভের জেরে ২০০৬ সালে কানাডার সরকার এই হামলার ঘটনা নিয়ে একটি পাবলিক তদন্তের উদ্যোগ নেয়।

দেশটির সুপ্রিম কোর্টের সাবেক এক বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এই তদন্ত কমিটি ২০১০ সালে এমন উপসংহারে পৌঁছায় যে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল সন্ত্রাসীরা।

তা ছাড়া এমন তথ্যও সামনে আসে যে হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে কানাডার সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের জঙ্গলে তালভিন্দর ও ইন্দ্রজিৎকে অনুসরণ করেছিলেন। সেখানে তাঁরা একটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছিলেন। তবে তাঁরা ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেননি।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দুই শিখ সাংবাদিক পৃথক ঘটনায় কানাডা ও যুক্তরাজ্যে খুন হন, যাঁরা এই হামলা মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হতে পারতেন।

কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে হরদীপ সিংয়ের স্মরণে টাঙানো হয়েছে ব্যানার

তারপর কী হলো

৯ বছরের সাজার দুই-তৃতীয়াংশ ভোগ করার পর ২০১৬ সালে ইন্দ্রজিৎকে কানাডার কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরের বছর তাঁকে পুনর্বাসনকেন্দ্র ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাঁকে যেখানে ইচ্ছা, সেখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। কিছু বিশেষজ্ঞ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন।

গত বছর ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় খুন হন রিপুদমন। এই হত্যাকাণ্ডকে পূর্বপরিকল্পিত হিসেবে বর্ণনা করে কানাডার পুলিশ। এ ঘটনায় তারা দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।

কানাডা ও ভারতের পতাকা

ভারতের প্রতিক্রিয়া

ফ্লাইট ১৮২-তে বোমা হামলার ঘটনা ভারতের জন্য একটি বেদনাদায়ক জাগ্রত স্মৃতির বিষয় হয়ে আছে। এই হামলায় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন কানাডীয় নাগরিক। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। ভারতে তাঁদের আত্মীয়স্বজন আছেন।

ঘটনাটি নিয়ে ভারতে এখনো যে মনোভাব বিদ্যমান, তা হলো—ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাননি।

অটোয়া-নয়াদিল্লির মধ্যকার চলমান বিরোধ ফ্লাইট ১৮২ ট্র্যাজেডিকে আবার ভারতে আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

ভারতের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে টুইট করেছেন। ওই বোমা হামলার ঘটনা নিয়ে কানাডার ভূমিকার সমালোচনা করেন তিনি।

বোমা হামলার আগে-পরে কানাডার কর্তৃপক্ষের ভুল পদক্ষেপের বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে বেশ কিছু প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে।

ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের ভারতীয় পরিবারের সদস্যরা বছরের পর বছর ধরে তাঁদের বেদনার কথা বলে এসেছেন। ভারত-কানাডা সম্পর্কে তীব্র টানাপোড়েনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাঁরা আবার নতুন করে পুরোনো বেদনার কথা বলছেন।