পরিচয় প্রকাশ না হওয়া এ ব্যক্তির অভিযোগ, তাঁকে শত শত কিশোরী ও তরুণীর লাশ সমাহিত করতে বাধ্য করা হয়েছিল
পরিচয় প্রকাশ না হওয়া এ ব্যক্তির অভিযোগ, তাঁকে শত শত কিশোরী ও তরুণীর লাশ সমাহিত করতে বাধ্য করা হয়েছিল

ভারতে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার শতাধিক নারীকে গোপনে সমাহিত করেছেন তিনি, দাবি কতটা সত্য

ভারতে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হওয়া কয়েক শ নারীকে গোপনে সমাহিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন ভারতের এক ব্যক্তি। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ধর্মস্থল শহরের একটি মন্দিরের সাবেক কর্মী পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, তাঁকে দিয়ে জোর করে এ কাজ করানো হয়েছে। গত শনিবার ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে সে দেশের পুলিশ।

সম্প্রতি ওই ব্যক্তির অভিযোগকে কেন্দ্র করে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যের ছোট শহর ও পুণ্যস্থান ধর্মস্থলে উত্তেজনা তৈরি হয়। এ শহরে রয়েছে মঞ্জুনাথ স্বামীর মন্দির, যা কয়েক শ বছরের পুরোনো। প্রতিদিন হাজারো হিন্দু তীর্থযাত্রী এখানে আসেন। মন্দিরটি স্থানীয় মানুষের কাছে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে বিবেচিত।

সম্প্রতি ওই ব্যক্তির অভিযোগ নিয়ে রাজ্যের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হলে সরকার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করে। আর গত শনিবার সকালে বিশেষ তদন্ত দলের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ওই ব্যক্তিকে ‘মিথ্যা জবানবন্দি দেওয়ার অভিযোগে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

রাজ্যের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক রাজনৈতিক উত্তেজনা শুরু হলে সরকার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিশেষ তদন্ত দল (এসআইটি) গঠন করে। আর গত শনিবার সকালে বিশেষ তদন্ত দলের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ওই ব্যক্তিকে ‘মিথ্যা জবানবন্দি দেওয়ার অভিযোগে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

ওই মধ্যবয়সী ব্যক্তি গত জুলাই মাসের শুরুতে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেও তাঁর জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত তাঁকে যতবার জনসমক্ষে দেখা গেছে, ততবারই তিনি কালো পোশাকে ছিলেন। তাঁর মাথা ঢাকা ছিল এবং মুখে ছিল মুখোশ।

পুলিশের কাছে করা অভিযোগে ওই ব্যক্তি বলেছেন, ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি মন্দিরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, তাঁকে কয়েক শ কিশোরী ও তরুণীর লাশ সমাহিত করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ওই সব নারী নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

ওই ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট পাঁচটি ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন এবং বলেছেন, এমন আরও অনেক ঘটনা রয়েছে। তাঁর অভিযোগ, ভুক্তভোগীদের মধ্যে কয়েকজন অপ্রাপ্তবয়স্কও ছিল।

ওই ব্যক্তি বলেছেন, তিনি ২০১৪ সাল থেকে আত্মগোপনে ছিলেন। এখন বিবেকের তাড়নায় ফিরে এসেছেন এবং সত্য প্রকাশ করছেন।

সাবেক ওই পরিচ্ছন্নতাকর্মী সরাসরি কারও নাম বলেননি। তিনি মন্দির প্রশাসন ও কর্মীদের দোষারোপ করেছেন। তবে মন্দিরের প্রধান এসব অভিযোগকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার পর ওই ব্যক্তি ব্যাগ থেকে একটি মানুষের খুলি বের করে প্রমাণ হিসেবে দেখান। তিনি দাবি করেন, তাঁর নিজ হাতে সমাহিত করা একটি মরদেহের খুলি এটি। সম্প্রতি তিনি সমাধি থেকে এটি তুলে এনেছেন।

তবে বিশেষ তদন্ত দলের কর্মকর্তারা বলেছেন, ওই ব্যক্তি যেসব জায়গায় মরদেহ সমাহিত করার কথা বলেছেন, সেগুলোর কোনোটি থেকেই এ খুলি আনা হয়নি।

এই অভিযোগ নিয়ে কিছুদিন ধরেই কর্ণাটক রাজ্যের ভেতরে ও বাইরে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোতেও এ খবরটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হচ্ছে। রাজ্যের নারী কমিশন এ ধরনের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বড় ধরনের ফৌজদারি তদন্ত শুরু করেছে এবং তদন্তের জন্য বিশেষ তদন্ত দল গঠন করেছে।

ওই ব্যক্তির দাবি যাচাই করার জন্য কয়েক সপ্তাহ ধরে তদন্ত দল ধর্মস্থল শহর ও আশপাশের এলাকায় খননকাজ চালিয়েছে। শুরুতে তিনি ১৩টি জায়গা চিহ্নিত করেছিলেন। এর মধ্যে কিছু জায়গায় পৌঁছানোটা কঠিন। কারণ, সেগুলো ঘন জঙ্গলে ঢেকে আছে এবং সেসব স্থানে বিষধর সাপও রয়েছে বলে জানা গেছে।

বিশেষ তদন্ত দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র বিবিসিকে বলেছে, দুটি জায়গায় মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে—এর মধ্যে একটি খুলি ও প্রায় ১০০ টুকরো হাড় রয়েছে। এগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। তবে এগুলো কার হাড়, তা এখনো জানা যায়নি।

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার পর ওই ব্যক্তি ব্যাগ থেকে একটি মানুষের খুলি বের করে প্রমাণ হিসেবে দেখান। তিনি দাবি করেন, তাঁর নিজ হাতে সমাহিত করা একটি লাশের খুলি এটি। সম্প্রতি তিনি সমাধি থেকে এটি তুলে এনেছেন।

এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী হেগড়ে পরিবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। এ পরিবারটি উত্তরাধিকারসূত্রে মন্দিরের প্রশাসক।

বিবিসিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মন্দিরের প্রধান প্রশাসক বীরেন্দ্র হেগড়ে এসআইটির তদন্তকে স্বাগত জানান। তিনি ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সদস্য এবং ২০১৫ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মবিভূষণ’ পান।

বিবৃতিতে বীরেন্দ্র লিখেছেন, ‘ধর্মস্থল ও আশপাশে যেসব অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্তের জন্য বিশেষ তদন্ত দলকে নিযুক্ত করায় আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

বীরেন্দ্র আরও বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা দিচ্ছি। আমরা আমাদের বিচারব্যবস্থা, তদন্ত সংস্থা এবং ভারতের সংবিধানের প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখি।’

ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বীরেন্দ্র সাবেক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দাবিকে ‘অসম্ভব’ বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘সত্য চিরতরে প্রকাশ হওয়া উচিত।’

এ অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনেও বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। রাজ্যের স্থানীয় পার্লামেন্টের সাম্প্রতিক অধিবেশনেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। রাজ্যের বিরোধীদলীয় বিজেপি সদস্যরা একে পুণ্যস্থানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা বলে অভিযোগ করেছেন।

রাজ্যের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের নেতা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি পরমেশ্বর বলেছেন, কারও দোষ আড়াল করা কিংবা কাউকে অযথা কলঙ্কিত করার কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই।

পরমেশ্বর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘সত্য প্রকাশ হওয়া উচিত নয় কি? যদি কিছু পাওয়া না যায়, তাহলে ধর্মস্থলের মর্যাদা আরও বাড়বে। আর যদি কিছু পাওয়া যায়, তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।’