
‘আজ (শনিবার) আমার বন্ধুদের মধ্যে একজন আমাকে মায়ের খোঁজে দেয়। তারা আমাকে একটি মরদেহের ছবি পাঠায়। দেখি, ওটাই আমার মা। যেই পোশাকের বর্ণনা আমি দিয়েছিলাম, সেই পোশাকই তাঁর গায়ে।’
কথাগুলো বলছিলেন সূর্যবীর। ভারতের ওডিশার বালাসোরের ট্রেন দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের একজন তিনি। দুদিন খোঁজাখুঁজির পর মায়ের লাশ পেয়েছেন তিনি।
শুক্রবারের এই দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত অন্তত ২৮৮ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন প্রায় ৭৫০ জন। কলকাতা থেকে চেন্নাইগামী করমন্ডল এক্সপ্রেস একটি পণ্যবাহী ট্রেনকে ধাক্কা দিলে এই দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয়। এরপর যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসও ওই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এতে দুই ট্রেনের ১৭টি বগি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন একটি ক্ষতিগ্রস্ত বগিতে ছিলেন সূর্যবীরের মা ও নানি।
সূর্যবীর বললেন, ‘আমার মা ও নানি ওই ট্রেনে ছিলেন। ওষুধ কেনার জন্য তাঁরা শহরে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর নানিকে খুঁজে পাই। তিনি বেঁচে আছেন। কিন্তু তখনো আমার মাকে খুঁজে পাইনি। আমি সেখানের সব জায়গায় মায়ের খোঁজ করেছি, কিন্তু কোথাও তাঁকে পাইনি।’
সূর্যবীর বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কী করতে হবে। তাই আমি আমার মায়ের ছবি আমার সব বন্ধু ও পরিচিতজনের কাছে পাঠিয়েছিলাম। আমি আমার মায়ের মুঠোফোন নম্বরও সবাইকে দিয়েছিলাম। একই সঙ্গে শেষবার তাঁকে যে পোশাকে দেখেছি, তার বর্ণনাও সবাইকে দিয়েছিলাম।’
সূর্যবীর বললেন, ‘আমার এখন একটাই চাওয়া, যেন আমি নিরাপদে আমার মায়ের মরদেহটি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে যেন তাঁর শেষকৃত্য করতে পারি। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি খুবই বিশৃঙ্খল। কোনো ট্রেন চলছে না। আর আশপাশে সড়কগুলোয় গাড়ি আটকা পড়ে আছে।’
‘হঠাৎ বিকট শব্দ হয় ও চারপাশে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন যে যেদিকে পারছিলেন ছুটছিলেন। আমি ঘটনাস্থলের পাশেই ছিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম, সেখানে যাওয়ার। আমরা সেখানে গিয়ে আটকা পড়া যাত্রীদের বের করে আনার চেষ্টা করতে শুরু করি। আমরা কয়েকজন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হই। একই সঙ্গে মরদেহ উদ্ধার করি।’
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলের এমন বর্ণনা দিলেন গিরিজা শঙ্কর। তিনি দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং উদ্ধারকারীদের একজন। বললেন, ‘চারপাশে আহত অসংখ্য মানুষ পড়ে আছেন। আমরা বুঝতে পারছিলাম না তাঁদের কীভাবে বের করে আনব। উদ্ধারকর্মীরা এলে অবশ্য কাজ কিছুটা সহজ হয়। সারা রাত চলে উদ্ধারকাজ। এখনো ঘোরের মধ্যেই রয়েছি।’
যেখানে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, তার অদূরেই টুটু বিশ্বাসদের বাড়ি। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ বিকট এক শব্দ শুনতে পাই আমরা। বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা দেখি, এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি দেখলাম, মালবাহী ট্রেনটির ওপর আরেকটি ট্রেন উঠে গেছে।’
টুটু বিশ্বাস বলেন, ‘এরপর আমি ঘটনাস্থলে গেলাম। গিয়ে দেখি, আহত হয়ে পড়ে আছেন অসংখ্য মানুষ। অনেকে মারা গেছেন। দেখি, একটা বাচ্চা কাঁদছিল। সম্ভব তার মা-বাবা মারা গেছেন। এর কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটিও মারা যায়।’
দুর্ঘটনা আহত ব্যক্তিদের বর্ণনা দিয়ে টুটু বিশ্বাস বলেন, ‘অনেকে একটু পানির জন্য আকুতি জানাচ্ছিলেন। যতজনকে সম্ভব, আমি পানি দিলাম। আমাদের গ্রামের লোকজনও ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছেন। তাঁরা নিজেদের সাধ্যমতো আহত ব্যক্তিদের সাহায্য করেছেন। এটা ছিল খুবই ভয়ংকর।’
দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের একটিতে ছিলেন মুকেশ পণ্ডিত। তিনি বললেন, ‘হঠাৎই ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এরপরই হয় হাড় হিম করার মতো একটি শব্দ। সেই শব্দ হওয়ার পরই ট্রেনটি উল্টে যায়। আমি কামরার ভেতর আটকা পড়ি। এর আধা ঘণ্টা পর স্থানীয় লোকজন আমাকে ট্রেন থেকে বের করে আনেন।’
মুকেশ পণ্ডিত বলেন, ‘দেখি, আমাদের সঙ্গে যা কিছু ছিল, সব বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমি কোনো কিছু খুঁজে পাইনি। আমি বাইরে বের হয়ে মাটিতে বসে পড়ি। আমার সঙ্গে আমার গ্রামের আরও চারজন ওই ট্রেনে ছিলেন। তাঁরা বেঁচে গেছেন। কিন্তু অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। আমি যেই কামরায় ছিলাম, সেখানকার অনেকে মারা গেছেন। আর যাঁরা খুব বেশি আহত হয়েছেন, তাঁদের আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
ঋত্বিক কুমার ও তাঁর ভাই ছিলেন দুর্ঘটনাকবলিত একটি ট্রেনে। ঋত্বিক বলেন, ‘আমার ভাই তাঁর বার্থে বসে ছিলেন। আর আমি ওই কামরার কাছে একটি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যখন ট্রেনটি উল্টে গেল, আমি কোনোমতে বের হই। ভেবেছিলাম, আমার ভাইও বুঝি বের হয়েছেন। কিন্তু তা হননি। আমার ভাই তাঁর আসনের নিচে আটকা পড়েন।’
ঋত্বিক কুমার বলেন, ‘বের হয়ে আসার পর আমি আবার উল্টে যাওয়া ট্রেনে যাই এবং আমার ভাইকে বের করে নিয়ে আসি। একই সঙ্গে আমি উল্টে যাওয়া ট্রেনে আটকা পড়া কমবয়সী একটি মেয়েকেও বের করে আনি। এরপরে আমি পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্স সেবাদানকারীদের ফোন করি। কিন্তু আধা ঘণ্টা পর তাঁরা ঘটনাস্থলে আসেন।’