জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) চেয়ারম্যান ইয়াসিন মালিক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে, ২৭ মে ২০১৫
জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) চেয়ারম্যান ইয়াসিন মালিক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে, ২৭ মে ২০১৫

হলফনামা

কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতা ইয়াসিন মালিক কি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট

প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের স্বাধীনতাপন্থী আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের অন্যতম হিসেবে পরিচিত ইয়াসিন মালিক।

১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে কাশ্মীরে যখন ভারত থেকে স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখন মালিক হয়ে ওঠেন সেই সংগ্রামের প্রতীক। তবে পরবর্তী সময়ে সহিংস পন্থা ছেড়ে অহিংস আন্দোলনের পথ বেছে নেন। বর্তমানে তিনি দিল্লির একটি কারাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন।

ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ও ক্ষমতাসীনদের কাছে ইয়াসিন মালিক অপরাধী হলেও পাকিস্তানও তাঁকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। বরাবরই নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে কাশ্মীরে সশস্ত্র আন্দোলন উসকে দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে।

কিন্তু গত আগস্টের শেষ দিকে দিল্লি হাইকোর্টে ৫৯ বছর বয়সী মালিকের দাখিল করা এক হলফনামা ভারতজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে। সেখানে এমন কিছু চাঞ্চল্যকর দাবি করা হয়েছে, যা ভারতের সাবেক কিছু কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকের মতে, অন্তত আংশিক সত্য হতে পারে।

এ শপথনামা শুধু মালিকের নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রচলিত বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করেননি; বরং ভারত সরকার কীভাবে বিতর্কিত কাশ্মীর ভূখণ্ডের আন্দোলনকে মোকাবিলা করেছে, সে প্রশ্নও সামনে এনেছে। একই দাবি পাকিস্তানেরও।

সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্নটি হলো মালিক কি আসলেই বরাবর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট ছিলেন?

ভারত সরকার প্রায় ২৫ বছর ধরে এই সমঝোতা (মালিকের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া) মেনে চলছিল। কিন্তু এখন এনআইএ আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিকৃত করে আমাকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। তাই হলফনামা দাখিল করার উদ্দেশ্য হলো, নিজের দিকটা তুলে ধরা—কোন পরিস্থিতিতে কাজ করেছিলাম, তা ব্যাখ্যা করা এবং বহু বছরের রাজনৈতিক আলোচনা ও গোপন বৈঠকের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতাকে প্রকাশ করা
ইয়াসিন মালিক, কাশ্মীরের নেতা

মালিক আসলে কী দাবি করেছেন

৮৪ পৃষ্ঠার হলফনামায় মালিক বলেছেন, যখন কাশ্মীরে স্বাধীনতাপন্থী তরুণদের সশস্ত্র আন্দোলন তুঙ্গে ছিল, সেই ১৯৯০-এর দশক থেকেই তিনি ভারতের শীর্ষ সরকারি কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

ইয়াসিন মালিক দাবি করেন, একাধিক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের সদস্য এবং এমনকি কয়েকজন হিন্দু ধর্মীয় গুরু তাঁর শ্রীনগরের বাসায় বহুবার এসেছেন। কাশ্মীরে শান্তির উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়ার জন্য এসবই ছিল নয়াদিল্লির অনুমোদিত এক ধরনের গোপন কূটনীতি। আরএসএস হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মতাদর্শিক অভিভাবক।

এমনকি ২০০৬ সালে পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়্যেবার প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎও ভারতের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)’ এর উদ্যোগে হয়েছিল বলে মালিক দাবি করেছেন। ওই বৈঠকের লক্ষ্য ছিল, সাঈদকে সশস্ত্র পথ থেকে সরিয়ে আনা। ২০০৮ সালের ভয়াবহ মুম্বাই হামলার জন্য সাঈদকে দায়ী করে থাকে ভারত।

ইয়াসিন মালিক কে

১৯৮৭ সালে কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারপন্থীদের পক্ষে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ইয়াসিন মালিকের বয়স তখন ২১ বছর। কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরের মাইসুমা এলাকায় জন্ম তাঁর।

ওই সময় মালিক ছিলেন একটি ভোটকেন্দ্রে বিরোধী দলের এজেন্ট। নিজ চোখে কারচুপির ঘটনা দেখেন তিনি। সেই নির্বাচনকে ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া কাশ্মীরের পরবর্তী সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা হিসেবে ধরা হয়।

ভোট ‘চুরির’ প্রতিক্রিয়ায় মালিক তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে যান। সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে তিনি অস্ত্র চালানো শেখেন বলে অভিযোগ ওঠে। ফিরে এসে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্রোহী সংগঠন জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সংগঠনটি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একাধিক প্রাণঘাতী হামলার জন্য পরিচিত।

তবে মালিক শিগগিরই পাকিস্তানের সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন। কারণ, তিনি কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান চেয়েছিল, কাশ্মীর তাদের সঙ্গে যুক্ত হোক। ফলে পাকিস্তান পরে জেকেএলএফের প্রতিদ্বন্দ্বী হিজবুল মুজাহিদিনকে সমর্থন দিতে শুরু করে।

নয়াদিল্লির একটি আদালতে পুলিশ পাহারায় ইয়াসিন মালিক। ২৫ মে ২০২২

১৯৯০ সালে মালিককে গ্রেপ্তার করে ভারত। তাঁর দাবি, তাঁকে প্রথমে দিল্লির তিহার জেলে নেওয়া হয়, পরে মেহরাউলির একটি গেস্টহাউসে রাখা হয়। সেখানে প্রায় প্রতিদিন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখরের সঙ্গে রাতের খাবারে বসতে চাপ দিতেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল, মালিককে সশস্ত্র আন্দোলন থেকে বিরত রাখা।

পরে মালিক আরও চারজন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দাবি করেন—কংগ্রেসের পি ভি নরসিমা রাও ও মনমোহন সিং, ইউনাইটেড ফ্রন্টের ইন্দর কুমার গুজরাল ও বিজেপির অটল বিহারী বাজপেয়ী। বাজপেয়ী ও সিং উভয়েই পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় সক্রিয় ছিলেন। পরবর্তী সময়ে (২০১৪ সাল) নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৯৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান মালিক। তিনি দাবি করেন, এটি ছিল নয়াদিল্লির সঙ্গে তাঁর এক ধরনের নীরব সমঝোতা। মুক্তির পর তিনি প্রকাশ্যে অস্ত্র ত্যাগ করেন, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন এবং মহাত্মা গান্ধীর মতো অহিংস আন্দোলনের পথ বেছে নেন।

গত আগস্টের শেষ দিকে দিল্লি হাইকোর্টে ৫৯ বছর বয়সী মালিকের দাখিল করা এক হলফনামা ভারতজুড়ে আলোচনার ঝড় তুলেছে। সেখানে এমন কিছু চাঞ্চল্যকর দাবি করা হয়েছে, যা ভারতের সাবেক কিছু কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকের মতে, অন্তত আংশিক সত্য হতে পারে।

এরপর থেকে মালিক বহুবার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি কাশ্মীরে রাজনৈতিক অধিকার ও মানবাধিকার হরণ, বেসামরিক লোকজনকে অবৈধভাবে আটক, নির্যাতন ও হত্যা করা বন্ধ এবং ভারতীয় শাসন অবসানের দাবি তুলেছেন। এসব আন্দোলনের কারণে তিনি বারবার গ্রেপ্তারও হয়েছেন। ফলে অনেক কাশ্মীরির কাছে তিনি আপসহীন নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।

কিন্তু ২০১৯ সালে মালিকের পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর মালিককে গ্রেপ্তার ও জেকেএলএফ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পুরোনো মামলাগুলোও পুনরুজ্জীবিত করা হয়। মালিকের কথায়, এসব মামলায় তাঁকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মামলা ছিল, ১৯৮৯ সালে সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুফতি মোহাম্মদ সাঈদের মেয়ে রুবাইয়া সাঈদকে অপহরণ, ১৯৯০ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর চার সদস্যকে হত্যা এবং ভারতে অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যে পাকিস্তান থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ।

২০২২ সালের মে মাসে বিশেষ আদালত মালিককে দুই দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও আরও কয়েকটি মামলায় ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেন এবং লাখ রুপি জরিমানা করেন। তখন থেকেই তিহার জেলে বন্দী আছেন তিনি।

ভারত সরকার স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে কিছু মানুষকে ব্যবহার করে, পরে তাঁদের ছুড়ে ফেলে বা শাস্তি দেয়
মেহবুবা মুফতি, কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী

কেন এ হলফনামা জমা দিলেন মালিক

গত ২৫ আগস্ট দিল্লি হাইকোর্টে জমা দেওয়া হলফনামাটি প্রকৃতপক্ষে ছিল ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ-র আবেদনের জবাব। এনআইএ মালিকের যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড চাইছিল।

মালিক দাবি করেন, প্রকাশ্যে তিনি আপসহীন স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরি নেতার ভাবমূর্তি বজায় রাখলেও আসলে ভারতীয় বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রেখেছেন। সরকারের আশ্বাস ছিল, তিনি অহিংস আন্দোলনে থাকলে তাঁর কিংবা জেকেএলএফের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগগুলো সামনে আনা হবে না।

মালিক বলেন, ‘ভারত সরকার প্রায় ২৫ বছর ধরে এই সমঝোতা মেনে চলছিল। কিন্তু এখন এনআইএ আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিকৃত করে আমাকে “সন্ত্রাসী” হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। তাই হলফনামা দাখিল করার উদ্দেশ্য হলো, নিজের দিকটা তুলে ধরা—কোন পরিস্থিতিতে কাজ করেছিলাম, তা ব্যাখ্যা করা এবং বহু বছরের রাজনৈতিক আলোচনা ও গোপন বৈঠকের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসঘাতকতাকে প্রকাশ করা।’

মালিক আরও দাবি করেন, ২০০৬ সালে হাফিজ সাঈদের সঙ্গে পাকিস্তানে তাঁর বৈঠক ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার অনুমোদিত ছিল, আর ফিরে এসে তিনি ভারতের শীর্ষ নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের তা জানিয়েছিলেন।

মুজাফফরাবাদে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছুড়ছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ১ অক্টোবর, ২০২৫

কাশ্মীর নিয়ে কয়েক দশক ধরে লেখালেখি করছেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক এমন একজন সাংবাদিক আল-জাজিরাকে বলেন, এ হলফনামা কাশ্মীর ইস্যুর ধোঁয়াশা ও দ্বিমুখী বাস্তবতাকে সামনে আনে। তাঁর মতে, মালিকের মামলা এক ধরনের ‘লিটমাস টেস্ট’।

ওই সাংবাদিক ও লেখক বলেছেন, ‘মামলাকারীরা বলছে, মালিকের পাশে থাকা মানে—ভারতের বিরুদ্ধে থাকা (অর্থাৎ, মালিক ভারতবিরোধী)।’ এ সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে এটি বলেছেন। কারণ তাঁর ভয়, ভারত সরকার তাঁকে দেশে প্রবেশের অনুমতি না দিতে পারে।

‘কিন্তু মালিক ঠিক এর (মামলাকারীদের দাবির) উল্টো প্রমাণ করেছেন তিনি নিজের জন্য, তাঁর বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এবং জটিল এ সংঘাতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিনিধির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন’, বলেন ওই সাংবাদিক।

মালিকের অন্যান্য দাবি

হলফনামায় মালিক দাবি করেন, ২০১৬ সালে তরুণ বিদ্রোহী নেতা বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর কাশ্মীরে যে বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা প্রশমিত করতে তিনি ভারতকে সহায়তা করেছিলেন।

মালিক বলেন, সে সময় কাশ্মীরের স্বাধীনতাপন্থী নেতা সাইয়েদ আলী শাহ গিলানির (পরে প্রয়াত) সঙ্গে তাঁর বৈঠকও ভারত সরকারের অনুমোদনে হয়েছিল। তিনি গিলানিকে কয়েক দিনের জন্য ধর্মঘট স্থগিত করতে রাজি করান, যাতে আন্দোলন আরও না ছড়ায়। তাঁর দাবি, গিলানির নেতৃত্বে থাকা স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রস্তাব কার্যকর করতে সক্ষম হন।

মালিক বলেন, ওই বিরতি নেওয়ায় সড়কপথে বিক্ষোভ আরও তীব্র হয়ে ওঠা রোধ করা যায় এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন ধীরে ধীরে কমে আসে। তিনি দাবি করেন, ধর্মঘটে বিরতি দেওয়ার তাঁর প্রস্তাব কাশ্মীরের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়েরও সমর্থন পেয়েছিল; যারা ধর্মঘটের কারণে আয় হারাচ্ছিল।

৮৪ পৃষ্ঠার হলফনামায় ইয়াসিন মালিক বলেছেন, যখন কাশ্মীরে স্বাধীনতাপন্থী তরুণদের সশস্ত্র আন্দোলন তুঙ্গে ছিল, সেই ১৯৯০-এর দশক থেকেই তিনি ভারতের শীর্ষ সরকারি কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।

হলফনামায় মালিক আরও বলেন, ২০০০ সালে ভারতীয় ব্যবসায়ী ধনকুবের ধীরুভাই আম্বানির সঙ্গেও তাঁর গোপন বৈঠক হয়েছিল। সে সময় আম্বানি গুজরাটে একটি তেল শোধনাগার স্থাপন করছিলেন। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে প্রকল্পটি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে—এমন শঙ্কা থেকেই আম্বানি মালিকের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। ভারতের শিল্পগোষ্ঠী রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানির প্রয়াত বাবা ধীরুভাই আম্বানি।

কিন্তু মালিক এ বৈঠকের বিষয়ে বেশি কিছু প্রকাশ করেননি। শুধু বলেছেন যে তিনি ও আম্বানি সাধারণ সৌজন্য বিনিময় করেছেন এবং নিতান্ত সাধারণ মানুষ থেকে উঠে আসার অতীত ইতিহাস নিয়ে একধরনের সংযোগ অনুভব করেছেন। তবে শিল্পপতির প্রকল্প সংক্রান্ত উদ্বেগ দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন কি না, যেটি আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল পরিশোধনাগার, সে বিষয়ে কিছু বলেননি মালিক।

মালিক বলেন, ২০০১ সালে বাজপেয়ীর আমলে তিনি ভারতীয় পাসপোর্টও পান। ওই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। মালিক জানান, ওই পাসপোর্টে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরবসহ নানা দেশ ভ্রমণ করেন এবং কার সঙ্গে দেখা করেছেন, তা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানাতেন।

মালিকের অভিযোগ কতটা বিশ্বাসযোগ্য

গত ১৯ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চিঠি লিখে মালিকের মামলায় সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তদন্ত সংস্থা এনআইএ মালিকের যাবজ্জীবন সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায় এ আহ্বান জানান তিনি।

এক সপ্তাহ পর সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট দ্য ওয়্যারে এক নিবন্ধে মুফতি লেখেন, ভারত সরকার স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য পূরণে কিছু মানুষকে ব্যবহার করে, পরে তাঁদের ছুড়ে ফেলে বা শাস্তি দেয়। তিনি মালিকের ঘটনাকে ২০১৩ সালে দিল্লির তিহার জেলে আফজল গুরুর গোপন ফাঁসির সঙ্গে তুলনা করেন।

কাশ্মীরের বাসিন্দা আফজল গুরু ২০০১ সালে ভারতের সংসদে হামলার দায়ে দণ্ডিত হন। ২০০৪ সালে কারাগার থেকে তাঁর আইনজীবীকে লেখা একটি চিঠিতে গুরু এক ভারতীয় পুলিশ কর্মকর্তা দেবিন্দর সিংয়ের নাম উল্লেখ করেছিলেন, যিনি তাঁকে সংসদ হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করতে বলেছিলেন বলে দাবি করা হয়। গুরুর এ অভিযোগ কখনো তদন্ত করা হয়নি। তবে ২০২০ সালে দেবিন্দরকে কাশ্মীরে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় তিনি দুই ব্যক্তির সঙ্গে একটি গাড়িতে যাচ্ছিলেন; যাঁরা পাকিস্তানভিত্তিক হিজবুল-মুজাহিদিন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্দেহভাজন সদস্য ছিলেন। এটি ভারত–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক অজয় সাহনি মনে করেন, মালিকের এসব অভিযোগ উল্টো প্রমাণ করে যে তিনি সন্দেহজনক এক চরিত্রের ব্যক্তি, যিনি দুই দিকেই খেলেছেন।

‘তাঁর (ইয়াসিন মালিক) বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত মামলাও রয়েছে। হয়তো সরকারের ভেতর ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। এ জন্যই তাঁকে মুক্ত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। না হলে আগেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো’, বলেন নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক সহনি।

‘শুধু রাষ্ট্র আপনাকে ব্যবহার করেছে, মানে এ নয় যে আপনি সৎ মানুষ। মালিক তাঁর চলমান মামলাগুলোকে ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ বলেছেন। কারণ তিনি দাবি করছেন, ভারত সরকার তাঁকে ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল’, বলেন সহনি।

সহনির ভাষায়, ‘আসলে ব্যাপারটা উল্টো। যদি আপনি সত্যিই সৎ মানুষ হতেন, তবে রাষ্ট্র আপনাকে ব্যবহার করতে পারত না।’

অন্যদিকে, ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মীর ইস্যু কভার করা সাংবাদিক ও লেখক বিক্রম জিত সিং মনে করেন, মালিকের দাবি অমূলক নয়। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ‘যা ঘটছিল, তার সবকিছুর মধ্যেই ছিল’ এবং মালিকের দাবিগুলো ‘বিশ্বাসযোগ্য’ শোনায়। তাঁর মতে, সরকার আসলেই বিভিন্ন সময়ে এসব নেতাকে ব্যবহার করেছে সেতুবন্ধন তৈরি করার জন্য।